অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ভারতের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল!
৭৫ তম প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে গোটা দেশ সেজে উঠেছে। প্রতিবছর এই ২৬ জানুয়ারি দিনটি আমরা মহাগৌরবে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে পালন করি কারন এই দিনই ১৯৫০ সালে ভারতে প্রথম সংবিধান গৃহিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দীর্ঘ আন্দোলনের পর ব্রিটিশ শাসন মুক্ত স্বাধীন ভারতবর্ষের যাত্রা শুরু হয়। এরপরেই ডঃ বি আর আম্বেদকরের নেতৃত্বে ভারতীয় সংবিধান রচনার কাজ শুরু হয়। দুই বছর পর ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধান গৃহিত হয় এবং দুইদিন পর ২৬ জানুয়ারি সংবিধান কার্যকর কর। সেই থেকে ২৬ জানুয়ারি প্রতিবছর ভারতে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে পালন করা হয়। কিন্তু ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ আইন ছুঁড়ে ফেলে একটি সার্বভৌম, গনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র দেশ হিসাবে ভারতবর্ষের যে যাত্রা শুরু হয় তার পটভূমি ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারিই শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস পূর্ন স্বরাজের ঘোষনা করে। সেই কারনে ২৬ জানুয়ারি সেসময় গোটা ভারতবর্ষে স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালন করা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দুইশো বছরের ইংরেজ শাসনের অবসানের পর ভারতবর্ষ স্বাধীন হয় বলে ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালন করা হয় কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা দিবস ১৯৩০ সাল থেকে ২৬ জানুয়ারিই ঘোষনা করা হয়েছিল তৎকালীন ভারতবর্ষে। তবে ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি পূর্ন স্বরাজের ঘোষনা করবার আগে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে একাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে যা ভারতবর্ষের মানুষকে আরও ব্রিটিশ বিরোধী করে তুলেছিল।
১৮৮৬ সালের কলকাতা অধিবেশনে দাদাভাই নৌরাজি প্রথম স্বরাজের কথা তোলে কিন্ত তার বক্তব্য ছিল কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতোন ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে থেকেই স্বায়ত্তশাসনের। কিন্ত ১৯০৭ সাল থেকে বন্দেমাতরম পত্রিকার সম্পাদক শ্রীঅরবিন্দ লিখতে শুরু করেন ভারতের জাতীয়তাবাদীদের নতুন প্রজন্ম ব্রিটেনে যেমন পূর্ন স্বাধীনতা আছে ঠিক তেমনি পূর্ন স্বরাজ চায় ভারতের জন্যও। শ্রীঅরবিন্দের এই লেখায় জাতীয়তাবাদীদের উদ্ভুদ্ধ করে তোলে বালগঙ্গাধর তিলক। তবে সেসময় ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো পূর্ন স্বরাজের পক্ষে ছিলনা, সবাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থেকে আংশিক স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন চাইছিলো।
যেমন দি অল ইন্ডিয়া হোমরুল লীগ দল অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিন আফ্রিকা, আয়ারল্যান্ডের কিছু প্রদেশের মতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে থেকেই ভারতের স্বায়ত্তশাসন চাইছিলো। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগও স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ছিল তারা ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলনা। ইন্ডিয়ান লিবারেল দল ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলের মধ্যে সবচেয়ে ব্রিটিশ পন্থী দল ছিল, লিবারেল দল ভারতের স্বাধীনতার পক্ষেত ছিলই না এমনকী তারা ভারতের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষেও ছিলনা, তাদের ধারনা ছিল স্বায়ত্তশাসন চাইলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে ভারতের সংযোগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেসময় ভারতের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কংগ্রেস নেতা হসরত মোহানি প্রথম ব্যক্তি যিনি সম্পূর্ন স্বাধীনতা বা পূর্ন স্বরাজের দাবী করেন ১৯৩০ সাল থেকে। বিহারের গুরুত্বপূর্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি মাগফুর আহমেদ আজাজি হসরত মোহানির এই পূর্ন স্বরাজের দাবীকে সমর্থন করেন। বালগঙ্গাধর তিলক, শ্রীঅরবিন্দ, বিপিন চন্দ্র পালের মতো বিখ্যাত কংগ্রেস নেতারাও পূর্ন স্বরাজের দাবী করেছিলেন। ১৯১৯ সালে ব্রিটেন ভারতে মন্টেগু চেমসফোর্ড আইন চালু করে সারা ভারতবর্ষে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে রাওলাট আইনের প্রতিবাদের সময় জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে নিরস্ত্র ভারতীয়দের উপর গুলি চালায় যাতে ৩৭৯ জন মানুষের মৃত্যু হয়, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী জনরোষ বৃদ্ধি পায়।
এই ঘটনার পর ১৯২০ সালে স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেসও স্বরাজের পক্ষে সায় দেন। গান্ধীজি ঘোষনা করেছিলেন স্বরাজ ভারতীয়দের মৌলিক অধিকার। ১৯২০ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে গান্ধিজী রাওলাট আইনের বিরোধীতা করে আইন অমান্য আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন। মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনকে সংশোধনের জন্য ব্রিটিশ সংসদ ১৯২৭ সালে স্যার জন সাইমনের নেতৃত্বে সাতজন সদস্য বিশিষ্ট একটি দল গঠন করে যার নাম দেওয়া হয় সাইমন কমিশন। কিন্তু এই দলে কোনও ভারতীয় না থাকায় গোটা ভারতবর্ষে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। সাইমন কমিশন যখন ভারতে আসে তখন লাহোরে বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে বহু মানুষ সাইমন ফিরে যাও স্লোগান দিতে থাকে। সেই সময় মাথায় ব্রিটিশ পুলিশের লাঠির আঘাতে মৃত্যু হয় লালা লাজপত রায়ের যা ভারতবর্ষের মানুষদের মনে ব্রিটিশদের প্রতি আরও বেশী ক্ষোভ সৃষ্টি করে। সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের মোতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে নেহেরু কমিশন গঠন করা হয় যার সদস্য ছিল জওহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের মতোন ব্যক্তি। এই নেহেরু কমিটি ভারতের জন্য স্বায়ত্তশাসন চেয়ে ১৯২৮ সালে একটি রিপোর্ট তৈরি করে যার নাম হয় নেহেরু রিপোর্ট।
ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই নেহেরু রিপোর্ট সমর্থন করলেও অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ও ভারতের লিবারেল দল এই নেহেরু রিপোর্টের বিরোধীতা করে। ব্রিটিশরাও নেহেরু রিপোর্টকে অস্বীকার করে। কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও এই এই নেহেরু রিপোর্টকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। জওহারলাল নেহেরু, সুভাসচন্দ্র বোসের মতোন কিছু নেতা চাইছিলো পূর্ন স্বাধীনতা কিন্ত কংগ্রেসের কিছু নেতা চাইছিলো স্বয়াত্তশাসন। এরকম পরিস্থিতিতে ১৯২৯ সালের ৩১ অক্টোবর ভারতের ভাইসরয় লর্ড আরউইন লন্ডনে মহাত্মা গান্ধী, মোতিলাল নেহেরু ও মহম্মদ আলি জিন্নাহের সাথে গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করে কিন্তু এই বৈঠক ব্যার্থ হয়। এরপর ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে লাহোর অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশদের ভারতকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার জন্য দুই বছরের সময় দেয়, পরে এইসময় কমিয়ে এক বছর করা হয়। এই অধিবেশন লাহোরেই করা হয়েছিল কারন লাহোরেই সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বীরগতিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন লালা লাজপত রায়, তাই তার সম্মানে লাহোর অধিবেশন করা হয়।
জওহরলাল নেহেরু গান্ধীজির প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন। এখানে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের কমিটির বৈঠকে ১১৮ ও ৪৫টি ভোট পরেছিল, ৪৫টি ভোট হয়েছিল ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে সম্পূর্ন মুক্ত করার জন্য এবং ১১৮টি ভোট হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ভারতের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। কিন্তু ব্রিটিশ ভাইসরয় ভারতের সায়ত্তশাসন কিংবা নেহেরু রিপোর্ট কোনওটাই না মেনে নেওয়ায় তিনদিন ধরে চলা ওই লাহোর অধিবেশনেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পূর্ন স্বরাজের। জওহারলাল নেহরুকে লাহোর অধিবেশনে সভাপতি করা হয়েছিল। এবার সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ সহ কংগ্রেসের সবনেতাই পূর্ন স্বরাজের পক্ষে সম্মতি দেয়।
১৯২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে অর্থাৎ লাহোর অধিবেশনের শেষদিনে লাহোরের রাভি নদীর তীরে জওহরলাল নেহেরু সহ কিছু তরুন কংগ্রেস নেতা পূর্ন স্বরাজের দাবীতে ভারতের তিরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করে। জাতীয় কংগ্রেস ঠিক করে ১৯৩০ সালের জানুয়ারী মাসের শেষ রবিবার দিল্লিতে সরকারি ভাবে ভারতের স্বাধীনতার ঘোষনা করবে। ১৯৪০ সালের জানুয়ারী মাসের শেষ রবিবার তারিখটা ছিল ২৬ জানুয়ারী যেদিন পূর্ন স্বরাজের ঘোষনা করা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত সতেরো বছর ধরে ২৬ জানুয়ারী দিনটি পূর্ন স্বরাজ দিবস হিসাবে পালিত হয়ে এসেছে। মহাত্মা গান্ধী সহ অন্যান্য কংগ্রেস নেতারা ঠিক করে পুরো দেশব্যাপী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অহিংস আন্দোলনের সূচনা করবে। ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ মহাত্মা গান্ধী সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা করেন যা গোটা দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন সৃষ্টি করে। শেষপর্যন্ত ২০০ বছরের ব্রিটিশদের অত্যাচার ও ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ পূর্ন স্বাধীনতা পায়। তবে ভারতকে স্বাধীনতা দেবার সময়েও ব্রিটিশরা তাদের ঔদ্ধত্য দেখানের চেষ্টা করেছিল। ১৫ আগস্ট দিনটাই ব্রিটিশরা ভারতের স্বাধীনতার জন্য বেছে নিয়েছিল কারন এর দুইবছর আগে অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান আত্মসমর্পন করেছিল মিত্রশক্তির কাছে যারমাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। সেসময় মিত্রশক্তিতে ব্রিটেনও ছিল। তাই ব্রিটেন ১৫ আগস্ট ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের ঔদ্ধত্য দেখাতে চেয়েছিল। স্বাধীনতার পরেও ২৬ জানুয়ারী দিনটিকে স্মরনীয় রাখবার জন্য তৎকালীন ভারত সরকার ২৬ জানুয়ারী, ১৯৫০ সালে ভারতীয় সংবিধান কার্যকর করেন। সংবিধান লেখার কাজ ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বরই শেষ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু ২৬ জানুয়ারী দিনটা যাতে প্রত্যেক ভারতবাসী স্মরন করতে পারে সেকারনে ২৬ জানুয়ারী সংবিধান সরকারি ভাবে কার্যকর করা হয় এবং দিনটি প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে ঘোষনা করা হয়।