অফবিট

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে কোন দেশ বেশী শক্তিশালী? সত্যি কি জিতবে ইসরায়েল?

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয় ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। তবে সম্প্রতি ইসরায়েল সিরিয়াতে ইরানের দূতাবাসে আক্রমন করার কারনে ইরান ইসরায়েলের দিকে কয়েকশো মিসাইল, ড্রোন হামলা করে। ইরানের এসব মিসাইল ও ড্রোনের ৯০ শতাংশই প্রতিহত করেছে ইসরায়েল। কিন্তু ইরানের ইসরায়েলে আক্রমনকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। ইরানের হামলার জবাবে ইসরায়েল ইরানের ইসফাহানে পরমানু কেন্দ্রের কাছে, মিসাইল কেন্দ্রে এবং ইরাক, সিরিয়াতে ইরানের কিছু কেন্দ্রে ব্যাপক মিসাইল আক্রমন করেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ইসরায়েলের এই আক্রমন নিয়ে ধোঁয়াশা করেছে কারন ইরান জানিয়েছে ইসরায়েল মিসাইল আক্রমন করেনি বরং কিছু ড্রোন পাঠিয়েছিল যেগুলোর অধিকাংশ তারা ধ্বংস করেছে। কিন্ত ইরান এই কথা বললেও ইরান দেশে কিছু সময়ের জন্য বিমান চলাচল বন্ধ রেখেছিল। ইসফাহান ইরানের খুবই গুরুত্বপূর্ন একটি শহর, এখানে ইরানের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে তাছাড়া ইরানের পরমানু গবেষনা কেন্দ্র রয়েছে এখানে। ইসফাহানে ইরান ইউরেনিয়ামের সমৃদ্ধকরন করে এবং নতুন পরমানু প্রযুক্তিতে গবেষনা করে। তবে এখনও পর্যন্ত ইরান এখানে পরমানু অস্ত্র তৈরি করেনি তবে ভবিষ্যতে ওই সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম দিয়ে ইরান চাইলে পরমানু বোম্ব তৈরি করতে পারে। এই ইসফাহানে পরমানু কেন্দ্রের কাছেই একাধিক বিস্ফোরন হয়েছে। ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সচল থাকলেও তা ইসরায়েলের ড্রোনকে আটকাতে পারেনি। কিছু তথ্য অনুযায়ী ইরানের ভিতর থেকেই হয়ত ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থা মোসাদ এই আক্রমন করেছে। মোসাদের কাছে অন্যদেশে ঢুকে আক্রমন করা নতুন কিছুনা, অতীতে বহুবার মোসাদ এরকম অপারেশন করেছে। এর আগেও অনেকবার মোসাদ ইরানের পরমানু কার্যক্রম ধ্বংস করে দিয়েছে। বালাকোটে ভারতীয় বায়ুসেনার এয়ারস্ট্রাইকের পর পাকিস্তান যেমন জানিয়েছিল কিছুই হয়নি ঠিক তেমনি এবার ইরান বিবৃতি দিয়েছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। তবে সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে ইসরায়েলের এই আক্রমনকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে অতীতের থেকেও বিধ্বংসী যুদ্ধ হতে পারে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যাতে একাধিক দেশ জড়িয়ে পড়তে পারে। 

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ হলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ইসরায়েল জিতে যেতে পারে কারন ইসরায়েল ইরানের তুলনায় অনেকবেশী শক্তিশালী। কিন্তু অনেকসময় যুদ্ধের ফলাফল আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব নয়। ইতিহাসে এমন যুদ্ধের উদাহারন অনেক রয়েছে যেখানে তুলনামূলক শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে বুদ্ধির জোরে পরাজিত করেছে দূর্বল প্রতিপক্ষ। যেমন নেপোলিয়ান বোনাপার্টের বিশাল গ্রান্ড আর্মিও রাশিয়া জয় করতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাডলফ হিটলারের দুর্ধর্ষ নাজিসেনাও সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করতে ব্যর্থ হয়েছে।  ১৯৭০ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার সেনাবাহিনী যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরে আমেরিকান সেনা ভিয়েতনাম ছেড়ে চলে আসে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকার মতো সুপার পাওয়ার দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেও তালিবানদদের পরাস্ত করতে না পেরে আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়ে আসে। 

সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধেও বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ রাশিয়া প্রায় দুই বছর ধরে যুদ্ধ করেও এখনোও ইউক্রেনকে পরাজিত করতে পারেনি। ইতিহাসে এরকম অজস্র উদাহারন রয়েছে যেখানে সুবিশাল সেনাবাহিনীও পরাজিত হয়েছে। তবে আধুনিক যুদ্ধে কোনওদেশ কতটা শক্তিশালী তা বিচার করা হয় পাঁচটি বিষয়ের উপর সামরিক শক্তি, পরমানু অস্ত্র, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বৈশ্বিক সমর্থন ও সাইবার ওয়ারফেয়ার প্রযুক্তি। 

** সামরিক শক্তি :—- গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর তালিকায় ইরানের অবস্থান চোদ্দ নাম্বারে যেখানে ইসরায়েলের অবস্থান সতেরো নাম্বারে। যেখানে ইরানের কাছে ২০০০ ট্যাঙ্ক রয়েছে সেখানে ইসরায়েলের কাছে ১৩৭০ ট্যাঙ্ক রয়েছে। ইরানের কাছে আর্টিলারি, রকেট লঞ্চার, সাঁজোয়া গাড়ির সংখ্যাও ইসরায়েলের থেকে বেশী রয়েছে। যেখানে ইরানের সেনাবাহিনীর সংখ্যা ৫,৮০,০০০ সেখানে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর সংখ্যা ১,৭০,০০০। তবে ইসরায়েলে যেহেতু প্রত্যেক নাগরিককেই সেনাবাহিনীতে কাজ করা বাধ্যতামূলক সেজন্য ইসরায়েলের প্রত্যেক নাগরিকই প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে সক্ষম। 

এই হিসাবে দেখতে গেলে ইরান ইসরায়েল অপেক্ষা বেশী শক্তিশালী মনে হবে কিন্ত বাস্তবে ব্যাপারটা অন্য। ইরান ইসরায়েলের ক্ষেত্রে আর্টিলারি, সাঁজোয়া গাড়ি, রকেট লঞ্চার ততটা প্রভাব ফেলেনা। ভৌগলিকভাবে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দূরত্ব অনেক। ইরান যদি ইসরায়েলকে স্থলপথে আক্রমন করতে চায় তাহলে ইরানি সেনাবাহিনীকে প্রথমে ইরাক, তারপরে জর্ডান হয়ে প্রায় ২,৩০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ইসরায়েলে পৌঁছাতে হবে। যার জন্য ইরান ইসরায়েল যুদ্ধে সেনাবাহিনীর তেমন কোনও ভূমিকা নেই। ইসরায়েল ও ইরান উভয়েরই নৌবাহিনী ততটা শক্তিশালী নয়। এজন্য ইসরায়েল ইরান যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে বায়ুসেনা। ইরানের বায়ুসেনাই তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। ইরানের বায়ুসেনাতে সমস্ত পুরানো যুদ্ধবিমান রয়েছে। ইরানের কাছে চীনের চেংদু জে ৭, আমেরিকার এফ ৫, এফ ১৪ টমক্যাট যুদ্ধবিমান রয়েছে। এইসমস্ত যুদ্ধবিমানই ১৯৭০ দশকের, সেসময় আমেরিকার সাথে ইরানের কুটনৈতিক সম্পর্ক ভালো থাকায় এসব বিমান কিনেছিল ইরান। ইরানের বায়ুসেনাতে সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান বলতে অল্প সংখ্যক রাশিয়ান মিগ ২৯ রয়েছে, তাও এগুলো আপগ্রেডেড নয়। অন্যদিকে ইসরায়েলের কাছে পঞ্চম প্রজন্মের শক্তিশালী এফ ৩৫, চতুর্থ প্রজন্মের এফ ১৫, এফ ১৬ এর মতোন আধুনিক যুদ্ধবিমান রয়েছে। যুদ্ধবিমানের সংখ্যার বিচারেও ইরান ইসরায়েলের থেকে পিছিয়ে। ইরানের বায়ুসেনাতে ৫৫১ যুদ্ধবিমান রয়েছে কিন্তু ইসরায়েলের কাছে ৬১২ যুদ্ধবিমান রয়েছে। অর্থাৎ এই দুইদেশের মধ্যে যুদ্ধ হলে সরাসরি ইসরায়েল ইরানের আকাশ দখল করে নেবে। 

** পরমানু শক্তি :—- ইরান আয়তনে ইসরায়েলের থেকে অনেক বড়। অর্থাৎ ইরান ইসরায়েলে তিনটি পরমানু মিসাইল ফায়ার করলেই ইসরায়েল ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু সেই তুলনায় ইরানকে ধ্বংস করতে ইসরায়েলের প্রচুর পরমানু হাতিয়ারের প্রয়োজন হবে। কিন্ত ইসরায়েলের কাছে পরমানু অস্ত্র থাকলেও ইরান এখনও পরমানু অস্ত্র তৈরি করতে পারেনি। ইরান অতীতে যতবার পরমানু অস্ত্র তৈরি করতে গেছে ততবার মোসাদ ইরানের পরমানু কার্যক্রম ধ্বংস করে দিয়েছে। তাই পরমানু অস্ত্রের দিক দিয়েও ইসরায়েল ইরানের থেকে এগিয়ে রয়েছে। 

** আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা :—- ইরান ইসরায়েল যুদ্ধে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ক্ষেত্র। উভয়দেশের কাছেই বিভিন্ন রেঞ্জের বেশ কয়েকপ্রকার মিসাইল, ড্রোন রয়েছে। ইসরায়েলের কাছে ডেভিড স্লিং, আয়রন ডোম, আয়রন বীম, প্যাট্রিয়টের মতো আধুনিক শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। বহুবছর ধরে ইসরায়েল হামাস, হিজবুল্লাহের রকেট আক্রমন থেকে নিজেকে রক্ষা করে আসছে। ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাফল্যের হার ৯০ শতাংশ। ইসরায়েলের তুলনায় ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ততটা শক্তিশালী নয়। 

** বৈশ্বিক সমর্থন :—- যেকোনও যুদ্ধে আন্তজার্তিক স্তরে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। যেমন রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে শক্তিশালী রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেন এতদিন ধরে যুদ্ধ করতে পারছে কারন আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলো নিরন্তর সহায়তা করছে ইউক্রেনকে। ভূ-রাজনীতিতে ইসরায়েলকে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স সহ বেশীরভাগ পশ্চিমা দেশগুলো সমর্থন করে। মধ্যপ্রাচ্যেও বেশ কীছু শক্তিশালী দেশ ইসরায়েলের পক্ষে আছে। অন্যদিকে ইরানকে রাশিয়া, চীনের মতোন দেশ সহায়তা করে। কিন্তু যে দেশ আগে অন্যদেশকে আক্রমন করবে সেই দেশ আন্তর্জাতিক স্তরে তেমন কোনও সমর্থন পাবেনা। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যে আগে অপরপক্ষকে আক্রমন করবে সে বিশ্বস্তরে সমর্থন হারাবে। 

** সাইবার ওয়ারফেয়ার:—- আধুনিক যুদ্ধে অন্যতম গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে সাইবার ওয়ারফেয়ার। আজ থেকে দশ বছর আগে তুলনা করা হলে ইসরায়েল সাইবার ওয়ারফেয়ারের ক্ষেত্রে ইরানের থেকে বহু আগে ছিল। কিন্তু বিগত কিছুবছরে রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় ইরান সাইবার ওয়ারফেয়ারে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে। সম্প্রতি ন্যাশানাল সাইবার পাওয়ারের তালিকায় ইরানের স্থান হচ্ছে দশে, যেখানে ইসরায়েলের স্থান রয়েছে উনিশ নম্বরে। এই তালিকায় সবার উপরে রয়েছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ সাইবার ওয়ারফেয়ার প্রযুক্তিতে ইরান ইসরায়েলের থেকে অনেকটাই এগিয়ে আছে।  

সবমিলিয়ে দেখতে গেলে ইসরায়েল ইরানের থেকে অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে রয়েছে। যদি দুই দেশের মধ্যে হয় তাহলে ইসরায়েলই জিতবে কিন্তু যদি এই যুদ্ধে বাইরের কোনও দেশ যুক্ত হয় তাহলে এই যুদ্ধ আরও একটি বিশ্বযুদ্ধের রূপ নিতে পারে। যদিও আমেরিকা ইসরায়েলকে জানিয়ে দিয়েছে যদি ইসরায়েল প্রথমে ইরান আক্রমন করে তাহলে আমেরিকা ইসরায়েলকে কোনও সহায়তা করবেনা। তবে ইরান যদি ইসরায়েল আক্রমন করে তাহলে আমেরিকা সহায়তা করবে ইসরায়েলকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *