অফবিট

পাঁচশোর বেশী গোয়েন্দাকে বোকা বানিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের ধুরন্ধর ডবল এজেন্ট

গুপ্তচর বৃত্তির বিশ্ব যতটা রহস্যময় ততটাই ঘাতক। তথ্য গোপন রাখাই এই বিশ্বের প্রধান শর্ত। যে দেশের ইনটেলিজেন্স সংস্থা যত বেশী শক্তিশালী সেই তত বেশী ক্ষমতাধর। ইনটেলিজেন্স সংস্থাকে শক্তিশালী করে তাদের গোপন এজেন্ট যাদের পরিচয় একমাত্র সে নির্দিষ্ট সংস্থার কাছে থাকে। নিজের আসল পরিচয় গোপন করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব এজেন্টরা গোপন তথ্য সংগ্রহ করে। তবে অনেক সময় এসব এজেন্টরা অর্থের জন্য নিজের দেশের ইনটেলিজেন্স সংস্থার হয়ে কাজ করার পাশাপাশি অন্য কোন সংস্থার হয়েও কাজ করে গোপনে। এদের ডবল এজেন্ট বলা হয়। গুপ্তচর বৃত্তির দুনিয়ায় ডবল এজেন্ট কথাটি একদমই সাধারন। কারন ইতিহাসে এমন প্রচুর ডবল এজেন্টের নাম রয়েছে যারা অর্থের জন্য একাধিক সংস্থার হয়ে কাজ করেছে। 

ব্রিটেনের ইনটেলিজেন্স সংস্থা এমআই সিক্সে এমনই এক ডবল এজেন্ট ছিল যে পাঁচশোর বেশী এজেন্টকে ধোঁকা দিয়ে নিজের কাজ করে গেছে। এমআই সিক্সের ডবল এজেন্ট জর্জ ব্ল্যাক এতটাই ধুরন্ধর ছিল যে তার জীবনের উপর একটি সিনেমা নির্মান করতে আগ্রহী ছিল বিখ্যাত সিনেমা নির্মাতা স্যার আলফ্রেড হিচকক।

জর্জ ব্ল্যাক ওরফে জর্জ বেহারের জন্ম হয়েছিল ১৯২২ সালের ১১ নভেম্বর নেদারল্যান্ডসের রটারডাম শহরে। তাঁর মা ক্যাথরিন একজন খ্রিস্টান ধর্মালম্বী ছিলেন এবং পিতা আলব্রেট বেহার মিশরের ইহুদি বংশোদ্ভূত ছিল। আলব্রেট বেহার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছিল যার কারনে তাকে অনেক সম্মান করা হত নেদারল্যান্ডসে। ১৯৩৬ সালে হঠাৎই আলব্রেট বেহারের মৃত্যু হয়, যার কারনে জর্জকে মিশরের কায়রোতে তারা কাকার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, সেখানেই সে তার পড়া শেষ করে। কায়রোতে পড়া শেষ করে উচ্চতর শিক্ষার জন্য জর্জ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং সেখানে রাশিয়ান ভাষা শেখে। ১৯৪০ সালে নেদারল্যান্ডসে ফিরে আসে জর্জ কিন্তু সেই বছরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেদারল্যান্ডসকে পরাজিত করে অ্যাডলফ হিটলারের নাজি সেনা। আঠারো বছর বয়সী জর্জকে নজরবন্দী করে রাখা হয়। ১৯৪২ সালে নেদারল্যান্ডস থেকে পালিয়ে যায় জর্জ। এরপর স্পেনের জিব্রাল্টার হয়ে ১৯৪৩ সালের জানুয়ারিতে ব্রিটেন পৌঁছায় জর্জ। এর আগেই তার মা ও বোন ব্রিটেন পৌঁছে গিয়েছিল। ১৯৪৩ সালেই জর্জ বেহারের মা তার পরিবারের বেহার নাম বদলে ব্ল্যাক রাখে। সেই বছরই জর্জ রয়্যাল ব্রিটেন নৌবাহিনীতে যোগ দেয় এবং যুদ্ধে অংশ নেয়।

১৯৪৪ সালে ব্রিটেনের ইনটেলিজেন্স সংস্থা এমআই সিক্সে যোগ দেয় জর্জ। এসময়ই তার সাথে এমআই সিক্সের এক এজেন্ট আইরিশের প্রনয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু জর্জ ইহুদি হওয়ায় আইরিশের পরিবার এই সম্পর্ক মেনে নেয়নি। ১৯৪৬ সালে জার্মানির হ্যামবার্গ শহরে পাঠানো হয় জর্জ ব্ল্যাককে, সেখানে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় জার্মান সাবমেরিনের এক নাবিককে জিজ্ঞাসাবাদ করার। জার্মানি থেকে ফিরে এসে একবছর জর্জকে আবারও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয় রাশিয়ান সহ অন্যান্য ভাষা শেখার জন্য। এরপর ১৯৪৮ সালের ৬ নভেম্বর তাকে দক্ষিন কোরিয়ার সিওলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে পাঠানো হয়। সিওলে তাকে পাঠানো হয়েছিল উত্তর কোরিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের ব্যাপারে তথ্য জোগাড়ের জন্য। দুই বছর সিওলে থেকে অনেক তথ্য জোগাড় করে জর্জ। কিন্তু ১৯৫০ সালের ২৫ জুন দক্ষিন কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে ভয়ানক রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। উত্তর কোরিয়ার সেনা সিওল দখল করে নেয়। জর্জ ব্ল্যাক সহ সমস্ত ব্রিটিশ কুটনীতিবিদকে বন্দী করে উত্তর কোরিয়ার পিয়ং ইয়ং এ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় তিন বছর নজর বন্দী ছিল জর্জ ব্ল্যাক। পিয়ং ইয়ং এ থাকার সময়ে জর্জ ব্ল্যাক সোভিয়েত বিচার ধারার সংস্পর্শে আসে এবং ধীরে ধীরে সে পুরোদস্তুর সোভিয়েত মানসিকতায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। একদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইনটেলিজেন্স সংস্থা কেজিবির এক এজেন্টের সাথে দেখা করে জর্জ ব্ল্যাক সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে কাজ করবার আগ্রহ প্রকাশ করে। এখান থেকেই শুরু হয় তার ডবল এজেন্ট হয়ে ওঠবার যাত্রা। 

১৯৫৩ সালে পিয়ং ইয়ং থেকে মুক্তি পেয়ে ব্রিটেনে ফিরে আসে জর্জ। ব্রিটেনে তাকে নায়কের সম্মান দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে এমআই সিক্স তাকে গুরুত্বপূর্ন মিশনে বার্লিনে পাঠায়। সেখানে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন এজেন্টদের ডবল এজেন্ট বানানোর। কিন্তু এমআই সিক্স জানতো না যে জর্জকে তারা এতটা বিশ্বাস করছে সে আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়েই কাজ করছে। বার্লিন পৌঁছেই জর্জ ব্রিটেন ও আমেরিকার হয়ে কাজ করা ডবল এজেন্টদের নাম সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানাতে শুরু করে। সেসময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই চলছিলো এবং ব্রিটেন আমেরিকার পক্ষে কাজ করছিলো। সে কারনে ব্রিটেন ও আমেরিকার অনেক গোপন তথ্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে পাঠাতে থাকে জর্জ ব্ল্যাক। এদিকে এমআই সিক্সের হয়েও বেশ কিছু কাজ করছিলো জর্জ। ফলে কেজিবি ও এমআই সিক্স উভয়েই সন্তষ্ট ছিল জর্জের উপরে। 

১৯৫৫ সালে জর্জ ব্ল্যাক সোভিয়েতকে সবচেয়ে বড় তথ্য দেয় অপারেশন গোল্ড সম্পর্কে। ১৯৪৫ সালে জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হবার পর জার্মানিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয় পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানি। পূর্ব জার্মানির দায়িত্ব পায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিম জার্মানির দায়িত্ব পায় আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স। ১৯৫৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন হাইড্রোজেন বোম্ব পরীক্ষা করে যার পর থেকেই আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আরও নজর দারির জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন গোল্ড। যাতে পশ্চিম জার্মানি থেকে পূর্ব জার্মানিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেনাবাহিনীর মুখ্যা কার্যালয়ের নীচে অবধি একটি সুড়ঙ্গ খোঁড়া হবে, যাতে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর ল্যান্ড লাইন ট্যাপ করা যায়। এই অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় জর্জ ব্ল্যাকের উপর। এই খবর সাথে সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানায় জর্জ। কেজিবি একবছর কোন পদক্ষেপ নেয়নি ইচ্ছে করেই যাতে জর্জ ব্ল্যাক ধরা না পড়ে। একবছর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার এই পরিকল্পনা জনসমক্ষে এনে তাদের লজ্জিত করে। 

১৯৬১ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচশো ব্রিটিশ এজেন্টদের নাম সোভিয়েত ইউনিয়নকে পাঠায় জর্জ ব্ল্যাক, যাদের অনেককে কেজিবি হত্যা করে। এভাবে পূর্ব ইউরোপে এমআই সিক্সের প্রায় পুরো ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্কই ধ্বংস করে দেয় জর্জ ব্ল্যাক। কিন্তু ১৯৬১ সালে এক পোলিশ এজেন্ট মাইকেল যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও এমআই সিক্স এবং আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএর হয়ে কাজ করত সে একটি তথ্য দেয় এমআই সিক্সকে যাতে বলা হয় জর্জ ব্ল্যাক সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে কাজ করে। এমআই সিক্স তদন্ত শুরু করে যাতে জর্জ ব্ল্যাকের বিরুদ্ধে দোষী হবার প্রমান পাওয়া যায়। সাথে সাথে গ্রেফতার করা হয় জর্জ ব্ল্যাককে। ব্রিটেনে দেশদ্রোহীতার শাস্তি হিসাবে চোদ্দ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। কিন্তু জর্জ ব্ল্যাকের অপরাধ এতটাই বেশী ছিল যে ১৯৬১ সালের মে মাসে তাকে তিনটি ধারায় চোদ্দ বছর করে মোট ৪২ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরের ঘটনা যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানাবে। জেলে গিয়ে সেখানকার কয়েদিদের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করে জর্জ। তিনজন কয়েদির সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব তৈরি হয় তার। এই চারজনে জেল থেকে পালানোর পরিকল্পনা করে। জেলে থাকার পাঁচ বছর পর ১৯৬৬ সালের ২২ অক্টোবর জেলের জানালা ভেঙে চারজন পালিয়ে যায়। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাতটা পর্যন্ত সময়কে পালানোর জন্য তারা বেছে নিয়েছিল কারন সেসময় জেলে প্রতিসপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট দিনে ওইসময় সিনেমা দেখানো হত, সেই সুযোগে তারা পালিয়ে যায়। জেল থেকে পালিয়ে জর্জ পূর্ব জার্মানি চলে যায়। সেখান থেকে কেজিবির এজেন্ট দ্বারা মস্কো চলে যায়। ১৯৯০ সালে জর্জ ব্ল্যাকের আত্মজীবনি নো আদার চয়েস বাজারে আসে, যা সেসময় যথেষ্ট প্রশংসা পায়। ২০০৭ সালে ৮৪ বছর বয়সে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাকে অর্ডার অফ ফ্রেন্ডশিপ সম্মানে ভূষিত করে। ২৬ ডিসেম্বর, ২০২০ সালে মস্কোতে ৯৮ বছর বয়সী জর্জ ব্ল্যাকের মৃত্যু হয়। মস্কোতে চলে আসার পর বাকী জীবন অত্যন্ত বিলাসবহুল ভাবে কাটান তিনি, কেজিবি তাকে প্রতিমাসে মোটা অর্থ দিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *