অফবিট

৭০০ বছর আগের মহামারী। এখনও বছরে ৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে

প্রত্যেক শতাব্দীতেই কোন না কোন দেশে এমন কোন ঘটনা ঘটেছে যেটা গোটা ইতিহাস মনে রাখবে। সেরকমই মধ্যযুগের ইউরোপে ভয়ংকর আবহাওয়া তৈরি করেছিল যাকে তখনকার মানুষেরা ব্ল্যাক ডেথ নামে সম্বোধন করত। ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় ইউরোপে আছড়ে‌ পরেছিল ভয়ংকর মহামারী বিউবোনিক প্লেগ। আনুমানিক ১৩৪৭ সালে প্রথম বারোটি জাহাজের মাধ্যমে মেসিনার সিসিলিয়ান বন্দেরে এসে পৌঁছেছিল প্লেগ। এরপরই ইউরোপে পদার্পণ করার পর সেটি ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়াতেও।

সেই জাহাজ যখন ইউরোপে এসে পৌঁছেছিল তখন জাহাজে অবস্থিত লোকেদের দেখে অবাক হয়ে গেছিল গোটা দেশ। কারণ তখন ঐ জাহাজে উপস্থিত অর্ধেক মানুষের মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল এবং যারা অবশিষ্ট ছিলেন তাদের সারা শরীরে বড় বড় কালো ফোড়ায় ভর্তি ছিল যেখান থেকে ক্রমাগত নির্গত হচ্ছিল পুঁজ এবং রস। এই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়ে সিসিলিয়ান কর্তৃপক্ষ বন্দর থেকে জাহাজ নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেও বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে ইউরোপের এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা অর্থাৎ ২০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল।

এবার আসা যাক কিভাবে প্লেগ রোগের সূত্রপাত ঘটেছিল? সেটি গোটা শহরে কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল? জানা যায় ১৩৪০ দশকের শেষের দিকে এই রোগটি প্রথমে দেখা গিয়েছিল চীনে এরপর সেটি ভারত, পারস্য, সিরিয়া, মিশর হয়ে ইউরোপে আছড়ে পরেছিল। সেই কারণে সিসিলিয়ানে বন্দর আসার আগেই বহুৎ ইউরোপীয় বণিকরা শুনতে পেয়েছিলেন এই মহামারীর বিষয়। সেই কারণে বণিকরা নিকট হোক কিংবা দূরে বাণিজ্য করতে যেতেও ভয় পাচ্ছিলেন। কিছু ইতিহাসবিদদের অনুমান এশিয়ায় এই প্লেগ গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় ২ হাজার বছর আগে। কিন্তু অন্য কথা বলছেন চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে ব্ল্যাক ডেথের প্যাথোজেনটি ৩ হাজার বছর পূর্বে অবস্থান করছিল ইউরোপেরই মাঝে।

মধ্যযুগের ইউরোপের সমাজ অতটা চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নত না থাকায় তারা প্লেগ রোগ সম্বন্ধে সতর্ক কিংবা সচেতনতা কোনটাই অবলম্বন করেনি। সেই কারণেই প্লেগ রোগের সিমটম এরা বুঝতে পারেনি। যেহেতু প্লেগ রোগ গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিল তাই ইতালিয়ান কবি জিওভান্নি বোকাসিও তার একটি লেখায় প্লেগ রোগের উল্লেখ করে তিনি লিখেছিলেন”নারী এবং পুরুষ উভয়ের শরীরেই একই রকম সিমটম দেখা যায়। মূলত কোন ব্যক্তি প্রথমে প্লেগ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হলেই প্রথমে তার শরীরের বিশেষ কিছু অংশ যেমন বগলের নীচে ও কুঁচকিতে বেশ কিছুটা অংশ ফুলে যেত। কিছু ফোলা ছিল অনেকটা ডিমের মতো দেখতে তো কিছু দেখতে আপেলের মত। পরবর্তীকালে সেই ফোলা অংশ থেকেই ক্রমাগত রক্ত ও পুঁজ নির্গত হত এবং তার সঙ্গে থাকতো অসহ্য মাথা যন্ত্রণা, বমি ,জ্বর ও ডায়েরিয়া। কোন মানব শরীরে প্লেগ রোগ আক্রান্ত হলে প্রথমে বিউবোনিক প্লেগটি লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের লিম্ফ নোডগুলিকে ফুলিয়ে দিতো। এরপর যদি এই রোগের চিকিৎসা ভালোভাবে না করা হত তাহলে এই রোগটির রক্ত এবং ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ত যার সর্বশেষ পরিণতি ছিল মৃত্যু।

আজকের দিনের করোনা মহামারীর মতো তখনকার দিনে প্লেগ ছিল ছোঁয়াচে একটি রোগ। তখনকার দিনের বিশেষজ্ঞরা এই রোগ সম্বন্ধে অনেক গবেষণা করেও যে সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি আজকের দিনের বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে বিউবোনিক প্লেগ রোগটি ছিল মূলত ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস নামক ব্যাসিলাস রেটিং খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ত। আরো সহজ ভাষায় বলতে গেলে Xenopsylla cheopis নামক একটি ফ্লির কামড়ের মাধ্যমে লাসিকাতন্ত্রের সংক্রমণ। তবে সেপটিসেমিক প্লেগ রোগটি অসুস্থ ব্যক্তির কোন টিস্যু কিংবা তার কফের মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়াটি ক্ষেতের ইদুর কিংবা কোন যক্ষ্মিকাটি গৃহে পরজীবী হিসেবে বসবাস করে। সরাসরি এই ব্যাকটেরিয়া কোনো মানুষের ক্ষতি করেনা ঠিকই কিন্তু একটি পোশাক থেকে অন্য পোশকে স্থানান্তরিত হতে থাকে। এছাড়াও এই ব্যাকটেরিয়াটি বাতাস, বিভিন্ন পতঙ্গ এবং ইঁদুরের কামড়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হত। সেক্ষেত্রে ইউরোপের বেশিরভাগ বাড়ি এবং জাহাজে এই ধরনের কীটপতঙ্গ বিদ্যমান থাকার কারণে মূলত বন্দর শহর গুলিতে প্রথম প্লেগ রোগের আবির্ভাব ঘটেছিল।

সর্বপ্রথম ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগ রোগের আবির্ভাব ঘটেছিল মেসিনাতে। এরপর সেটি ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে হতে ফ্রান্সের মার্সেই বন্দর, উত্তর আফ্রিকার তিউনিস বন্দর, রোম এবং ফ্লোরেন্সে পৌঁছেছিল। এই সকল বন্দরে ছিল বাণিজ্যের একটা বিরাট অংশ। এরপর ১৩৪৮ সাল নাগাদ প্যারিস, বোর্দো, লিয়ন এবং লন্ডনেও প্লেগের সংক্রমণ দেখা গিয়েছিল। সে সময় চিকিৎসকদের মতামত অনুযায়ী অসুস্থ ব্যক্তির অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তির জামাকাপড়ের সংস্পর্শে আসলেও সুস্থ মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ত। সেক্ষেত্রে তখনকার দিনে প্লেগ রোগের চিকিৎসা এবং সঠিক সতর্কতা কি ছিল সেই বিষয়ে অবগত ছিল না সাধারণ মানুষ এমনকি চিকিৎসকেরাও। আজকের দিনে অর্থাৎ যেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা এতটা উন্নত সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও করোনা মহামারীর সঙ্গে মোকাবিলা করতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছিল গোটা পৃথিবীকে।

তবে যাইহোক প্লেগ আক্রান্ত ব্যক্তিকে তো আর ফেলে রাখা যায় না! তাই তখনকার দিনের যতটা চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত ছিল তাই দিয়েই অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসা করা হতো। তখনকার সময় চিকিৎসকেরা অপরিশোধিত ও অপ্রত্যাশিত কিছু চিকিৎসা করতেন। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে প্লেগ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে ফোড়া সূচ ও কাপড় দিয়ে ফাটিয়ে ফেলতেন। যদিও এই প্রক্রিয়া ছিল খুবই মারাত্মক এবং অস্বাস্থ্যকর। চিকিৎসার পাশাপাশি চলতো বেশ কিছু কুসংস্কার যেমন অসুস্থ ব্যক্তি শরীরে গোলাপজল দেওয়া বা ভিনেগার দিয়ে স্নান করানো ইত্যাদি। অনেক সময় দেখা গিয়েছে যে এই রোগের হাত থেকে সুস্থ মানুষেরা বাঁচতে কেউ কেউ শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি দিয়েছিলেন আবার অনেক চিকিৎসক রোগীদের দেখতে অস্বীকার করছিল তো অনেক আত্মীয়রা নিজের রক্তের মানুষকে ত্যাগ করছিল। এমনকি পুরোহিতরা মৃত ব্যক্তির শেষকৃত্য করতে মানা করছিলেন এবং দোকানিরা দোকান বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও এই রোগ এড়ানো যায়নি। কারণ শুধুমাত্র মানুষ নয় প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগি সকলেই। সেই সময় ভেড়ারা এতটাই প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল যে একসময় ইউরোপে উলের পোশাকের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল।

যেহেতু মধ্যযুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের তুলনায় কুসংস্কার বেশি অংশ বিস্তার করেছিল তাই তখনকার দিনে ইউরোপীয়দের একাংশের মনে হয়েছিল এই প্লেগ রোগ কোন জীবাণু নয় বরং ঐশ্বরিক শাস্তি। অর্থাৎ পরনিন্দা-পরচর্চা, ব্যভিচারী ও ধর্মদ্রোহীতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এই রোগের আবির্ভাব ঘটেছে। তাই এই রোগ থেকে বাঁচতে একমাত্র উপায় ছিল ঈশ্বরের ক্ষমা। সেই সময় মানুষের এতটাই কুসংস্কারে মেতে উঠেছিল যে ১৩৪৮-১৩৪৯ সালে কয়েক হাজার ইহুদি হত্যা করেছিল ইউরোপীয়রা। যদি দেখা যায় তো আজও প্লেগ রোগের ইতি ঘটেনি। এই রোগ বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিভিন্ন নামে বারে বারে ফিরে আসে। তবে তখন প্লেগ রোগের সমাপ্তি ঘটাতে বন্দরের নাবিকদের ৩০ দিন যাবত জাহাজে আলাদা ভাবে রাখা হতো। কোন কোন সময় এই ৩০ দিন ৪০ দিনেও পরিণত হয়েছিল। এই কয়েকদিন আলাদাভাবে রেখে তাদের পর্যবেক্ষণ করা হত তারা প্লেগ রোগের আক্রান্ত কিনা এবং তাদের কোন শারীরিক সমস্যা আছে কিনা। ইউরোপে এই আলাদা রাখাকে কোন নাম না দিলেও ইতালিয়ানরা এই পদ্ধতিকে কোয়ারেন্টাইন বলতেন। যদি আজকের দিনেও সভ্য যুগের মানুষও এই কোয়ারেন্টাইন জিনিসটি ব্যবহার করে আসছেন। 

এবার প্রশ্ন হল প্লেগ রোগ কি এখনো আছে! উত্তরে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন যে ১৩৫০ দশকের শেষ পর্যন্ত এই মহামারিটি নিজের তান্ডব চালিয়েছিল ঠিকই কিন্তু পরবর্তী সময়ে জনগণের মধ্যে সতর্কতা চলে আসায় এবং স্যানিটাইজেনের ব্যবস্থা থাকায় এই প্লেগ রোগের উপশম অনেকটাই কমে গিয়েছে। কিন্তু ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেসনের গণনা মতে ১৩৫০ দশকের পরেও কয়েক শতাব্দি বাদে এই প্লেগ রোগের পুনরায় আবির্ভাব ঘটেছিল। এমনকি এখনো পর্যন্ত বছরে ১ হাজার থেকে ৩ হাজার জন ব্যক্তির মৃত্যু হয় এই রোগে আক্রান্তের কারণে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *