অফবিট

মোসাদের যে দুর্ধর্ষ এজেন্ট সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হতে পারতেন

১৮ মে, ১৯৬৫ দিনটিকে কোন ইসরায়েলি নাগরিক ভুলতে পারবেনা। এই দিন এমন একটি ঘটনা ঘটে যা প্রত্যেক ইসরায়েলি মনে রাখে। এই দিনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এলি কোহেন নামে একটি ব্যক্তিকে যিনি তাদের কাজের মাধ্যমে ইসরায়েলের ইতিহাসে চির কালের জন্য অমর হয়ে গেছেন। এলি কোহেন ইসরায়েলের পরম শত্রু সিরিয়ায় ঢুকে অপারেশন করেছিল যার জন্য ইসরায়েলকে পরাস্ত করতে পারেনি সিরিয়া।

১৯২৪ সালে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে জন্ম হয় এলি কোহেনের, তাঁর বাবা একজন ইহুদি এবং মা একজন সিরিয়ান ছিলেন। ছোট থেকের অসাধারন মেধার অধিকারী ছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল গঠন হয় তখন এলি কোহেনের বাবা মা মিশর ছেড়ে ইসরায়েল চলে আসেন কিন্তু ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষার জন্য এলি কোহেন মিশরেই থেকে যায়৷ যুবক অবস্থা থেকেই মিশরে ইহুদিদের অধিকারের জন্য গোপনে কাজ করতে থাকে এলি কোহেন। ইসরায়েল গঠনের পর থেকেই মিশরে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়তে থাকে যা ১৯৫৬ সালে তীব্র আকার ধারন করে। বাধ্য হয়ে মিশর থেকে সমস্ত ইহুদিরা ইসরায়েল চলে আসে। ১৯৫৭ সালে এলি কোহেনও মিশর ছেড়ে ইসরায়েল চলে আসে এবং ইরাকি ইহুদি নাদিয়াকে বিয়ে করে। ১৯৫৭ সালেই এলি কোহেন ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে কাউন্টার টেররিজম অ্যানালিসিস এর কাজ পায় কিন্তু এই কাজে বিরক্ত হয়ে যায় সে যার কারনে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদে যোগ দেবার আবদেন করে এলি কোহেন কিন্তু মোসাদ তার আবেদন বাতিল করে দেয়। 

১৯৬০ সালে মোসাদ এমন একজন এজেন্ট খুঁজছিল যে সিরিয়ায় ঢুকে তাদের হয়ে কাজ করতে পারে তখন মোসাদের নজর পড়ে এলি কোহেনের উপর। মা সিরিয়ান হওয়ায় এলি কোহেন আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিল, তা ছাড়া ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ ভাষায়ও প্রবল দক্ষ ছিল সে যার কারনে মোসাদের লিস্টে এই সিরিয়ায় অপারেশনের জন্য একদম সঠিক ছিল সে। কয়েক মাস নজর রাখার পর এলি কোহেনকে মোসাদ প্রস্তাব পাঠায় তাদের হয়ে কাজ করার জন্য। প্রথম কয়েক মাসে এলি কোহেনের প্রশিক্ষন হয় ইসরায়েলের রাজধানী তেল আভিবে৷ সেখানে প্রথমে একটি ঘরে টেবিলের সামনে তার চোখ বন্ধ করে দেওয়া হত এবং জিজ্ঞেস করা হত টেবিলে, ঘরে কি কি জিনিস আছে? এভাবে তার স্মরন শক্তির পরীক্ষা হত। এভাবে ধীরে ধীরে কেউ তাকে অনুসরন করছে কীনা, টার্গেটকে কিভাবে শেষ করতে হয়, বিভিন্ন যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্কের নাম, রেডিও ট্রান্সমিটার, কিভাবে গোপনে ইসরায়েলে মেসেজ পাঠানো যায় তার কোড শেখানো হয় তাকে। এছাড়াও পরিপূর্ন ইসলামিক শিক্ষা দেওয়া হয় তাকে যাতে একজন সাধারন সিরিয়ান নাগরিক মনে হয় তাকে। প্রশিক্ষন শেষে এলি কোহেনকে জানানো হয় তাকে সিরিয়া যেতে হবে এবং সেখানে তাকে ইসরায়েলের হয়ে কাজ করতে হবে। প্রশিক্ষন শেষে একটি নতুন নাম ও পরিচয় দেওয়া হয় তাকে কমল আমিন তাবেত। 

ফেব্রুয়ারী, ১৯৬১ তে এলি কোহেনকে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরাসে পাঠানো হয়। সেখানে তার পরিচয় হয় একজন ধনী পোষাক বিক্রেতা। বুয়েনস আইরাসে আরব বিশ্বের একাধিক উচ্চ পদস্থ ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ হয় তার। এলি কোহেন বুয়েনস আইরাসে সিরিয়ান বাথ দলের প্রতিনিধিকে জানায় সে বাথ দলকে অর্থ সহায়তা করবে। সিরিয়ান বাথ দল ১৯৬১ সালে সিরিয়ায় অবৈধ ছিল কিন্তু ১৯৬৩ সালে এই দলই ক্ষমতা দখল করে। আর্জেন্টিনাতেই এলি কোহেনের সাথে বন্ধুত্ব সিরিয়ার সেনাবাহিনীর জেনারেল আমিম আল হাফেজের সাথে যে পরে সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি হয়। এলি কোহেন বুয়েনস আইরাসে দামী দামী অনুষ্ঠান করত এবং আরব বিশ্বের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের আমন্ত্রন করত, উপহার দিত এভাবে আরব রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। 

১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারীতে সিরিয়ার দামাস্কাসে আসে এলি কোহেন এবং সিরিয়ার একটি অভিজাত এলাকায় ঘর ভাড়া নেয়। এলি কোহেনকে সিরিয়ায় আসতে সুপারিশ করে বুয়েনস আইরাসের আরব প্রভাবশালী ব্যাক্তিরা। বুয়েনস আইরাসের মতোন দামাস্কাসেও দামী দামী অনুষ্ঠান করতে থাকে এলি কোহেন এবং সেখানেও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনেতাদের সাথে বন্ধুত্ব হয় তার। ১৯৬৩ সালের ৮ মার্চ সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তন হয় এবং নতুন সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে এলি কোহেনের বন্ধু ছিল অনেক। এমনকি সিরিয়ার নতুন রাষ্ট্রপতি আমিম আল হাফেজের সাথে বুয়েনস আইরাস থেকেই বন্ধুত্ব ছিল এলি কোহেনের। যার ফলে খুব সহজেই সিরিয়ান সেনাবাহিনী, প্রতিরক্ষা, অস্ত্রের খবর গোপনে মোসাদকে পাঠাতে থাকে এলি কোহেন। বলা হয় এলি কোহেনের প্রভাব সিরিয়ার রাজনৈতিক মহলে এতটাই ছিল যে তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নিযুক্ত করবার পরিকল্পনাও চলছিলো। সিরিয়ার সামরিক জেনারেলের সাথে এলি কোহেন গোলান হাইটস পর্যন্ত দেখতে যায়। গোলান হাইটস সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি বিতর্কিত এলাকা যা দুই দেশই দাবী করতো। এরকম বিতর্কিত এলাকায় সিরিয়ার সামরিক কর্মকর্তা এবং প্রথম সারির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছাড়া কাউকে যেতে দেওয়া হতনা কিন্তু এলি কোহেনের প্রভাব এতটাই ছিল যে তাকে সেখানে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। 

গোলান হাইটসে ইসরায়েলের দিকে এলি কোহেন ইউক্যালিপটাস গাছ লাগাতে অনুরোধ করে সিরিয়ান সেনাবাহিনীকে সেনাদের বিশ্রামের জন্য, এর পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল যতটা সম্ভব ইসরায়েল সীমান্তের দিকে দৃষ্টি অবরুদ্ধ করা যায়। সিরিয়ায় থাকাকালীনই গোপন ভাবে মাঝে মাঝে ইসরায়েল এসে মোসাদের বৈঠকে অংশ নিত এলি কোহেন। এরই মধ্যে সিরিয়া ১৯৬৪ সালের ১৩ নভেম্বর ইসরায়েলে আক্রমন করে কিন্তু এই আক্রমনের খবর ইসরায়েল এলি কোহেনের মাধ্যমে আগেই জানতো যার কারনে ইসরায়েল প্রস্তত ছিল। 

সিরিয়ার আক্রমন ব্যর্থ হওয়ার পর সিরিয়ান সরকার বুঝতে পারে তাদের গোপন তথ্য বাইরে যাচ্ছে যার কারনে সিরিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সাহায্য চায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের গুপ্তচর সংস্থা কেজিবির এজেন্টদের সিরিয়া পাঠায়। কেজিবির কাছে আধুনিক প্রযুক্তি ছিল, কেজিবি বুঝতে পারে রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে মেসেজ যাচ্ছে ইসরায়েলে। কেজিবি একটি বিশেষ ডিভাইস ব্যবহার করে যা দিয়ে কোথা থেকে রেডিও সিগন্যাল যাচ্ছে তা বোঝা যায়৷ সিরিয়ার সরকারের কেজিবিকে নিযুক্ত করার ঘটনা এতটাই গোপনীয় ছিল যে এলি কোহেন পর্যন্ত  জানতে পারেনি। 

১৯৬৫ সালের ৭ জানুয়ারি সিরিয়ায় রেডিও ট্রান্সমিশন বন্ধ করে দেয় কেজিবি যা জনত না এলি কোহেন। অন্যান্য দিনের মতোন সেদিনও ইসরায়েলে রেডিওর মাধ্যমে বার্তা পাঠায় এলি কোহেন। সাথে সাথে কেজিবির এজেন্টরা সেই রেডিও সিগন্যালের রেঞ্জ অনুসরন করে দেখে ওই এলাকায় এলি কোহেনের ঘর রয়েছে৷ সিরিয়ার সামরিক কর্মকর্তারা বিশ্বাসই করতে পারছিলোনা যে তাদের রাষ্ট্রপতির বন্ধু এবং ভবিষ্যতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এরকম কাজ করে। কিন্তু সেদিন আবারও একবার এলি কোহেন ইসরায়েলে বার্তা পাঠায়, যার পর এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে এলি কোহেনই ইসরায়েলের গুপ্তচর। 

৮ ফেব্রুয়ারী সকালে রেডিও ট্রান্সমিশনের সময় সিরিয়ার মিলিটারি গ্রেফতার করে এলি কোহনকে। একমাস ধরে বিচারের পর ৩১ মার্চ তাকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়। ইসরায়েলের বিদেশমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার দামেস্কাসের সাথে কথা বলেছিল, এমনকী ফ্রান্স, কানাডা ও বেলজিয়ামের সরকার পর্যন্ত সিরিয়ান সরকারের সাথে কথা বলেছিল এলি কোহেনের মৃত্যুদন্ড রোধের জন্য কিন্তু সিরিয়ান সরকার কোন কথা না শুনেই ১৮ মার্চ, ১৯৬৫ সালে মারজেহ স্কোয়্যারে ফাঁসি দেয় এলি কোহেনকে। সিরিয়া ইসরায়েলকে এলি কোহেনের মৃতদেহ পর্যন্ত ফেরত দেয়নি। বলা হয় ২০১৮ সালে এলি কোহেনের ঘড়ি তার পরিবারকে দেওয়া হয়। 

১৯৬৭ সালে আরব ইসরায়েলের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল সিরিয়াকে পরাজিত করেছিল, যখনই ইসরায়েল সিরিয়ার যুদ্ধ হয়েছে প্রতিবার সিরিয়াকে লজ্জাজনক পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। মোসাদের জন্য সিরিয়া আজও পরমানু সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। এলি কোহেনের নাম ও দেশের জন্য তাঁর আত্মত্যাগ ইসরায়েলের ইতিহাসে সর্নাক্ষরে লেখা থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *