বিড়ালের কারনে যুদ্ধ হেরে গেছিল মিশর
বর্তমান যুগে কুকুর-বিড়াল কমবেশি সকলের ঘরেই পোষ্য হিসেবে বিরাজ করে। সবথেকে প্রভুভক্ত প্রাণী কুকুর এবং সবথেকে আলসে প্রাণী বিড়াল এই কথাটা সম্পর্কে বহু মানুষই অবগত। কিন্তু ছোট্ট এই প্রাণী বিড়ালের জন্য মিশর হেরে গিয়েছিল পারস্যের সঙ্গে এক বৃহৎ যুদ্ধ। কথাটা শুনলে আজব মনে হতে পারে কিন্তু আসলে এটি একেবারে সত্য ঘটনা। যদিও এতে ছোট্ট প্রাণী বিড়ালের কোন দোষ ছিল না, মূল দোষ ছিল মিসরবাসীর কুসংস্কার। তাহলে একটু উল্টিয়ে দেখা যাক কি বলা হয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
সময়টা ছিল ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ। তখন মিশর জুড়ে চলছিল পেলুসিয়ামের যুদ্ধ। সে সময় মিশরের রাজা অর্থাৎ ফারাও ছিলেন সামেটিক তৃতীয়। আচমকা অসুস্থ জনিত কারণে তার পিতা আমাসিসের মৃত্যু হাওয়ায় বংশ পরম্পরায় সিংহাসনে বসতে হয়েছিল সামেটিকে। যদিও এই রাজার দুর্ভাগ্য ছিল যে তিনি যখন রাজ সিংহাসনে বিরাজ করেছিলেন তখনই চলছিল মিশর এবং আচেমেনিড সাম্রাজ্যের (পারসিয়ানদের) মধ্যে বড় রকমের কূটনৈতিক ফাটল। সামেটিক সেই ভাবে রাজ সিংহাসন সামলাতে না পারলেও তিনি রাজা হিসেবে খারাপ ছিলেন না। তিনি পারস্যের প্রতিপক্ষ হিসাবে একজন মজবুত রাজা থাকলেও পরিস্থিতি তার বিরুদ্ধে এতটাই প্রতিকূল ছিল যে বেশিদিন আর তিনি রাজ সিংহাসনে বসতে পারেননি। এবার আসা যাক যুদ্ধ এবং বিড়ালের কাহিনীতে।
পিতার মিত্ররা মিশর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি গ্রীক বন্ধুরাও তার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করেছিলেন। তাই অগত্যা আর কোন রাস্তা না পেয়ে পারস্যের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন সামেটিক। তবে মিশরের রাজা পারস্যের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ালেও পারস্য সেটা কোনদিন করেনি। উপরন্ত মিশরের উপর হামলার ঘোষণা করে দিয়েছিল পারস্য সৈন্যরা।
এই যুদ্ধের বিষয়ে আগে থেকেই অবগত ছিল সামেটিক। পারস্যের রাজা রাজা দ্বিতীয় ক্যাম্বিসেস যে মিশরের উপর আক্রমণ করবে সেই খবর সামেটিক পেয়েছিলেন পেলুসিয়ামের কাছ থেকে। যেহেতু আগত যুদ্ধের সম্পর্কে তিনি আগে থেকেই জানতেন তাই বিচলিত না হয়ে সৈন্যদের বাহিনী তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন সামেটিক।
পরবর্তীকালে যথাসময়ে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে এক প্রকার বিজয়ের শিখরে পৌঁছে যাওয়ার মুহূর্ত ছিল মিশরীয়দের। অর্থাৎ, পারস্যকে হারিয়ে মিশর প্রায় যুদ্ধ জিতেই যাচ্ছিল। কিন্তু জিতে যাওয়া বাজি এক মুহূর্তের মধ্যে হেরে গিয়েছিল তারা। এর পেছনে রয়েছে তাদের একটাই দুর্বল জায়গা সেটি হল ধর্ম ও অন্ধবিশ্বাস। পারস্যের রাজা জানতেন যে মিশরীয়রা কি হারে ধর্ম ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন রয়েছে। আর মিশরীয়দের এই দুর্বলতাকেই কাজে লাগিয়েছেন প্রতিপক্ষ পারস্য।
মিশরের দুর্বল স্থান হল তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি। যে সময় যুদ্ধ শুরু হয়েছিল সেসময় মিশরীয়রা বিড়াল দেবীর পূজা করতেন। কারণ এই ছোট্ট প্রাণী বিড়ালটির উপর মিশরবাসী এতটাই ভরসা করে ও ভালবেসে ফেলেছিলেন যে তারা বিড়ালকে শুধুমাত্র নিজের বন্ধু নয়, রীতিমতো দেবতার আসনে বসিয়ে দিয়েছিলেন। যেহেতু চাষবাসের ক্ষতিকারক পোকাকে বিড়াল খেত এমনকি বিষধর গোক্ষুরকে বিড়াল নিজের আহার হিসেবে গ্রহণ করে মিশরবাসীকে বাঁচাতো তাই তাদের কাছে বিড়াল ভগবান হয়ে উঠেছিল। মিশরের বাসিন্দারা বিড়ালের প্রশংসা করার পাশাপাশি বিড়ালের মমি পর্যন্ত তৈরি করত। এক পর্যায়ে কুসংস্কার এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে তারা বিড়ালকে দেবী হিসেবে পূজা করতেন এবং সেই দেবীর নাম ছিল বাস্ট বা বাসটেট। মিশরের প্রায় ২০০ বছর পর্যন্ত এই বিড়াল দেবীর পূজা হয়েছিল। যাই হোক মিশরের এই বিড়াল দেবীর উপর দুর্বলতার বিষয়ে পারস্য আগে থেকেই জানতো। তাই পারস্যের রাজা তার সকল সৈন্যকে ঢালে, বিড়ালের ছবি আঁকতে বাধ্য করেছিলেন। এরপরে যখন ওই ঢাল নিয়ে সৈনিকরা যুদ্ধে নেমেছিল তখন মিশরীয় সৈন্যরা তাদের শত্রুকে আঘাত করতে পারেননি। কারণ শত্রুকে আঘাত করা মানে ঢালে আঘাত করা, আর ঢালে আঘাত করা মানে তাদের বিড়াল দেবতাকে আঘাত করা হত। তাই নিজেদের ধর্ম বজায় রাখতে শত্রুকে আঘাত করতে না পেরে যুদ্ধের ময়দান থেকেই পালিয়ে গিয়েছিল মিশর সৈন্যরা। আরো একটা কারণ হলো কুকুর, ভেড়া সহ বেশ কয়েকটা বাকি মিশরীয় সৈন্যদের সামনে হত্যা করেছিল পারস্য। মিশরীয়দের সংস্কার অনুযায়ী, এই সকল প্রাণী হত্যা দেখাও তাদের কাছে ছিল পাপ। তাই অগত্যা পাপ না করার তাগিদেই যুদ্ধ ময়দান ত্যাগ করেছিল তারা। আর এভাবেই জিতে যাওয়া যুদ্ধ হেরে গিয়েছিল মিশর।