অফবিট

ইংল্যান্ডে স্বামীরা কেন তাদের স্ত্রীদের নিলামে তুলতেন?

আজকের দিনে অর্থাৎ সভ্য সমাজে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ভালো না থাকলে তারা বিবাহ বিচ্ছেদ করে আলাদা থাকেন। কিন্তু বহু পূর্বে অর্থাৎ মধ্যযুগে ইউরোপে ছিল এক আজব নিয়ম। যে স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের আর পছন্দ করতেন না তারা সম্পর্ক বিচ্ছেদের বদলে স্ত্রীদের নিলামে তুলতেন। মূলত নিলামে ওঠা মহিলাদের সঙ্গে এক প্রকার পোষ্যদের মতই আচরণ করা হত। তাহলে একটু খোলসা করে বলা যাক এই নিয়মটা কি ছিল এবং কেন প্রচলিত হয়েছিল!

আনুমানিক ১৬ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত অর্থাৎ মধ্যযুগ ও রাণী ভিক্টোরিয়ার যুগে স্ত্রীকে নিলামে বিক্রি করার প্রচলন ছিল। অনেকেই মনে করতেন অ্যাংলো-স্যাক্সনের সময়কাল থেকেই এই প্রথার প্রচলন ঘটেছিল। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলগুলিতে বিংশ শতাব্দীর পর্যন্ত এই প্রচলনের অস্তিত্ব দেখা গিয়েছিল। এই পদ্ধতির মাধ্যমে স্ত্রীদের বিক্রি করা হত সরাইখানা,বাজার কিংবা কোন মেলাতে। তবে বিক্রি করার আগে প্রথমেই মহিলাদেরকে পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত করতে হত, এরপর তাদের গলায় কিংবা কোমরের দড়ি বেঁধে তাদের স্বামীরা বাজারে নিয়ে যেতেন বিক্রি করার জন্য। তবে অনেক জায়গায় দেখা গিয়েছিল যে নিলামকারীও উপস্থিত থাকত এই নিলামে।

এই নিলাম প্রক্রিয়ায় বেশি গুরুত্ব থাকতো সাক্ষীদের। এছাড়াও নিলাম শুরু হওয়ার আগে ঢোল পিটিয়ে গোটা শহরকে জানানো হত। এরপরই স্থানীয় বাসিন্দাদের ভিড় জমতো নিলামে। কোন কোন সময়ে নিলামে ওঠা মহিলাদের পরিবারের সদস্যরাও থাকত ওই ভিড়ে। নিলামে ওঠা স্ত্রীদের গুণাবলী গাইতেন স্বামীরা। এরপরই কোন ধনী ব্যক্তি কিংবা দালাল ও ব্যবসায়ীর পছন্দ হয়ে গেলে তারা মোটা দামে মহিলাদের কিনে নিতেন। এরপরে তারাও বিক্রি করে দিতেন যৌন দাসী হিসাবে।

এই পদ্ধতির মাধ্যমে মনে করা হত যে একবার কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে নিলামে তুলে দিলে এবং সেই স্ত্রী নিলামে বিক্রি হয়ে গেলে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আর কোন সম্পর্ক থাকে না, এবং সেই বিবাহকেও গণ্য করা হয় না। প্রতিটা নিলামের পর  একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠত যে স্ত্রীদের উপর স্বামীদের আর কোন অধিকার থাকবে না এবং স্বামীরা চাইলে নতুন করে বিবাহ করতে পারবে। স্ত্রীদের নিলামে বিক্রি করার অর্থ ধার্য হত ২/১ শত পাউন্ড।

এবার আসা যাক কি কারনে স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের নিলামে তুলতেন?

প্রথমত যেসব স্ত্রীরা তার স্বামীর সঙ্গে প্রতারণা করতেন তাদেরই নিলামে তোলা হত। অর্থাৎ কোন স্ত্রী যদি তার স্বামী থাকা সত্বেও অন্য পুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখতেন এমনকি পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ করতেন তাহলে তাদের স্বামীরা স্ত্রীদের উপযুক্ত শাস্তি স্বরূপ কোমরে দড়ি বেঁধে নিলামে তুলতেন। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরকম নিলাম হলে মহিলাদের প্রেমিকেরাই তাদের অর্থের বিনিময়ে কিনে নিতেন। 

আর দ্বিতীয় কারণটি ছিল সাংসারিক মনোমালিন্য। দীর্ঘ সাংসারিক জীবনে যখন স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠত এবং হাঁপিয়ে উঠতো সংসারের বোঝা টানতে টানতে তখন তারা এই সংসার থেকে নিস্তার পেতেই নিজেরাই তাদের স্বামীদের প্রস্তাব দিতেন যে নিলামে তোলার। এমন অনেক মহিলাই ছিল যাদের কোনো প্রেমিক ছিলনা অর্থাৎ তাদের নিলামে তুললে কোন ধনী ব্যবসায়ী মোটা অর্থের বিনিময় তাদের কিনে নিতেন এবং তাদের পরবর্তী জীবন হত অন্যের শয্যাসঙ্গিনী। যেহেতু সে সময় স্বামীদের অর্থের কোন ভাগ দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না তাই নিলামে উঠার পর স্ত্রীদের আগামী জীবন কেমন হবে তারা কল্পনাও করতে পারতেন না। 

আবার মাঝে মধ্যে ব্যতিক্রম কিছু ঘটনাও দেখা যেত। যেমন কিছু নারীরা এমনও ছিলেন যে তারা নিজেরাই নিজেকে নিলামে তুলে নিজেই অর্থ দিয়ে স্বামীর হাত থেকে মুক্তি পেতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে ১৮২২ সাল নাগাদ ইংল্যান্ডের প্লাইমাউথের এক মহিলা তার নেশা গ্রস্থ স্বামীর হাত থেকে মুক্তি পেতে নিজে নিলামে উঠে অর্থ দিয়ে নিজেকে মুক্তি করেছিলেন। যদিও সে সময় অনেকেই মনে করেছিলেন যে ওই মহিলার কোন প্রেমিক রয়েছে এবং সেই প্রেমিকই অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল মহিলাকে। 

আবার অনেক মহিলা জানতই না যে তাদের নিলামে তোলা হচ্ছে এবং নিলামে বিক্রি হওয়ার পর তাদের পরবর্তী জীবন কি হবে! নিত্যদিনের মতোই কোনো একদিন সকালে হঠাৎই সেই স্ত্রীকে দড়ি বেঁধে স্বামীরা নিলামে তুলে দিতেন। এরপরই তাদের বিক্রি করে দিতেন মোটা অর্থের বিনিময়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যেত যে নেশাখোর স্বামীরা ঋণে ডুবে যাওয়ার জন্যই স্ত্রীদের বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতেন। এর একটা উদাহরণে বলা যায় ১৮০০ সালে ইংল্যান্ডের স্টাফোর্ডের ‘কিউপিড হাডসন’ নামের এক ব্যক্তি অর্থের দেনায় ডুবে যাওয়ার জন্য নিজের স্ত্রীকে ৫ শিলিং ৬ পেন্সের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

তবে স্ত্রীকে বিক্রি করার বিষয়টা আইনি নাকি বেআইনি সেই নিয়ে এখন অনেকেরই বহু মতামত রয়েছে। তবে জানা যায় যে সেসময় দম্পতিদের সহমতে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে একটা আলাদা সংসদ ছিল। কিন্তু তখন জনগণের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংসদের নিয়ম ছিল দীর্ঘস্থায়ী এবং ব্যয়বহুল। তাই কম অর্থের মধ্যে খুব তাড়াতাড়ি বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া ছিল স্ত্রীদের নিলামে তোলা এবং সেটিকে তারা বৈধ বলেই মনে করতেন।

এক সাংবাদিক জানিয়েছেন যে :-সে সময়কার লোকজনের মধ্যে এরকমভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ করা কোন বেআইনিই ছিল না। যদিও এটাতে আইন সম্মতি দেয়নি তবুও বিনা অর্থ ব্যয় করে উপরন্ত অর্থ লাভ করার পাশাপাশি বিচ্ছেদ হতো বিবাহের। তাই এই প্রক্রিয়ায় কোন লোকসান না থাকায় অনেকেই এটিকে বৈধ বলে মনে করেছেন। নিলামে ওঠার মাধ্যমে স্ত্রীদের সঙ্গে স্বামীরের সম্পর্ক যে খারাপ ভাবে বিচ্ছিন্ন হত সেটা নয়, উপরন্ত পরবর্তী সময় দেখা যেত যে পুরনো স্বামী এবং নতুন স্বামী ও নিলামে ওঠা স্ত্রী নিলাম শেষে কৌতুক বিনিময় করতো এবং একসঙ্গে সুরাও পান করতো। সেই কারণে নিলামের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়াটি চলেছিল বেশ কয়েক শতাব্দি ধরে।

পরবর্তীকালে অবশ্যই ইংরেজ সরকার বুঝতে পেরেছিলেন যে স্ত্রীকে নিলামে তোলার বিষয়টা সমাজের শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে এবং বড্ড অনৈতিক। তাই একটি নতুন আইন পাস করা হয়েছিল। সংসারের টানাপোড়নের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে যদি কোন ব্যক্তি বিচ্ছেদ চাইতো তাহলে তাদের বিচ্ছেদ সহজলভ্য করতে ও সমাজে ব্যভিচারী বন্ধ করতে ১৮ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে এই ঘৃণ্য প্রথা সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করেছিল ইংরেজ সরকার। আইনি পদ্ধতিতে সাংসদ মেনে বিবাহ বিচ্ছেদ কড়াকড়ি করায় একসময় স্ত্রীদের নিলামে তোলার বিষয়টি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *