অফবিট

পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করিকে কেন ভারতের সুপারম্যান বলা হয়?

কেন্দ্রীয় সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করিকে ভারতের সড়ক উন্নয়নের প্রধান কারিগর বলা হয়। কোনও দেশের উন্নয়ন তার সড়ক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। সড়ক ব্যবস্থাকে একটি দেশের ধমনী বলা হয় যা দেশটির উন্নয়নের চিহ্নস্বরূপ। ভারতে বর্তমানে দ্রুতগতিতে আধুনিক সড়ক নির্মান করা হচ্ছে, অতীতে এত দ্রুত সড়ক নির্মান কখনও করা হয়নি। 

আমেরিকার তথ্য অনুযায়ী ভারতে বিগত ৬৫ বছরে যতটা জাতীয় সড়ক নির্মান করা হয়েছে তার থেকে অনেক বেশী জাতীয় সড়ক ২০২৫ সালের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে। ভারতের সড়ক ব্যবস্থা আধুনিকরনের কৃতিত্ব কেন্দ্রীয় সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করির। সাধারনত রাজনীতিতে এক দলের নেতা অন্যদলের নেতার বিরুদ্ধে কথা বলে কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে নীতিন গড়করির মতোন কিছু মানুষ রয়েছে যাদের প্রশংসা নিজের দল ছাড়াও বিপক্ষ দলের লোকেরাও করে। সড়ক ব্যবস্থাকে নির্মানের ক্ষেত্রে নীতিন গড়করির দক্ষ নেতৃত্ব ভারতের ভবিষ্যত আরও উজ্জ্বল করবে। 

নীতিন জয়রাম গড়করির জন্ম হয় ২৭মে, ১৯৫৭ সালে মহারাষ্ট্রের নাগপুরে এক সাধারন ব্রাহ্মন পরিবারে। তার মায়ের নাম ভানুমতী এবং বাবা জয়রাম রামচন্দ্র গড়করি। পুরোনো নাগপুরের মহল নামক এলকায় তার পরিবার বসবাস করতো। নীতিন গড়করির পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলনা। পাঁচ বছর বয়স থেকেই মায়ের সাথে আরএসএসের বৈঠকে যেতেন তিনি। তার গোটা পরিবারই আরএসএসের সাথে যুক্ত ছিল। নীতিন গড়করি প্রায়ই সাক্ষাৎকারে বলেছেন তার মা-ই তার জন্য সবচেয়ে বড় প্রেরনার কারন। কলেজ জীবনে সংঘের ছাত্রশাখা এবিভিপি অর্থাৎ অখিল ভারতীয় বিদ্যাপিঠ পরিষদের হয়ে কাজ করা শুরু করেন তিনি। 

নাগপুরের জিএস কলেজ অফ কমার্স এন্ড ইকোনমিক্স থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে ভর্তি হন। এইসময় মধুকর দোওরাসের নেতৃত্বে এবিভিপি সক্রিয় রাজনীতি শুরু করে। নীতিন গড়করিও তখন থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৮০ সালপ বিজেপি গঠন হওয়ার পর নীতিন গড়করি বিজেপির তরুন শাখা ভারতীয় জনতা যুবা মোর্চাতে যোগদান করেন এবং নাগপুর শাখার প্রসিডেন্ট হন। পরে বিজেপির নাগপুর শাখার সচিবও নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৮৪ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। ১৯৮৫ সালে নীতিন গড়করি নাগপুর পশ্চিম থেকে মহারাষ্ট্র বিধানসভায় নির্বাচনে দাঁড়ান কিন্তু তিনি নির্বাচনে হেরে যান। নীতিন গড়করির রাজনৈতিক শিক্ষা মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিসের বাবা গঙ্গাধর রাও ফড়নবিসের ছত্রচ্ছায়ায় হয়। 

১৯৮৭ সালে বিধান পরিষদের সদস্য থাকা অবস্থায় দেবেন্দ্র রাওয়ের ক্যান্সারে মৃত্যু হয়। দল ওই খালি আসনে নীতিন গড়করিকে প্রার্থী করে এবং ১৯৮৯ সালে তিনি ভোটে জিতে বিধান পরিষদের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী সদস্য হন। পরবর্তী কুড় বছর তিনি বিধান পরিষদেরই সদস্য ছিলেন। ১৯৯৫ সালে যা কেউ ভাবতে পারেনি তা হয়, বিজেপি ও শিবসেনার জোট মহারাষ্ট্রে কংগ্রেসকে পরাজিত করে সরকার গঠন করে। মনোহর যোশী মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হন। আরএসএস এইসময় পূর্ন চেষ্টা করে নীতিন গড়করিকে কোনও একটি মন্ত্রী পদে নিয়োগ করার। আরএসএস বিজেপির কমকর্তা লালকৃষ্ণ আডবানিকে এই বিষয়ে রাজি করায় এবং ১৯৯৬ সালে নীতিন গড়করিকে পূর্ত মন্ত্রী করা হয়। রাজনৈতিক জীবনে আরও অগ্রগতির জন্য এই সুযোগ ব্যাপকভাবে কাজে লাগায় নীতিন গড়করি। বিজেপি ও শিবসেনা সরকার এইসময় মুম্বাইয়ে ৫৫টি উড়ালপুল এবং ছয় লেন বিশিষ্ট মুম্বাই পুনে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মানের পরিকল্পনা করে যা মুম্বাই ও পুনের মধ্যে যাত্রাসময়কে অর্ধেক করে দিত। 

নীতিন গড়করি মাত্র দুই বছরে এই এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করান এবং মহারাষ্ট্রে তার চার বছরের মন্ত্রীত্বকালে তিনি সড়ক ও এক্সপ্রেসওয়ের জাল তৈরি করেন। তার কাজ দেখে স্বয়ং শিবসেনা প্রধান বালাসাহেব ঠাকরেও প্রভাবিত হয়ে যান এবং তিনি নীতিন গড়করির নাম দেন রোডকারি। নীতিন গড়করি তার বই ইন্ডিয়া এসপায়রস রিডিফাইনিং পলিটিক্স অফ ডেভেলপমেন্টে লিখেছেন এসব প্রজেক্ট গোটা দেশের জন্য একটা উদাহারন। এর মাধ্যমে দেশের সমস্ত আমলাদের জন্য এটা একটা দৃষ্টান্তস্বরূপ যদি সততা ও ইচ্ছাশক্তি থাকে তাহলে পথে আসা যেকোনও বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। 

১৯৯৯ সালে বিজেপি ও শিবসেনা মহারাষ্ট্রে নির্বাচনে হেরে যায়, নীতিন গড়করি বিধানপরিষদে বিপক্ষ দলের প্রধান নিযুক্ত হন। এইসময় তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপেয়ী তাকে ভারতের পরিকাঠামো উন্নয়ন দলের দায়িত্ব দেন। অটল বিহারি বাজপেয়ীর স্বর্নালী চতুর্ভুজ এবং প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার নেতৃত্বে ছিলেন নীতিন গড়করি। ২০০৪ সালে তিনি মহারাষ্ট্রে বিজেপির অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি বিজেপির জাতীয় অধ্যক্ষ হন। বিজেপির সবচেয়ে কমবয়সী অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে নাগপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হন তিনি এবং ভোটে জয়লাভ করেন। নাগপুরে ২,৮৫,০০০ ভোটের বিশাল ব্যাবধানে জয়লাভ করেন তিনি। এরপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় সড়ক ও পরিবহন দপ্তরের দায়িত্ব পান নীতিন গড়করি। 

মহারাষ্ট্রে আগেই আধুনিক সড়ক ব্যাবস্থা নির্মান করায় তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল ভারতের সড়ক ব্যবস্থা সম্পর্কে। নীতিন গড়করি যে গতিতে ভারতের জন্য আধুনিক সড়ক নির্মান তা গোটা বিশ্বে একটি রেকর্ড। ভারতে বর্তমানে ৪২টি গ্রীন এক্সপ্রেসওয়ে নির্মানের কাজ চলছে যা দেশের পরিবহন ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল করবে। নীতিন গড়করির নেতৃত্বে সড়ক নির্মানের ক্ষেত্রে ভারত তিনটি বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করেছে, ১) প্রতিদিন ৩৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মান ২) ২১ ঘন্টায় ১৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মান ৩) মাত্র ২৪ ঘন্টায় ২.৫ কিলোমিটার চার লেন সড়ক নির্মান। কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার পর থেকে জাতীয় সড়ক নির্মান পূর্বের তুলনায় অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। 

২০১৩-১৪ পর্যন্ত ভারতে জাতীয় সড়কের দৈর্ঘ্য ছিল ৯১,২৮৭ কিলোমিটার যা ২০২০-২১ সালে বেড়ে হয়েছে ১,৪১,৩৪৫ কিলোমিটার। ২০১৩-১৪ সালে যেখানে প্রতিদিন ১২ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক নির্মান হত তা ২০২০-২১ সালে বেড়ে হয়েছে ৩৮ কিলোমিটার প্রতিদিন। নীতিন গড়করি প্রতিদিন ৪৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মানের লক্ষ্য নিয়েছে। 

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১১৪টি জাতীয় সড়ক নির্মানের প্রকল্প শুরু করেছে যাতে এক লাখ কোটি টাকা খরচ করা হবে। এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হলে ভারত সড়কের দৈর্ঘ্যে আমেরিকাকেও অতিক্রম করে ফেলবে। নীতিন গড়করি নিজের সামাজিক মাধ্যমে এই বিষয়ে জানিয়েছেন এটি ভারতের জন্য একটি ল্যান্ডমার্কের দিন কারন একসাথে ১১৪টি জাতীয় সড়ক প্রকল্প শুরু করা হয়েছে। ২০২৪ এর শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত ভারতের পরিকাঠামো নির্মানে রেকর্ড পরিমান প্রজেক্ট শুরু করা হয়েছে বা সম্পূর্ন হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম তিনমাসে দশ লাখ কোটি টাকার প্রজেক্ট সম্পূর্ন হয়েছে অথবা শুরু করা হয়েছে। সড়ক নেটওয়ার্কের দিক দিয়ে আমেরিকা সবার প্রথমে রয়েছে বিশ্বে, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। চীন ভারতের থেকে আয়তনে বড় হলেও চীনের সড়ক নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য ভারতের থেকে কম। কিন্তু চীনের এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য ভারতের তুলনায় অনেকটাই বেশী। সড়ক পরিকাঠামো নির্মানে সাধারনত দুই ধরনের সড়ককে আধুনিক সড়ক বলা হয় জাতীয় সড়ক ও এক্সপ্রেসওয়ে। জাতীয় সড়কের থেকে এক্সপ্রেসওয়ে অনেক বেশী উন্নত। এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির গড় গতিবেগ থাকে ১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা এবং ভারতে এক কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মানে খরচ প্রায় ২০ কোটি টাকা। 

২০২৩ সালের জুলাই মাসের তথ্য অনুযায়ী ভারতে ৫,৩৪২ কিলোমিটার লম্বা এক্সপ্রেসওয়ে রয়েছে এবং ৮,৬০৩ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মানাধীন চলছে। কিন্ত চীনের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা এক্সপ্রেসওয়ে নেটওয়ার্ক রয়েছে যার দৈর্ঘ্য ১,৭৭,০০০ কিলোমিটার। ভারত সরকার লক্ষ্য নিয়েছে ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতের এক্সপ্রেসওয়ে নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য ৫০,০০০ কিলোমিটার করা। 

ভারতমালা প্রজেক্টের মাধ্যমে নীতিন গড়করি ভারতে এক্সপ্রেসওয়ে তৈরিতে বেশী মোনোযোগ দিয়েছে। নীতিন গড়করির নেতৃত্বে ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে দিল্লি মুম্বাই এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হয়েছে। এক লাখ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত ১,৩৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে দিল্লি থেকে মুম্বাই পৌঁছাতে ২৪ ঘন্টার বদলে অর্ধেক সময় অর্থাৎ ১২ ঘন্টা লাগবে। এভাবে পুরো ভারত জুড়ে জাতীয় সড়ক ও এক্সপ্রেসওয়ের জাল তৈরি করছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করি। সড়ক ব্যবস্থা আধুনিকরনের ফলে ভারতের পন্য পরিবহন ব্যয় কম হবে এবং সময়ও কম লাগবে। এর ফলে বানিজ্যে গতি আসবে ও অতিরিক্ত অর্থ খরচ কম হবে যার ফলস্বরূপ ভারত একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *