অফবিট

সিরিয়াকে চেকমেট করতে ইসরায়েলের গোয়েন্দাদের অপারেশান কোপেনহেগেন

সময়টা ১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মকালের এক সকাল। ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিমানবন্দরে বছর পঁচিশের এক যুবক আসে যার লক্ষ্য একটি সফল ব্যাঙ্কার হওয়া। বিমানবন্দর থেকে হোটেলে পৌঁছে ঘরে যাবার সময় যুবকটি লক্ষ্য করে হোটেলের লবিতে এক ব্যাক্তি হাতে একটি দাবার বই নিয়ে খুব গভীর মোনোযোগ দিয়ে দেখছে এবং তার সামনে একটি দাবার বোর্ড রয়েছে যাতে দাবার গুটি সাজানো রয়েছে। এটা দেখে যুবকটির নিজের অতীতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। খুব ছোটবেলায় সেও এরকম দাবার বোর্ড নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকত, কারন তার লক্ষ্য ছিল দাবায় বিশ্ব বিজেতা হওয়ার। এতক্ষন বারবার যে যুবকটির নাম বলা হচ্ছে তার নাম মজিদ, তার জন্ম মিশরে। মজিদ এরপর নিজের ঘরে চলে যায়। একদিন পর মজিদ আবারও লক্ষ্য করে সেই ব্যাক্তিটি লবিতে সেই একই স্থানে বসে আসে, আজকেও তার হাতে বই আছে এবং সামনে দাবার বোর্ডে গুটি সাজানো যাতে একটি বিশেষ ছক করা হয়েছে, যেন লোকটি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। লোকটি বইয়ের মধ্যে এতটাই তন্বয় তার আশেপাশে কী হচ্ছে সেব্যাপারে তার যেনো কোন খেয়ালই নেই। তবে আজ আর মজিদ চলে না গিয়ে সরাসরি সেই ব্যাক্তিটির সামনে গিয়ে দাবার বোর্ডে একটি চাল দেয় যাতে সরাসরি চেকমেট করা যায়। মজিদকে দেখে সেই ব্যাক্তিটি অবাক হয়ে যায় এবং উভয়ের মধ্যে দাবা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শুরু হয়, অল্প সময়েই তাদের মধ্যে ভাব হয়ে যায়। লোকটি বলে তার নাম মার্ক এবং সে একজন কানাডিয়ান ব্যাবসায়ী। তবে এটিই লোকটির আসল পরিচয় না, লোকটির আসল নাম ইহুদা গিল যে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন এজেন্ট। তাকে মজিদের সাথে পরিচয় করবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। মজিদের উপর অনেকদিন ধরে মোসাদের নজর ছিল। এর আগেও একাধিক বার মোসাদ মজিদের সাথে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু মোসাদ ব্যার্থ হয় প্রতিবার। মজিদের ডেনমার্কে আসার আগে ফ্রান্সেও মজিদের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল মোসাদ কিন্তু অল্পের জন্য মিশন ব্যার্থ হয়। এবার ডেনমার্কে মোসাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। বছর পঁচিশের ঝকঝকে চেহারার মজিদের সাথে কোন ঝামেলাই ছিল না মোসাদের তাদের আসল লক্ষ্য ছিল তার ভাই জদিদ। সিরিয়ান সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল জদিদ। দাবায় রাজাকে চেকমেট করার মতোন মোসাদের আসল লক্ষ্য ছিল সিরিয়াকে চেকমেট করার। সেখান থেকেই শুরু হয় মোসাদের অপারেশন কোপেনহেগেন।

ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত ইসরায়েল দেশটি তৈরি হয় ১৪ মে, ১৯৪৮ সালে। জন্মলগ্ন থেকেই ইসরায়েলের সাথে শত্রুতা তৈরি হয় আশেপাশের আরবদেশ গুলোর যেমন লেবানন, সিরিয়া, মিশর, জর্দানের সাথে।

১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ এবং ১৯৮২ সালে লেবাননের সাথে যুদ্ধের মাধ্যমে মোট পাঁচবার আরব ইসরায়েল যুদ্ধ হয়, এরপরে ২০০৬ সালেও হয় একবার যুদ্ধ হয় তবে যেসময়ের কথা বলা হচ্ছে তা ১৯৮৫ সালের, তখনও অবধি পাঁচবার ইসরায়েলের সাথে আরবদেশ গুলোর যুদ্ধ হয়, এমনকী আরবদেশ গুলো সম্মিলিত ভাবেও ইসরায়েলকে আক্রমন করেছিল কিন্তু তাও প্রতিবার ইসরায়েলেরই বিজয় হয়, শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল আরবদেশ গুলোর। মোসাদ সর্বক্ষনই আরবদেশ গুলোর উপর নজর রাখত। সিরিয়ার হসপিটালের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রের প্রায় সব জায়গায়ই মোসাদের এজেন্ট ছিল। মোসাদ খবর পায় সিরিয়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্ততি নিচ্ছে এবং তা প্রায় শেষ পর্যায়ে। তখনই মোসাদ জদিদকে টার্গেট করে। আর জদিদের কাছে পৌঁছানোর সবচেয়ে ভালো উপায় তার ভাই মজিদ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মোসাদের কাছে মজিদের কোন ছবি ছিলনা। সেসময় ডেনমার্কের সাথে ইসরায়েলের যথেষ্ট বন্ধুত্ব ছিল। কোন আরব ব্যাক্তি ডেনমার্কের ভিসা নিতে গেলেই তার সম্পর্কে তথ্য মোসাদকে জানাতো ডেনমার্ক, মোসাদ সবুজ সংকেত দিলে তবেই ডেনমার্ক ভিসা দিত।

১৯৮৫ সালে একদিন ডেনমার্ক ৪০ জন আরব ব্যাক্তির তথ্য দেয় মোসাদকে। ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবে মোসাদের হেড কোয়ার্টারে এক এজেন্ট বসে এই লিস্ট দেখছিল। হঠাৎ তার নজর যায় মজিদের ছবির উপর, তার কিছু একটা সন্দেহ হয়। সাথে সাথে জদিদের ছবির সাথে মিলিয়ে দেখা যায় উভয়ের মধ্যে মিল রয়েছে, সাথে সাথে মোসাদ নিশ্চিত হয় এই ব্যাক্তিটিই জদিদের ভাই, তখনই মোসাদ ডেনমার্কে তাদের নেটওয়ার্ক চালু করে। এদিকে হোটেলের লবিতে মার্ক ও মজিদের মধ্যে বন্ধুত্ব জমে উঠেছে। কথায় কথায় মজিদ জানায় তার ইচ্ছে ডেনমার্কে স্থায়ী বসবাস করা কিন্তু এখানে অতিরিক্ত ঘর ভাড়ার কারনে তার পরিবারকে আনতে পারছে না। সাথে সাথে মার্ক জানায় সে তাকে কম টাকায় ঘরের ব্যাবস্থা করে দেবে এবং সেইদিন সন্ধ্যা বেলাতে মার্ক ঘর দেখে দেয় মজিদকে। তবে এর আগে সেই ঘরে রীতিমতো নজরদারি ব্যাবস্থা ও ডিভাইস লাগিয়ে রাখে মোসাদ। কিছুদিন মজিদের উপর নজর রেখে মোসাদ জানতে পারে সপ্তাহে দুদিন জদিদের সাথে কথা হয় মজিদের, সিরিয়াতে স্মাগলিং এর কাজেও যুক্ত জদিদ এবং কিছুদিনের মধ্যেই উভয়ের দেখা হতে পারে। সাথে সাথে মোসাদ তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা তৈরি করে। মার্ক একদিন মজিদের সাথে দেখা করে বলে একটি ব্যাবসায়িক পরিকল্পনার ব্যাপারে। মার্ক মজিদকে বলে সে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের সম্ভবনা কেমন সেব্যাপারে তথ্য দেয় বিনিয়োগকারীদের এতে তারও মোটা কমিশন থাকে। এইসব দেশের উচ্চপদস্থ অফিসারদের সাথে সে যোগাযোগ করে সমস্ত তথ্যের জন্য। মার্ক এটাও জানায় সে সাইপ্রাস, ইসরায়েল, জর্ডানে বিনিয়োগের কথা চিন্তা করছে। মজিদ তখন জানায় তার সিরিয়াতে চেনাশোনা আছে। আসলে মার্ক প্রথমে ইচ্ছে করেই সিরিয়ার নাম করেনি যাতে মজিদের সন্দেহ না হয়। মার্ক তখন মজিদকে জানায় সে মোটা কমিশন পাবে তথ্য দিতে পারলে। বাড়ি ফিরেই মজিদ জদিদকে ফোন করে সব কথা জানায় এবং তাড়াতাড়ি ডেনমার্ক আসার কথা বলে। জদিদ দুদিনের মধ্যে ডেনমার্কে এসে উপস্থিত হয় এবং মার্ক, জদিদ ও মজিদের মধ্যে বৈঠক হয়। যাতে ঠিক হয় সিরিয়ার যাবতীয় তথ্য জদিদ দেবে, বদলে ২২,০০০ ডলার প্রতি মাসে সে পাবে এবং মজিদকেও ৩০,০০০ ডলার দেওয়া হয়। মার্ক প্রায়ই জদিদকে বেশ কিছু প্রশ্ন পাঠাতো যাতে বেশীরভাগই অর্থনীতির ব্যাপারে থাকতো তবে এরই মাঝে কিছু প্রশ্ন মিলিটারি ব্যাপারে থাকত যাতে জদিদ সন্দেহ না করে। জদিদও এসবের উত্তর লিখে ইসরায়েল সীমান্তের কাছে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিত যা পরে মোসাদেরই একটি এজেন্ট তুলে নিয়ে যেত। এভাবে পাঁচমাস চলে, জদিদ ভাবতেও পারেনি সে মোসাদের হয়ে কাজ করছে।

সিরিয়ার মিলিটারি যাবতীয় তথ্য মোসাদের হাতে চলে আসে। সবকিছু ঠিকই চলছিল কিন্ত ড্রাগস স্মগলিং করতে গিয়ে সিরিয়ার বিশেষ পুলিশের কাছে ধরা পড়ে জদিদ। তখন লন্ডনে সিরিয়ান অ্যামবাসিতে থাকা আরও একজন মোসাদ এজেন্ট হালিদ ফোনে জদিদকে বাঁচিয়ে দেয় সে যাত্রায়। কিছুদিন পর মোসাদ খবর পায় তিনদিনের মধ্যে ড্রাগস ডিলারদের সাথে জদিদের বৈঠক আছ এবং সেই বৈঠকেই নাকী জদিদকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা করেছে সিরিয়ান সরকার। মোসাদের এক এজেন্ট তখন ড্রাগস ডিলার সেজে ফোন করে জদিদকে জানায় বৈঠক নির্দিষ্ট দিনে হবেনা কিছুদিন পর হবে তবে তার চিন্তা করার দরকার নেই সে তার মূল্য পেয়ে যাবে, এরজন্য তাকে হল্যান্ড আসতে হবে। এদিকে নির্দিষ্ট দিনে বৈঠকে উপস্থিত থাকা সমস্ত ড্রাগস ডিলারদের গ্রেফতার করে সিরিয়ান পুলিশ কিন্তু জদিদকে পাওয়া যায়নি। এদিকে হল্যান্ড পৌঁছে জদিদ জানতে পারে সমস্ত ড্রাগস ডিলাররা গ্রেফতার হয়ে গেছে এবং তারা ভাবছে এর পেছনে জদিদই আছে সেজন্য তারা তাকে খুঁজছে এবং সবচেয়ে বড় কথা সিরিয়ান সরকার তার স্মাগলিং এর ব্যাপারে সব তথ্য জেনে গেছে এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।

জদিদ ভয় পেয়ে একটি হোটেলে গিয়ে ওঠে। হঠাৎ তার ফোনে একটি ফোন আসে যাতে তাকে বলা হয় সেজন্য সিরিয়া ফিরে না যায় এবং পরেরদিন হোটেলের পেছন দিকে তাকে দেখা করতে বলা হয়। কথা অনুযায়ী পরেরদিন হোটেলের পিছনে এক ব্যাক্তির সাথে জদিদের বৈঠক হয় যাতে সেই ব্যাক্তিটি জদিদকে বলে তার ভাই মজিদ তাদের কাছে আছে জদিদ যদি তার ভালো চায় এবং ড্রাগস ডিলার, সিরিয়ান সরকারের হাত থেকে বাঁচতে চায় তাহলে তাকে তাদের কথা মতো চলতে হবে। এরজন্য তারা জদিদের পরিবারকেও সিরিয়া থেকে নিয়ে আসবে এবং তাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিকও দেওয়া হবে। জদিদের হাতে রাজি হওয়া ছাড়া আরও কোনও উপায়ও ছিলনা। সেই ব্যাক্তিটি আর কেউনা মোসাদেরই এক এজেন্ট। জদিদের কাছ থেকে সিরিয়া সহ আরও আরব দেশের গোপন তথ্য পায় মোসাদ যাকে কাজে লাগিয়ে মোসাদ সিরিয়ার ইসরায়েলে আক্রমন করার পরিকল্পনা নষ্ট করে দেয়। বিনা যুদ্ধেই সিরিয়াকে চেকমেট দেয় ইসরায়েল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *