অফবিট

ইউরোপের নতুন ধর্ম পেগানিজম। বহু মিল হিন্দু ধর্মের সাথে

ইউরোপ বা পশ্চিমা বিশ্বে বর্তমানে একটি নতুন ধর্মমতের অনুসারীর সংখ্যা বাড়ছে যার নাম পেগানিজম। বিশ্বজুড়ে প্রায় দশ হাজার ধর্ম আছে এদের মধ্যে তিনটি প্রধান ধর্ম হচ্ছে হিন্দু ধর্ম, খ্রীস্টান ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম। এছাড়াও বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, ইহুদি ধর্ম সহ এত ধর্ম আছে যার সব নামও আমরা জানি না, কিন্তু পেগানিজম শব্দটা যেন একটু আলাদা। তবে এটা মোটেও কোন নতুন ধর্ম নয়, অতীতেও এর অস্তিত্ব ছিল।  খ্রীষ্টান ধর্মের উদ্ভব হয়েছিল আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে। তবে খ্রীষ্টান ধর্মের উদ্ভবেরও আগে ইংল্যান্ড ও ইউরোপের বিশেষ কিছু অংশে, গ্রীস, রোম, আফ্রিকা, রাশিয়াতে পেগানিজম ছিল। খ্রীষ্টান ধর্মের শুরু হবার পর থেকে ইউরোপে যারা নাস্তিক ব্যাক্তি ছিল বা বাইবেলকে মানত না তাদের পেগান বলা হত। ল্যাটিন শব্দ পেগানাস থেকে পেগানিজম শব্দটি এসেছে যার অর্থ গ্রাম্য। এই পেগানাস শব্দটি ব্যাবহার করত রোমান সাম্রাজ্যের মানুষরা। বিশ্বজুড়ে যত ধর্ম আছে তাদের দুই ভাগে ভাগ করা হয় পলিথিয়েসম এবং মনোথিয়েসম। পলিথিয়েসম শব্দের অর্থ বহু ইশ্বরে বিশ্বাসী ধর্ম যেমন প্রাচীন রোমান, গ্রীক, মিশরীয় ধর্ম এবং হিন্দু ধর্ম। মনোথিয়েসম শব্দের অর্থ একই ইশ্বরে বিশ্বাসী যেমন খ্রীস্টান ধর্ম, ইসলাম ও জুডাইসম বা ইহুদি ধর্ম।

পেগানিজম পলিথিয়েসমের অন্তর্ভুক্ত। পেগানিজমের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মূর্তি পূজো এবং পুরুষ ও মহিলাকে সমান বিচার করা। ভগবান শিবের অর্ধনারীশ্বর রূপ রয়েছে। ঠিক তেমনি পেগানিজমে পুরুষ দেবতার পাশাপাশি দেবীরও উপাসনা করা হয়। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য এবং প্রাচীন গ্রীসেই পেগানিজমের জন্ম বলে মনে করা হয়, এরপর তা গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। তবে অনেক ঐতিহাসিকদের মতে পেগানিজমের উদ্ভব হয় প্রস্তর যুগে অর্থাৎ মানব সভ্যতার সূচনা লগ্নেই। তবে প্রাচীন পেগানিজম ও আধুনিক পেগানিজমের মধ্যে অনেকটাই পার্থক্য রয়েছে। এই পেগানিজম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

প্রাচীন পেগানিজমে বিশ্বাস করত রোমান সাম্রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ। বিশেষ করে রোমান সাম্রাজ্যের গ্রাম অঞ্চলের মানুষ পেগানিজমে বিশ্বাস করত। পলিথিয়েসম ধর্ম গুলোর মতো পেগানিজমের অনুসারী মানুষরাও প্রকৃতিকে উপাসানা করত। খ্রীষ্টান ধর্মের আগে এর অনুসারীই বেশী ছিল ইউরোপে। পরে খ্রিষ্টান ধর্মের অগ্রগতির সাথে সাথে অখ্রীষ্টান লোকেদের পেগান বলা হতে থাকে। পেগানিজমের সাথে সবচেয়ে ভালো মিল আছে হিন্দু ধর্মের। সনাতন হিন্দু ধর্মে যেমন বলা হয় যেকোনও প্রানীর দেহ গঠন হয়েছে পঞ্চভূত পৃথিবী, অগ্নি, জল, বায়ু ও আকাশ দিয়ে। সেই জন্য হিন্দু ধর্মে এদের বিশেষ গুরুত্ব আছে। ঠিক তেমনি প্রাচীন রোম ও গ্রীসের পেগানরা পৃথিবী, আগুন, জল ও বায়ুর উপাসনা করত। শুধু এটাই নয় হিন্দু ধর্মের সাথে পেগানিজমের আরও অনেক মিল আছে।

প্রাচীন গ্রীক, রোমান, মিশরীয় এবং রাশিয়ানরাও পেগানিজমেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদের প্রত্যেকের সাথেই হিন্দু ধর্মের মিল আছে। যেমন ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্কের কিছু অংশ জুড়ে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক বাস করে এদের কুর্দি বলা হয়, এরা কুর্দিস্থান নামে আলাদা একটি দেশ তৈরির জন্য অনেকদিন ধরেই দাবি করছে। এদের ইয়াজেদি সম্প্রদায় বলা হয়। এই ইয়াজেদি সম্প্রদায়কে প্রাচীন পেগানিজমের অনুসারী বলা হয়। এদের প্রধান উপাস্য দেবতা হচ্ছে মেলেক তাওয়েস যা একটি ময়ূরের মূর্তি, তারা এর উপাসনা করে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ময়ূর সাধারনত এসব জায়গায় পাওয়া যায় না। যদি হিন্দু ধর্মের কথা বলা হয় তাহলে ভগবান মহাদেবের পুত্র হচ্ছে কার্তিক যাকে দেবসেনাপতিও বলা হয়, এই ভগবান কার্তিকের বাহন হচ্ছে ময়ূর। ইয়াজেদিরা তাদের নববর্ষ পালন করে ১৪ এপ্রিলে, কাকতালীয় ভাবে হিন্দু নববর্ষের সূচনাও হয় এইসময়েই। হিন্দুদের মতোই ইয়াজেদিদের মন্দিরও একই ধরনের। ইয়াজেদিদের আরতি করা এবং তার জন্য ব্যাবহার করা বাতি সবই হিন্দুদের মতোই। ইয়াজেদিদের মতোই হিন্দুদের কপালে তিলক পড়ে। হিন্দুদের মতোই পেগানরাও পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। যেমন প্রাচীন গ্রীসের প্রধান দেবতা বলা হয় জিউসকে যার সাথে হিন্দুদের দেবরাজ ইন্দ্রের মিল আছে। ইন্দ্রদেবের মতোনই জিউসেরও প্রধান অস্ত্র বজ্র। আবার হিন্দু ও গ্রীকদের মৃত্যুর দেবতা যম ও হেডস একই ধরনের। হিন্দু দেবতা কামদেবের মতোই গ্রীকদের ভালবাসার দেবতা কিউপিড। হিন্দু ধর্মের ত্রিদেব ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের মতোনই গ্রীকদের ত্রিদেবতা জিউস, হেডেস এবং পোসাইডন। হিন্দু ধর্মে সপ্তর্ষির কথা আছে, গ্রীক ধর্মেও সাতটি বোন প্লেয়িডিসের কথা আছে।

প্রাচীন মিশরে সূর্যের দেবতাকে র বলা হত, সেখানে ভারতে সূর্যদেবকে রবি নামে অভিহিত করা হয়। মিশরীয়রা আপিস নামে একটি ষাঁড় কে পূজো করত, অনেকটা সনাতন ধর্মের মহাদেবের নন্দীদেবের মতোন। আরও একটি মিশরীয় দেবতা হচ্ছে নেফ্রেতাম যাকে তারা সৃষ্টিকর্তা বলতো এবং এনার জন্ম জল থেকে। অনেকটা হিন্দু ধর্মে ভগবান ব্রহ্মার জন্ম হয়েছে যেমন ভগবান বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে। প্রাচীন রাশিয়ানদের মধ্যেও সনাতন ধর্মের মিল দেখা যায়। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী মহাদেবের আরেকনাম রুদ্র, ঠিক তেমনি রাশিয়ান স্লাভিকরাও সৃষ্টিকর্তাকে রোড বলে ডাকত। শিবলিঙ্গের মতোই স্লাভিকরা জিভা নামে একজন দেবীর উপাসনা করতো। স্লাভিক দেবী মোরেনা ও হিন্দু দেবী মা কালীর মধ্যেও মিল রয়েছে। ত্রিগলাভ প্রাচীন রাশিয়ান স্লাভিক ভগবান যার সাথে ভারতীয় ত্রিদেবের মিল রয়েছে। রাশিয়ার ভ্লগা অঞ্চলের একটি গ্রামে ৭-১০ এডির সময়ের অতি প্রাচীন একটি বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া গেছে। এর থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট যে প্রাচীন পেগানিজম সে যে দেশরই হোকনা কেন কোথাও না কোথাও সনাতন হিন্দু ধর্মের সাথে মিল আছে। ধীরে ধীরে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টান ধর্মের বৃদ্ধির সাথে সাথে পেগানিজম লুপ্ত হতে থাকে।

আধুনিক পেগানিজম কিন্তু প্রাচীন পেগানিজমের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। বর্তমান পেগানিজমের সংজ্ঞা বড়ই জটিল। বর্তমানে পেগানিজমের হার ইউরোপে বাড়ছে। ইউরোপে খ্রীষ্টান ধর্মের প্রভাব কমার সাথে সাথে পেগানিজমের হার বাড়ছে। নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, স্লোভাকিয়া, পর্তুগাল ও নেদারল্যান্ডসে খ্রীষ্টান ধর্মের প্রভাব দ্রুত কমছে, ইতিমধ্যেই দেশগুলো খ্রীষ্টান ধর্মের হার অন্তত ২০ শতাংশের বেশী কমে গেছে। ১৯৮০ থেকে ২০১৪ অবধি ব্রিটেনের একটি সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গেছে সপ্তাহের শেষে চার্চে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমছে যার কারনে একটি শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছে এবং চার্চে যাওয়া মানুষের বয়স দেখা যাচ্ছে মোটামুটি পঞ্চাশ বছরের উপরে। সুতরাং নতুন প্রজন্ম ধর্মের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে তারা নির্দিষ্ট কোন ধর্মের বদলে নিজেদের কোন ধর্মের অনুসারী বলেই পরিচয় দিচ্ছে না কিন্তু তারা আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করছে। ফলে যে শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছে সেই জায়গাটাই পূরন করছে পেগানিজম।

আধুনিক পেগানিজমে ইউরোপ জুড়ে বহু মানুষ এটা খুঁজছে যে তাদের আদি কোথায়। অর্থাৎ ২০০০ সাল আগে যে খ্রিস্টান ধর্ম শুরু হয়েছিল তার আগে তাদের আদিপুরুষ কোন ধর্ম পালন করত। এজন্য এনসেস্টারি ডট কম নামে একটি ওয়েবসাইটও আছে যারা ডিএনএ পরীক্ষা করে বলে দেয় তারা কোথা থেকে এসেছে, কারন ইউরোপে বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ গেছে। যেমন আইসল্যান্ডের প্রাচীন সভ্যতাকে নর্ডিক সভ্যতা বলা হত। হাজার বছর পর আইসল্যান্ডে এই প্রথম পেগান মন্দির তৈরি করা হয়েছে। আধুনিক পেগানিজমে ইউরোপ জুড়ে মানুষ বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উৎসব পালন করছে। যেমন হিন্দু ধর্মে প্রত্যেক মাসে বিভিন্ন পূজো হয়, আধুনিক পেগানিজমে এটাকে দি হুইল অফ দি ইয়ার বলা হচ্ছে। যেখানে বছরের চারটি প্রধান ঋতু গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত, শীতকালে মোট আটটি উৎসব পালন করা হচ্ছে। অর্থাৎ আধুনিক পেগানিজম পুরোপুরি হিন্দু ধর্ম অনুসরন করে না কিন্তু হিন্দু ধর্মের মতোই এরা প্রকৃতিকে পূজো করে। এমনকী এরা পঞ্চভূতের পাঁচ উপাদানেরও পূজো করে। বলা যেতে পারে হিন্দু ধর্মের একটি উদার সংস্করন এটি। তারা এক প্রকার ভারতের মহান সনাতন হিন্দু ধর্মকেই নতুন রূপে স্বীকার করে নিয়েছে। দুহাজার বছর পর ইউরোপ, আমেরিকার মানুষ এখন আবার তাদের পূর্ব উৎসের সন্ধানে ছুটছে। সবথেকে বড় কথা পেগানিজম শব্দটি ২০২০-২১ ইনস্টাগ্রামে সর্বোচ্চ দশটি সার্চের তালিকায় ছিল। আধুনিক পেগানিজমে বেশীরভাগই নতুন প্রজন্ম যুক্ত হচ্ছে এবং এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *