অফবিট

ইরানের কারনে এবার সমস্যায় পরবে আমেরিকা!

২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ শুরু হয় ইউরোপের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ যা একবছর পরও বিদ্যমান। কিন্তু ইতিমধ্যেই আরও একটি ভূরাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে যার কারনে নতুন করে একটি সংঘর্ষের জন্ম হতে পারে। তবে এবারে ঘটনাস্থল ইউরোপ নয় বরং মধ্যপ্রাচ্য। ইরানের সাথে আমেরিকার বিরোধ চরমে উঠেছে ইরানের পরমানু পোগ্রামকে কেন্দ্র করে। যদি আমেরিকা কোন কারনে ইরানের পরমানু কার্যক্রমকে ধ্বংস করবার চেষ্টা করে তাহলে ইরান তাদের মিসাইল ও ড্রোনের সাহায্যে বিশ্বের অন্যতম প্রধান বানিজ্যিক পথ হরমুজ প্রনালীকে আটকে দিতে পারে, যা ভূরাজনৈতিক ভাবে বানিজ্যিক কারনে বিশেষ এনার্জি পরিবহনের ক্ষেত্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পথ। ওমান সাগর ও পারস্য উপসাগরের মাঝে অবস্থিত এই সংকীর্ণ সমুদ্রপথ কে ঘিরে ১৯৭০ এর দশকে ইরান ইরাক যুদ্ধের সময় থেকেই আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে বিরোধীতা শুরু হয়েছিল। যখনই আমেরিকা ইরানের পরমানু কার্যক্রমকে নিয়ে বিরোধীতা করে তখনই ইরান হরমুজ প্রনালী অবরুদ্ধ করার হুমকী দেয়। কেন হরমুজ প্রনালী এত গুরুত্বপূর্ণ? ভবিষ্যতে কী এই অঞ্চলে সংঘর্ষ হতে পারে? সেই বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

ওমান ও ইরানের মধ্যে অবস্থিত এই হরমুজ প্রনালী গল্ফ দেশ গুলো ইরাক, কুয়েত, সৌদিআরব, বাহরিন, কাতার, ইউএইর সাথে আরব সাগরকে যুক্ত করে। হরমুজ প্রনালী মাত্র ৩৩ কিলোমিটার চওড়া এবং জাহাজ যাবার রাস্তা তিন কিলোমিটার চওড়া। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুযায়ী হরমুজ প্রনালী একটি আন্তর্জাতিক বানিজ্যিক পথ। হরমুজ প্রনালীতে কোন জাহাজ ইরানের সমুদ্রপথ হয়ে ঢোকে এবং ওমানের সামুদ্রিক পথ হয়ে বেরোয়। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুযায়ী কোন দেশই এই পথ ব্লক করতে পারে না। আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা এই হরমুজ প্রনালীতে জাহাজ পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রন করে। এমনকী যুদ্ধকালীন সময়েও হরমুজ প্রনালী ব্লক করার কোন অধিকার নেই ওমান ও ইরানের কাছে। হরমুজ প্রনালীতে প্রবেশ করা জাহাজ গুলোকে সঠিক নির্দেশ ও নেভিগেশন দেওয়ার কাজ এই দুটি দেশই করে, এর জন্য তারা বছরে মোটা ডলার পায়। হরমুজ প্রনালীর অবস্থান গল্ফ দেশগুলোর মধ্যে, তাই বানিজ্যিক ভাবে এই অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী তেল গল্ফ দেশগুলোতেই পাওয়া যায় এবং এই প্রনালী হয়েই আরব সাগরে পৌঁছায় তেল ভর্তি জাহাজ গুলো।

২০১৮ এর তথ্য অনুযায়ী এখান দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল গেছে যা বিশ্বের মোট খনিজ তেল বানিজ্যের ২১ শতাংশ। তাই যদি কোন কারনে হরমুজ প্রনালী বন্ধ হয়ে যায় তাহলে জাহাজের খরচ এত বাড়বে যার সরাসরি প্রভাব পড়বে তেলের দামে এবং ফলস্বরূপ তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি হবে। দীর্ঘদিন আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার পর ২০১৬ সালে ইরানের উপর থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল যার কারনে ইরানের তেল বানিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছিল সাথে সাথে হরমুজ প্রনালীতে ইরানের জাহাজের সংখ্যাও বেড়েছিল। ২০১৮ সালে বিশ্বের মোট খনিজ তেলের এক তৃতীয়াংশ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের এক চতুর্থাংশ হরমুজ প্রনালী হয়েই এশিয়া ও ইউরোপে গেছিল। এখান দিয়ে রপ্তানিকৃত মোট ক্রুড অয়েলের ৭৬ শতাংশই এশিয়ান দেশগুলো ভারত, চীন, দক্ষিন কোরিয়া, জাপান সহ অন্যান্য এশিয়ান দেশে আসে। হরমুজ প্রনালী দিয়ে সবচেয়ে বেশী তেল রপ্তানি সৌদি আরবই করে। তবে গল্ফ দেশগুলোর মধ্যে দুটি দেশ হচ্ছে সৌদি আরব ও ইউএই যারা হরমুজ প্রনালী ছাড়াও ক্রুড অয়েল পাইপলাইনের মাধ্যমে বাইরে পাঠাতে সক্ষম। এই দুটি দেশ প্রতিদিন ৬.৫ মিলিয়ন প্রতি ব্যারেল হিসাবে ক্রুড অয়েল পাঠাতে সক্ষম। 

বর্তমানে দেশদুটি প্রতিদিন ২.৭ মিলিয়ন প্রতি ব্যারেল হিসাবে ক্রুড অয়েল রপ্তানি করতে সক্ষম। আমেরিকা নিজেও প্রতিদিন ১.৪ মিলিয়ন ব্যারেল করে তেল আনে হরমুজ প্রনালী দিয়ে।

১৯৫৯ সালে ইরান এবং ১৯৭২ সালে ওমান হরমুজ প্রনালীকে নিজেদের সীমানাধীন করতে চেষ্টা করেছিল, এরপর ১৯৮০-৯০ এর দশকেও এই দুই দেশ একাধিক বার এমন চেষ্টা করেছিল। ১৯৭৯ সালে ইসলামিক রেজোলিউশনের পর পুরো মধ্য প্রাচ্যে ইরান শক্তিশালী দেশ হবার চেষ্টা করছিল। এই কারনে ১৯৮০ এর দিকে ইরাক ইরান যুদ্ধ শুরু হয় যা ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চলেছিল। ইরাক ও ইরানের এই যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারন তখন বিশ্বে ঠান্ডা লড়াই চলছিল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার তখন হরমুজ প্রনালীকে সবার জন্য খোলা রাখবার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্ত ইরাক ইরান যুদ্ধে সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল আমেরিকা কারন সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরাককে অস্ত্র সাহায্য করত, ফলে আমেরিকা এই যুদ্ধে অংশ নিতে গেলে সরাসরি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সংঘর্ষ হবার সম্ভবনা ছিল।

১৯৮৪ সালে ইরান ও ইরাকের মধ্যে যুদ্ধ হরমুজ প্রনালীতে শুরু হয়, ইতিহাসে এই যুদ্ধ ট্যাংকার যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ। এইসময় ইরান প্রতিদিন ২.৬ মিলিয়ন ব্যারেল করে তেল রপ্তানি করত, তাই ইরাক হরমুজ প্রনালীতে ইরানের তেলের ট্যাংকার গুলোকে ডুবিয়ে দিত যাতে ইরানের আর্থিক ক্ষতি হয় এবং হরমুজ প্রনালীকে অবরুদ্ধ করে দেওয়া যায়। অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করায় ১৯৮৭ সালে আমেরিকান নেভি এখানে আসে তখন থেকে হরমুজ প্রনালী আবার আন্তর্জাতিক ভাবে বানিজ্য উপকূল হয়ে ওঠে। তবে ১৯৮৮ সালে হরমুজ প্রনালীতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। আমেরিকান নেভির একটি জাহাজ থেকে একটি ইরানিয়ান বিমান লক্ষ্য করে দুটি মিসাইল ছোঁড়া হয় যাতে বিমানটি মাঝ আকাশেই ধ্বংস হয়ে যায়। আমেরিকা ভেবেছিল এটা ইরানের এফ-১৪ যুদ্ধবিমান যা তাদের আক্রমন করতে আসছে কিন্তু বাস্তবে এটা ছিল একটি ইরানিয়ান যাত্রীবাহী বিমান যা ইরানের বন্দর আব্বাস থেকে দুবাই যাচ্ছিল। ঘটনাস্থলেই ২৯০ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। আমেরিকান রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগন ইরানের রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লিখে ক্ষমাও চেয়েছিল এই ঘটনার জন্য। তবে ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ইরানিয়ান পরিবারদের ৬১.৮ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরন দিতে হয়েছিল আমেরিকাকে। 

পরবর্তী সময়ে আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে ইরানের পরমানু কার্যকালাপকে কেন্দ্র করে বিবাদ শুরু হয় যার জন্য ইরানের উপর প্রচুর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এবং ইরানের তেল বিক্রির উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল যাতে দেশটির অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। এরজন্য ২০১১-১২ সালে ইরান হরমুজ প্রনালী বন্ধ করে দেবার হুমকী দিয়েছিল। ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হবার পর আমেরিকা ইরানের পরমানু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে ফলে দুই দেশের আবারও বিবাদ শুরু হয়। ২০১৯ সালে ব্রিটেন ইরানের একটি ট্যাংকারকে আটক করে। এর বদল নিতে ইরানও একটি ব্রিটিশ জাহজকে আটক করে। তবে ইরানের সাথে আমেরিকা, ব্রিটেনের বিরোধীতার মাঝে এবার চীনের প্রবেশ ঘটেছে।

চীন তার বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রজেক্টের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে আর্থিক ভাবে দুর্বল ইরানের সাথে চীনের জোট তৈরি হচ্ছে। ইরানের অর্থনীতির মূলকেন্দ্র হচ্ছে তেল কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারনে ইরানের তেল বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। একরকম সময়ে চীন ইরানের উন্নয়ন ও সামরিক খাতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। চীন ওমানেও বিনিয়োগ করছে।  এসব কারনে ভবিষ্যতে  হরমুজ প্রনালীকে কেন্দ্র করে চীন ও আমেরিকার মধ্যে ভূরাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *