অফবিট

এই প্রযুক্তি রাশিয়া আর ভারত ছাড়া বিশ্বের কোনও দেশের কাছে নেই

ভারতের ৬৫ শতাংশ শক্তির চাহিদা কয়লা থেকে পূরন করা হয়। মাত্র ২ শতাংশ শক্তি পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া কারন ভারতে ইউরেনিয়াম খুব কম পরিমানেই পাওয়া যায়। তবে ইউরেনিয়ামের বিকল্প হিসাবে থোরিয়াম থেকেও পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এতদিন পর্যন্ত থোরিয়ামকে ভারত ব্যবহার করেনি পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। তবে এবার পরিস্থিতি পাল্টেছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশী থোরিয়াম মজুত রয়েছে ভারতের কাছেই। ভারতের কাছে প্রায় ৯,৬৩,০০০ টন থোরিয়াম রয়েছে, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আমেরিকা যাদের কাছে ৪,৪০,০০০ টন থোরিয়াম রয়েছে। ভারতের পূর্ব উপকূলের রাজ্যগুলোতে থোরিয়াম সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায়। 

২০১২ সালের তথ্য অনুযায়ী অন্ধ্রপ্রদেশে ৩৫ শতাংশ, ১৫-২০ শতাংশ তামিলনাড়ু, ওড়িশা, ১০-১৫ শতাংশ কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারে ৫ শতাংশ থোরিয়াম পাওয়া যায়। ভারত এতদিনে থোরিয়ামের সঠিক ব্যবহার শুরু করেছে। ১৯৬৯ সালে পরমানু পোগ্রাম শুরু করার ৫৫ সাল পরে ভারত পরমানু পোগ্রামের দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করেছে। গত ৪ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র তামিলনাড়ুর কালপাক্কামে পরমানু কেন্দ্রে ভারতের নিজস্ব তৈরি প্রথম ফাস্ট ব্রিডার চুল্লির উদ্ভোদন করেছেন। কালপাক্কামের এই পরমানু কেন্দ্রকে মাদ্রাজ অ্যাটমিক পাওয়ার স্টেশনও বলা হয়। এই পরমানু চুল্লিকে ব্রিডার বলা হয় কারন এই ধরনের চুল্লি চালাতে যে পরিমান শক্তি খরচ হয় তার থেকে বেশী পরমানু জ্বালানি উৎপন্ন হয়।

কালপাক্কামের পরমানু কেন্দ্রতে শুরু হওয়া এই ফাস্ট ব্রিডার পরমানু চুল্লিকে ভারতের পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক বলা হচ্ছে। ১৯৬৯ সালে ভারতে যখন প্রথম পরমানু গোগ্রাম শুরু হয় তখন তিন ধাপে পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। প্রথম ধাপ ১৯৬৯ সালেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, দ্বিতীয় ধাপ শুরু করতে ৫৫ বছর সময় লেগে গেল। প্রথম ধাপে হেভি ওয়াটার রিয়্যাক্টার বা ভারী জল উচ্চচাপে এই ধরনের চুল্লিতে ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের চুল্লিতে জ্বালানি হিসাবে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম ২৩৮ ব্যবহার করা হয়। প্রথম ধাপের পরমানু চুল্লি থেকে প্লুটোনিয়াম ২৩৯ তৈরি হয়। এই ধরনের চুল্লিতে সমস্যা হচ্ছে ইউরেনিয়াম ভারতে যথেষ্ট পরিমানে পাওয়া যায়না এবং প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম যথেষ্ট পরিমান শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম নয়। পরমানু পোগ্রামের দ্বিতীয় ধাপে পরমানু চুল্লিতে প্লুটোনিয়ামের সাথে কিছু ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ভারতের কাছে বিশ্বের ২৫ শতাংশ থোরিয়াম থাকায় ভারত দ্বিতীয় ধাপে ভারতের কোনও সমস্যা হবেনা। দ্বিতীয় ধাপে প্লুটোনিয়াম ২৩৯, ইউরেনিয়াম ২৩৮ এবং থোরিয়ামের মিশ্রনে ইউরেনিয়াম ২৩৩ উৎপন্ন হবে। 

তৃতীয় ধাপে ইউরেনিয়াম ২৩৩কে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হবে যাতে প্রচুর শক্তি উৎপাদন হবে। পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদনের তিনটি ধাপের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন এই দ্বিতীয় ধাপ। এবার ভারত দ্বিতীয় ধাপের পক্রিয়াও শুরু করে দিয়েছে অর্থাৎ ইউরেনিয়াম ২৩৩ উৎপন্ন হলে আমরা আরও বেশী শক্তি উৎপাদন করতে পারবো। ভারতের পরমানু পোগ্রাম শুরু করেছিলেন হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা ১৯৫০ এর দশকে। কিন্তু ভারতের প্রথম ধাপের পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬৯ সালে। মহারাষ্ট্রের তারাপুরে ১৯৬৯ সালে ৪০ মেগাওয়াট পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়। 

১৯৮০ সালের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ২০০৩ সালে ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জি বা ডিএই দ্বিতীয় ধাপের পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির জন্য ভাবিনি বা ভারতীয় নাভিক্কিয়া বিদ্যুৎ নিগম লিমিটেড নামে একটি সংস্থা তৈরি করে। প্রথম ধাপ থেকে দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছাতে ভারতের ১৯৬৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫৫ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায় কারন ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। ১৯৭৭ সালে ভারত দ্বিতীয় ধাপের পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্ত রাজস্থানের পোখরানে ভারত পরমানু বোম্ব পরীক্ষা করে যাকে অপারেশন স্মাইলিং বুদ্ধা বলা হয়। এরজন্য আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলো ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল এবং ভারতকে ইউরেনিয়াম সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর ২০০৩ সালে যখন ভারত পুনরায় দ্বিতীয় ধাপের পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির চেষ্টা শুরু করে তখন আরও একটি সমস্যা দেখা দেয় তাহল আগে থেকে যাদের দ্বিতীয় ধাপের জন্য প্রশিক্ষন দেওয়া হয়েছিল তারা ইতিমধ্যেই অবসরে চলে যায়। যার জন্য দ্বিতীয় ধাপ ২০০৩ সালে শুরু করবার কথা থাকলেও তা শুরু হতে এত সময় লাগলো। দ্বিতীয় ধাপের এই পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত পরমানু চুল্লিতে নিউট্রনকে ধীর গতির করার প্রয়োজন নেই যাতে খরচ অনেকটা কমে যায়। দ্বিতীয়ত যেহেতু প্রথম ধাপে উৎপন্ন প্লুটোনিয়াম ২৩৯ কে ই জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত করা হয় দ্বিতীয় ধাপে এবং এই ধাপে উৎপন্ন ইউরেমিয়াম ২৩৩কে তৃতীয় ধাপের জন্য জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হবে সেজন্য এই ধাপে পরমানু অবশেষের পরিমান খুবই কম থাকবে। কালপাক্কামে যে পরমানু চুল্লি তৈরি করা হয়েছে সেটি ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম। ২০১৯ সালেই ডিএই চারটি ফাস্ট ব্রিডার পরমানু চুল্লি তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় যার প্রত্যেকটি ৬০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম। ডিএই দুটি ফাস্ট ব্রিডার চুল্লি কালপাক্কামে এবং বাকী দুটি চুল্লি ২০২৫ সালে অন্য কোথাও তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাশিয়ার পর ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ যাদের কাছে দ্বিতীয় ধাপের পরমানু চুল্লি রয়েছে। এই জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভারতের এই ফাস্ট ব্রিডার পরমানু চুল্লি নির্মান খুব গুরুত্বপূর্ন। বিশ্বে সবচেয়ে আধুনিক পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রযুক্তির দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও এই ফাস্ট ব্রিডার প্রযুক্তি নেই। 

আমেরিকা মূলত দুই পদ্ধতিতে পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। প্রথমত হালকা জল নির্ভর পরমানু চুল্লি, এই পদ্ধতির ব্যবহার বিগত ষাট বছর ধরে আমেরিকা করে আসছে এবং দ্বিতীয়ত ছোট ছোট পরমানু চুল্লি নির্মান পদ্ধতি। পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আরও একটি শীর্ষস্থানীয় দেশ জার্মানির কাছেও ভারতের মতো আধুনিক প্রযুক্তি নেই। তবে জার্মানি বর্তমানে পরমানু চুল্লি নির্মান বন্ধ করে দিয়েছে এবং গ্যাস পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। তবে জার্মানি যতদিন পরমানু চুল্লি নির্মান করেছিল তাদের কাছেও ভারতের মতো প্রযুক্তি ছিলনা। ভারতের তৈরি এই নতুন ফাস্ট ব্রিডার চুল্লিতে সরাসরি ইউরেনিয়ামের পরিমান খুবই কম লাগবে বরং থোরিয়াম বেশী ব্যবহৃত হবে। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং এই থোরিয়াম নির্ভর পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আধুনিক ভারতের শক্তি চাহিদা পূরনে সক্ষম হবে যার ফলে ভারতের জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমবে এবং ভারত খুব সহজেই তার শূন্য কার্বন নির্গমনের লক্ষ্যমাত্রাকে পূরন করতে পারবে। থোরিয়াম নির্ভর পরমানু চুল্লি নির্মানের কারনে ভারতের এনএসজিতে সদস্য হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও কম হবে। নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার গ্রুপ বা এনএসজির সদস্যপদ পাওয়ার জন্য ভারত বহুদিন ধরেই চেষ্টা করছে কিন্তু প্রতিবার চীনের বাধার কারনে ভারতের আবেদন গ্রাহ্য হচ্ছেনা। ভারত এনপিটিতে স্বাক্ষর করেনি এই অভিযোগে বারবার ভারতের আবেদন খারিজ করে দেয়। ১৯৬৮ সালে এনপিটি বা নন প্রলিফারেশন অফ নিউক্লিয়ার ওয়েপনস চুক্তি তৈরি করা হয়। ১৯৭০ সাল থেকে এই চুক্তি কার্যকর করা হয়। এখনও পর্যন্ত বিশ্বের ১৯০টি দেশ এই চুক্তিতে সই করেছে। এই চুক্তিতে সই করা দেশ কখনও পরমানু অস্ত্র তৈরি করতে পারবেনা, এর বদলে তারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলো থেকে পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রযুক্তি পায়। ভারত এই চুক্তিতে সই করেনি কারন ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রুদেশ পাকিস্তানও এই চুক্তিতে সই করেনি। ভারত, পাকিস্তান ছাড়াও ইসরায়েল, দক্ষিন সুদান ও উত্তর কোরিয়া এই এনপিটিতে সই করেনি। এর জন্য চীন বারবার ভারতের এনএসজিতে সদস্য পদের আবেদনে ভেটো প্রয়োগ করে।

এই সংগঠনের সদস্য দেশ গুলো নিজেদের মধ্যে আধুনিক পরমানু প্রযুক্তি বিনিময় করতে পারে। কিন্ত ভারত নিজেই বর্তমানে থোরিয়াম নির্ভর ফাস্ট ব্রিডার তৈরি করে ফেলায় এনএসজির সদস্য হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই কমে গেছে। এছাড়া ফাস্ট ব্রিডার প্রযুক্তির কারনে ভারত বিদেশ থেকে ইউরেনিয়াম কেনার পরিমানও কমিয়ে দেবে কারন কিছু পরিমান ইউরেনিয়াম ভারতেও পাওয়া যায়। ভারত বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, কাজাখিস্তান, কানাডা, ফ্রান্স, উজবেকিস্তান ও রাশিয়া থেকে ইউরেনিয়াম আমদানি করে যাতে মোটা অর্থ খরচ হয় কিন্তু থোরিয়াম ব্যবহার করার কারনে ভারতের বৈদেশিক সঞ্চয় কিছুটা হলেও বাড়বে। ডঃ হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা আজ থেকে সত্তর বছর আগেই ভেবে নিয়েছিলেন ভারত পারমানবিক শক্তি উৎপাদন করতে পারলে ভারত শক্তির ব্যবহারে স্বনির্ভর হতে পারবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *