অফবিট

এই মহূর্তে প্রচুর ট্যাঙ্কার দরকার ভারতবর্ষের

সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারত শান্তিপ্রিয় দেশ হিসাবেই পরিচিত। অতীতে বারবার ভারতে বিদেশী শক্তি গুলো আক্রমন করেছে কিন্তু ভারত কোনওদিন কোন দেশকে আক্রমন করেনি সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরও ভারত সেই একই ধারা বজায় রেখেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া ঠান্ডা লড়াইকে কেন্দ্র করে বিশ্ব যখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছিল, তখনও তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু কোন পক্ষেই যোগ না দিয়ে জোট নিরপেক্ষ একটি তৃতীয় সংগঠন তৈরি করেছিল অর্থাৎ ভারত সবসময় শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষেই থাকে।

ভারত তাদের পরমানু অস্ত্র ব্যাবহার সম্পর্কেও প্রথমে ব্যবহার না করার নীতি নিয়েছে। কিন্ত এর অর্থ ভারত দুর্বল তেমনটা কিন্তু মোটেও না, সময়ে সময়ে পাকিস্তান যতবার ভারতকে আক্রমন করেছে ততবার শোচনীয় পরাজয়ের স্বীকার হয়েছে। এমনকী ভারতের বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে না পেরে পাকিস্তান ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। ১৯৬২ সালের অতর্কিত চীনা আক্রমনের কথা বাদ দিলে সাম্প্রতিক সময়ে ডোকলাম হোক, গালওয়ান হোক কিংবা অরুনাচল প্রদেশে চীনের সেনাবাহিনী বারবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামনে পর্যদুস্ত হয়েছে। প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ডঃ এপিজে আব্দুল কালাম বলেছিলেন যতদিন ভারত বিশ্বের সামনে শক্তিশালী না হবে ততদিন কেউ আমাদের সম্মান করবে না, এই পৃথিবীতে ভয়ের কোন জায়গা নেই শক্তিই শক্তিশালীকে সম্মান করে। যার কারনে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ভারত নিজেকে সামরিক ভাবেও প্রবল শক্তিশালী করছে। এই মহূর্তে সামরিক দিক দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ ভারত। রাশিয়া, আমেরিকা, ইসরায়েল, ফ্রান্সের থেকে ভারত প্রতিবছরই কয়েক বিলিয়ন ডলারের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র কেনে, পাশাপাশি দেশেও ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হচ্ছে।

ভারত যেসব দেশ থেকে অস্ত্র কেনে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিশেষ হচ্ছে রাশিয়া। সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় থেকেই দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। গত পাঁচ বছরে ভারত রাশিয়া থেকে অন্তত ১৫ বিলিয়ন ডলার বা ১,২০,০০০ কোটি টাকার অস্ত্র কিনেছে। ভারত সবচেয়ে বেশী সমরাস্ত্র রাশিয়া থেকেই কেনে। তবে রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র কেনার পরিমান অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে ভারত। বর্তমানে ভারত মেক ইন ইন্ডিয়া নীতিতে কোন দেশ থেকে টেকনোলজি কিনে দেশেই তৈরির পক্ষে বেশী জোর দিয়েছে। যার কারনে বিশ্বের বড় বড় প্রতিরক্ষা সংস্থা গুলো যেমন আমেরিকার লকহিড মার্টিন, বোয়িং, ফ্রান্সের স্যাফরন, ড্যাসল্ট, ইসরায়েলের রাফায়েল, ইসরায়েলি ওয়েপনস ইন্ডাস্ট্রির মতোন সংস্থা গুলো বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থার সাথে জোট করে ভারতেই তাদের হাব খুলতে আগ্রহ দেখিয়েছে। ঠিক তেমনি বিভিন্ন রাশিয়ান সংস্থাও ভারতের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সমরাস্ত্র অফার করেছে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে টি-১৪ আরর্মাটা প্রধান ব্যাটেল ট্যাঙ্ক। রাশিয়া অনেকদিন ধরেই এই ট্যাঙ্কের অফার দিয়ে আসছে ভারতকে। ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত হওয়া এরোইন্ডিয়া ২০২৩ এ রাশিয়ান ফেডারেল সার্ভিস ফর মিলিটারি টেকনিক্যাল কোঅপারেশনের ডিরেক্টর ভ্লাদিমির ড্রোজোজোভ জানিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভবিষ্যতের প্রধান ব্যাটেল ট্যাঙ্কের জন্য রাশিয়া আর্মাটা টেকনোলজি ভারতকে দিতে প্রস্তত। রাশিয়ান টি-১৪ আর্মাটাকে এই মহূর্তের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ট্যাঙ্ক বলা হচ্ছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভারত সফর কালে সর্বপ্রথম টি-১৪ আর্মাটার প্রস্তাব ভারতকে দেয়। এরপর ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং এর রাশিয়া সফরেও আর্মাটার প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। গত একবছর ধরে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে প্রচুর আর্থিক নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে রাশিয়া। যার জন্য নিজেদের অর্থনীতি সচল রাখবার জন্য রাশিয়া অস্ত্র বিক্রিতে জোর দিয়েছে। রাশিয়ান অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হচ্ছে ভারত ও চীন। ভারত একাই রাশিয়ান অস্ত্রের কুড়ি শতাংশ কেনে। তাই রাশিয়া এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে টি-১৪ আর্মাটা প্রযুক্তি ভারতকে বিক্রি করার জন্য। এই ট্যাঙ্কটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য উপযুক্ত হবে, তার জন্য প্রথমে এই ট্যাঙ্ক সম্পর্কে জানা যাক একটু। 

রাশিয়ার উরালভ্যাগোনজাভোদ ২০১৪ সালে এই ট্যাঙ্কটি তৈরি করে। এর ওজন ৫৫ টন এবং একটি ট্যাঙ্কে তিনজন ক্রু থাকতে পারে। এতে ১২৫ মিলিমিটারের একটি টুরেট আছে যার রেঞ্জ পাঁচ কিলোমিটার, তবে এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ বারো কিলোমিটার। এতে একবারে ৪৫ রাউন্ড ফায়ার করবার সক্ষমতা আছে। তবে ভবিষ্যতে এটি আপগ্রেড করে ১৫২ মিলিমিটার এর ক্যানন যুক্ত করা হবে। সাধারনত ট্যাঙ্কের টুরেট পরিচালনার জন্য একজন করে থাকে। কিন্তু টি-১৪ এর টুরেটটি অটোমেটিক কারন টি-১৪ কে রাশিয়া ভবিষ্যতের প্রযুক্তি হিসাবে তৈরি করেছে এবং গোটা ট্যাঙ্কের সমস্ত প্রযুক্তি ডিজিট্যাল। টি-১৪ এর ক্যানন দিয়ে ৭-১২ কিলোমিটার রেঞ্জের লেসার গাইডেড মিসাইল ফায়ার করাও সম্ভব। টি-১৪ এর অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল দিয়ে হেলিকপ্টার ও ড্রোনকে ধ্বংস করা সম্ভব। এই ট্যাংকের গতি ৭০-৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। এই ট্যাংকের প্রটেকশন সিস্টেম বা আর্মার খুবই শক্তিশালী যা মিসাইল আটকাতেও সম্ভব। এই ট্যাংকে অ্যাফগানিট অ্যাক্টিভ প্রোটেকশন সিস্টেম রয়েছে যা ৫ ম্যাক গতির মিসাইল আটকাতেও সম্ভব, ভবিষ্যতে এর প্রোটেকশন সিস্টেম আপগ্রেড করা হবে যা ৮.৮ ম্যাক গতির মিসাইল আটকাতে পারবে। 

রাশিয়ার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের প্রথম সারির এটিজিএম স্পাইক, জ্যাভেলিন, হেলফায়ার, ব্রিমস্টোনকেও আটকাতে সম্ভব এই সিস্টেম। এতে একটি বিশেষ ধরনের রেডার অ্যাবসরভিং রঙ ব্যবহার করা হয়েছে, যার জন্য রেডারে এই ট্যাঙ্ককে খুঁজে পাওয়া শক্ত। টি-১৪ এ ব্যবহার করা হয়েছে একটি সিএইচটিজেড বারোএন৩৬০ ডিজেল ইঞ্জিন, যা ১১০০ কিলোওয়াট ক্ষমতা উৎপন্ন করতে সক্ষম। এই ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা ২০০০ ঘন্টা। টি-১৪ এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ ৫০০ কিলোমিটার। ২০১১ সাল থেকে রাশিয়া এই ট্যাঙ্ক তৈরির কাজ শুরু করে এবং ২০১৫ সালে মস্কো বিজয় দিবসে এই ট্যাঙ্ককে প্রথম জনসমক্ষে আনে রাশিয়া। রাশিয়া টি-১৪ এর একটি আনম্যানড ভার্সন টেচ্যেনকা-বি তৈরির কাজ শুরু করেছে। এজন্য টি-১৪ আর্মাটাকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাটেল ট্যাঙ্ক বলা হচ্ছে। ভারত প্রথম থেকেই রাশিয়ান ট্যাঙ্ক ব্যবহার করছে। এই মহূর্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে প্রচুর পরিমানে টি-৭২ ও টি-৯০ ট্যাঙ্ক রয়েছে। ২০২১ এই ভারতীয় সেনাবাহিনী জানিয়েছে তাদের ১৭৭০ ফিউচার রেডি কমব্যাট ভ্যেইকল বা এফআরসিভি দরকার।

২০৩০ এর মধ্যে এই ট্যাংঙ্ক কেনবার কথা জানিয়েছে সেনাবাহিনী। ভারতীয় সেনাবাহিনী চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমন ট্যাঙ্ক দরকার যা -৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে কাজ করতে পারবে এবং উঁচু পার্বত্য অঞ্চলেও সমান ভাবে কার্যক্রম থাকবে। বিশেষ করে চীনের ভিটি-৪ ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে ভারতের একটি শক্তিশালী আধুনিক ব্যাটেল ট্যাঙ্ক দরকার। রাশিয়ার এই টি-১৪ আর্মাটা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমস্ত শর্ত পূরন করতে সক্ষম। টি-১৪ চীনের ভিটি-৪ এর থেকেও আধুনিক। তবে ভারত নিজেও ট্যাঙ্ক তৈরি করছে। অর্জুন ট্যাঙ্ক ভারত তৈরি করেছে। এছাড়া প্রজেক্ট জোরাওয়ারের আওতায় ভারত ৩৫৪ টি হালকা ট্যাঙ্ক তৈরি করছে। ৮০০০-১০০০০ ফুট উচ্চতায় চীনের বিরুদ্ধে এধরনের হালকা ট্যাঙ্ক ভারতের দরকার। এই মহূর্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে সবচেয়ে অত্যাধুনিক ট্যাঙ্ক হিসাবে রয়েছে টি-৯০ ভীষ্ম। তবে সোভিয়েত টি-৭২ অজেয়র রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে ভারতের এই মহূর্তে বড় সংখ্যায় ট্যাঙ্ক লাগবে। টি-১৪ ছাড়াও ভারতের কাছে দক্ষিন কোরিয়ার কে-২ ব্ল্যাক প্যান্থার কেনার সুযোগও রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *