অফবিট

দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গা মাটি দেখেও ভয় পেয়ে গেছিল ইংরেজরা

সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিহাসে উঠে এসেছে একাধিক বোমা মামলার ঘটনা। যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভীত নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। ব্রিটিশদের ভীত কাপানো এইরকমই একটি বোমা মামলা হল আলিপুর বোমা মামলা। এছাড়াও এই মামলাটি মানিকতলা বোমা মামলা নামেও পরিচিত।

১৯০৮ সাল, ততদিনে বিপ্লবীদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছিল বোমা তৈরির কৌশল। যার ফলে তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশদের কাছে বাংলার মাটি যেন ল্যাণ্ড-মাইনে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ নিধন যজ্ঞ। এবার বিপ্লবীরা এই যজ্ঞে বলি দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছিল নৃশংস ব্রিটিশ পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটদের। ব্রিটিশ পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটদের নিধন ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিল ‘যুগান্তর’ দলের বিপ্লবীরা।

এই দলের নেতা ছিলেন ঋষি অরবিন্দ ঘোষ।

এই মামলাটি অন্য আরেকটি মামলার হাত ধরে  উঠে এসেছিল ব্রিটিশদের কাছে। আলিপুর বোমা মামলা আগে ঘটেছিল মুজফফ্‌রপুরে  বোমা মামলা যা ছিল কিংসফোর্ড হত্যাকান্ডকে ঘিরে এবং এই হত্যাকান্ডের সাথে যুক্ত থাকা  প্রধান দুই অভিযুক্ত ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়ে যান। এরপর সারা বাংলা জুড়ে শুরু হয় তল্লাশি। তল্লাশিতে ২ মে পুলিশ আবিষ্কার করে কলকাতার ৩২ মুরারি পুকুর রোডে একটি বোমা  কারখানা। সেখানে অস্ত্রশস্ত্র, বোমা, বোমা বানানোর বিভিন্ন জিনিসপত্র সহ বিপ্লবী কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু নথিও উদ্ধার করে ব্রিটিশ পুলিশ। সেই সূত্র ধরেই পুলিশের হাতে চলে আসে বহু বিপ্লবীদের নাম এবং তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপরই দেশের মাটিতে শুরু হয়েছিল দীর্ঘ এক বৎসর-ব্যাপী ঐতিহাসিক “আলিপুর বোমা মামলা”।

আলিপুর বোমা মামলা দীর্ঘদিন ব্যাপী অর্থাৎ ১৯০৮ সালের ১৭ মে থেকে ১৯০৯ সালের ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত আলিপুর উচ্চ আদালতে চলেছিল এবং ১৯০৯ সালের ৬ মে এই মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন বিচারপতি মি. চার্লস পোর্টেন বীচক্রফ্‌। গুপ্ত হত্যার ষড়যন্ত্র, সম্মিলিতভাবে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিস্ফোরক তৈরির প্রচেষ্টা করা ইত্যাদি অভিযোগের ভিত্তিতে দায়ের করা হয়েছিল এই মামলাটি এবং এই অভিযোগের সাথে জড়িত অভিযুক্তদের তালিকায় নাম ছিল ‘যুগান্তর’ দলের বিপ্লবী নেতা বারীন ঘোষ, তাঁর দাদা অরবিন্দ ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধীর ঘোষ, বীরেন্দ্র নাথ সেন, বিভূতিভূষণ সরকার, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য,  বিজয়রত্ন সেনগুপ্ত, শৈলেন্দ্রনাথ বসু, হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল, হেমেন্দ্র নাথ ঘোষ, ইন্দুভূষণ রায়, পরেশ মৌলিক, বিজয় কুমার নাগ, শিশির কুমার ঘোষ, অশোক নন্দী, নলিনী কুমার গুপ্ত, শচীন্দ্র কুমার সেন, কুঞ্জলাল সাহা, ধরণী নাথ গুপ্ত, নরেন্দ্রনাথ বক্সী, পূর্ণচন্দ্র সেন, নিরাপদ রায়, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, মতিলাল বসু, দীনদয়াল বসু, নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, কৃষ্টজীবন সান্যাল, সুশীল কুমার সেন প্রমুখ বিপ্লবীদের। সর্বমোট ৩৯ জন বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়েছিল। 

তৎকালীন সময়ে শত শত গুপ্ত সমিতি গড়ে  উঠছিল। এবার তাদের টার্গেটে চলে এসেছিল ব্রিটিশ পুলিশ ও অত্যাচারী অফিসাররা। তাদের নিধনের জন্য একের পর এক অভিযান চালাতেন বিপ্লবীরা। আর ঠিক সেই সময় বোমার আমদানি সমগ্র বিপ্লবের মানচিত্রটাকে পালটে ফেলেছিল। সুদূর ফ্রান্স থেকে হেমচন্দ্র দাস (কানুনগো) বোমা তৈরির কৌশল রপ্ত করে এসে কলকাতার মানিকতলার কাছে ৩২ নং মুরারিপুকুর রোডের বাড়িতে গোপনে গড়ে তুলেছিলেন একটি আস্ত বোমার কারখানা। সেখানেই তৈরি করা হয়েছিল ব্রিটিশ বিচারক কিংসফোর্টকে হত্যা করার জন্য বোমা। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্ষুদিরাম দাস আর প্রফুল্ল চাকী সেই বোমা কিংসফর্টের গাড়িতে  ছুড়ে বিস্ফোরন ঘটালেও ব্যর্থ হয়েছিল তাদের সেই অভিযান। এরপরই ধরা পড়ে গিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল। ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ায় প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেন এবং ক্ষুদিরামের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল মামলা। সেই মামলায় ক্ষুদিরামের ফাঁসির আদেশ ঘোষণা করা হয়েছিল। 

মুজফ্‌ফরপুরের এই ঘটনার সাথে জড়িত অভিযুক্তদের শাস্তি হলেও ব্রিটিশ সরকারের চিন্তা কমার বদল আরও বেড়ে গিয়েছিল। কারণ ব্রিটিশ সরকারের মনে বাংলায় বিপ্লবের প্রয়াসে, বোমা সন্ত্রাস তৈরি করে দিয়েছিল।

অন্যদিকে গেরিলা আক্রমণে ব্রিটিশদের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে চাইছিল বারীন ঘোষের নেতৃত্ব দেওয়া ‘যুগান্তর দল’। এই দলের সদস্য ছিলেন উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধীর ঘোষ, বীরেন্দ্র সেন, বিভূতিভূষণ সরকার, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, শৈলেন্দ্রনাথ বসু, হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল, ইন্দুভূষণ রায় প্রমুখরা। মানিকতলার কাছে ৩২ নং মুরারিপুকুর রোডের এই বাড়িটিতে বোমা তৈরি করার পাশাপাশি বিপ্লবী আক্রমণের পরিকল্পনা করতেন বিপ্লবীরা।

১৯০৮ সালের ২ মে রাতে তৎকালীন পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেন্ট ক্রেগান এবং তাঁর বিখ্যাত গোয়েন্দা বিনোদকুমার গুপ্ত সহ আরো পুলিশ হানা দেয় এই বাড়িতে। তারা অরবিন্দ ঘোষের সমস্ত জিনিসপত্র এবং গোটা বাড়ি তল্লাশি করে আবিষ্কার করেন বোমার কারখানা। এই তল্লাশি করতে গিয়ে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে পড়ে গিয়েছিল বোমা তৈরি সংক্রান্ত একটি বই। যাতে পিকরিক অ্যাসিডের সাহায্যে বোমা তৈরির কৌশল বিশদে বর্ণিত ছিল। এছাড়াও ওই বইটিতে তিরিশটি ভিন্ন প্রকারের বোমা তৈরির কৌশলবর্ণিত ছিল। ব্রিটিশ আধিকারিকরা এই বোমার ভয়ে এতটাই ভীত ছিলেন যে ঋষি অরবিন্দের ঘরে থাকা দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গা মাটি দেখেও তাঁদের বোমা বলে ভ্রম হয়েছিল। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় অরবিন্দ ঘোষ, শ্রী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, শৈলেন্দ্র বসু, বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র দাস (কানুনগো) এবং পরে সত্যেন বসু, কানাইলাল দত্ত সহ মোট আঠারোজন বিপ্লবীকে।  মানিকতলার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা প্রচুর অস্ত্র-বোমা-কার্তুজ, জাতীয়তাবাদী প্রচারপত্র সমস্ত কিছু বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *