অফবিট

রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হত খিঁচুনি

বর্তমান দিনে ডিপ্রেশন ও মানসিক চিকিৎসা কথাটা খুবই সহজলভ্য। কারণ বর্তমানে খেলাধুলা কমে যাওয়া এবং ফোনের প্রতি আসক্তি বেড়ে যাওয়ার কারণে সকলে এক ঘরে বন্দী হয়ে গিয়েছেন। তাই যারা ডিপ্রেশনে ভুগছেন তাদের চিকিৎসা করা হয় মূলত সেশন করে কিংবা মিউজিক থেরাপির মাধ্যমে। অর্থাৎ রোগীর মস্তিষ্ককে যতটা হালকা রাখা যায় ততটাই যেন ভালো রোগীর পক্ষে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে পৃথিবীতে প্রায় ৩.৮ শতাংশ মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগছেন। এমনকি প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ডিপ্রেশনের কারণে আত্মহত্যা করছেন একজন। তবে এখন চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার কারণে ডিপ্রেশনের চিকিৎসা খুবই সহজ পদ্ধতিতে হয়। কিন্তু পূর্বে যখন চিকিৎসা ব্যবস্থা এতটা উন্নত ছিল না তখন আজব পদ্ধতিতে হতো ডিপ্রেশনের চিকিৎসা। এই প্রতিবেদনে সেরকমই আজব পাঁচটি চিকিৎসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

I)ইনসুলিন কোমা থেরাপি:- অস্ট্রেলিয়ান আমেরিকান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ম্যানফ্রেড সাকেল বার্লিনের এক মনোরোগ সংস্থায় মাদকাসক্ত ও মানসিক অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসা করতেন। তিনি মূলত রোগীদের চিকিৎসার জন্য ইনসুলিন ব্যবহার করতেন। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করার সময় ঘটে গিয়েছিল এক বিরাট ঘটনা। আনুমানিক ১৯২৭ সালে একজন মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত রোগীকে চিকিৎসা করতে গিয়ে তার ইনসুলিনের ডোজ বেশি হয়ে গিয়েছিল। যার কারণে সেই রোগী কোমায় চলে গিয়েছিলেন। তবে আশ্চর্যজনকভাবে তিনি কোমা থেকে ফিরে আসার পর জানিয়েছিলেন যে তারা কোন ওষুধের প্রয়োজন নেই এবং তিনি সম্পূর্ণ মানসিক দিক থেকে সুস্থ। এরপরই চিকিৎসক নিজের দেশ ভিয়েনায় ফিরে আসার পর সকল মানসিক রোগীদের চিকিৎসা করতেন ইনসুলিনের মাধ্যমে। এমন কি রোগীরা যথেষ্ট সুস্থ হওয়ায় বেশ খুশি হতেন। ১৯৩৩ সাল থেকে ইনসুলিন কোমাথেরাপি তিনি গোটা দুনিয়াতে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। বিশেষত ইউরোপ, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই কেমো থেরাপিটি দুমাস যাবত স্থায়ী থাকত। এক সপ্তাহে অন্তত দুদিন ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হত রোগীদের। তবে আজকের চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন এইভাবে ইনসুলিন হরমোন নেওয়ার কারণে রোগীদের শরীরে অতিরিক্ত গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায় এমনকি অস্থিরতা, স্থুলতা, ত্বক ফ্যাকাসে, অতিরিক্ত ঘাম ঝড়া এবং তন্দ্রা ও খিচুনি দেখা দিত। এমনকি পরবর্তীকালে মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকতে এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারত।

II) মাথার খুলি ছিদ্র করা (ট্রেপানেশন) :- ট্রেপানেশন পদ্ধতিটি ছিল প্রাচীন যুগে অন্ধবিশ্বাস যুক্ত একটি চিকিৎসা। কারণ তখনকার দিনে কোন মানুষ অন্যরকম আচরণ করলে সাধারণ মানুষেরা মনে করতেন  মস্তিষ্কে কোন অশুভ আত্মা প্রবেশ করার কারণেই ওই ব্যক্তি অদ্ভুত আচরণ করছে। শুধুমাত্র অস্বাভাবিক আচরণই নয় কোন ব্যক্তির মাথাব্যথা হলে কিংবা মৃগী রোগ ও মানসিক রোগ থাকলেও তার চিকিৎসা করা হত ট্রেপানেশন পদ্ধতিতে। এই চিকিৎসা ব্যবস্থার বেশি প্রচলন ছিল আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকাতে। এই পদ্ধতিতে অসুস্থ ব্যক্তিকে কোন অ্যানেসথেসিয়া না দিয়েই তার মাথায় ছিদ্র করা হতো। আর এগুলো বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। তবে আশ্চর্যের বিষয় এটা যে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করায় কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেনি।

III) মানসিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্য :- প্রাচীন গ্রীকে চিকিৎসা করা হতো দ্য ফোর হিউমারসের তত্ত্বের ভিত্তিতে। এই তথ্য অনুযায়ী বলা হয়েছিল যে মানব শরীরের চারটি মানসিক অবস্থা রয়েছে। এই অবস্থা গুলির ভারসাম্যহীনতার কারণেই মানসিক ব্যাধি ও অসুস্থতা দেখা দেয়। মূলত চারটি মানসিক অবস্থা মানব শরীরে তরল উৎপাদন করে থাকে। সেগুলি হলো – 

কালো পিত্ত – প্লীহা এবং কিডনি থেকে যে রস উৎপন্ন হয় তাকে কালো পিত্ত বলে। এই পিত্তই নাকি বিষন্নতার মূল কারণ। 

হলুদ পিত্ত – পিত্তথলি থেকে যে রস উৎপন্ন হয় তাকে হলুদ পিক্ত বলা হয়। এই পিত্ত নাকি ক্রোধের অন্যতম কারণ। 

রক্ত – মস্তিষ্ক এবং ফুসফুস দ্বারা উৎপাদিত রসের ফলেই নাকি গম্ভীর আচরণ করে মানুষ।

কফ -লিভার দ্বারা উৎপাদিত এই রস নাকি খারাপ সময় মানুষকে আশাবাদী হওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করে। 

সেই সময় মানুষের মানসিকতা ঠিক রাখার জন্য রক্তপাত, বমি, ঘাম মোছা ,পরিষ্কার করা ইত্যাদি করা হত নাপিত এবং সার্জেন দ্বারা। তবে এরা অদক্ষ থাকার কারণে মাঝে মধ্যেই সার্জেন ভুল ধমনী ছিন্ন করে দিত এবং রোগীর অত্যাধিক পরিমাণে রক্তপাত হত। এছাড়াও মাঝেমধ্যে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় তরল নিষ্কাশন করার কারণে অত্যাধিক ঘুম এবং নানান ব্যাধিতে সংক্রমিত হতো রোগীরা।

IV) রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি খিঁচুনি :- একজন হাঙ্গেরিয়ান নিউরোসাইক্রাইটিস্ট লাডিসলাস জোসেফ ভন মেডুনা’ রাসায়নিক পদ্ধতির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে খিচুনি আবিষ্কার করেছিলেন। এই গবেষণা পরীক্ষার সময় তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে মৃগী রোগীদের শরীরে এই কেমিক্যাল প্রয়োগ করলে শরীরে পাঁচ শতাংশ মৃগী রোগীদের রোগ সেরে যেত ঠিকই কিন্তু সিজোফ্রেনিয়া আবির্ভাব হত। আবার ৬০০ সিজোফ্রেনিয়া রোগীর শরীরে এই কেমিক্যাল দিলে তাদের মধ্যে মাত্র ২০ জনের মৃগী রোগ দেখা দিত নয়তো বাকি সবাই সুস্থ হয়ে যেত। এই ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ১৯৩৫ সাল নাগাদ চিকিৎসক মেডুনা স্বাস্থ্য সংস্থার সামনে গবেষণাটি রেখেছিলেন। এমনকি চিকিৎসক নিজের কয়েক হাজার রোগীর চিকিৎসা পর্যন্ত করেছিলেন। তবে রাসায়নিকভাবে তৈরি এই খিচুনিগুলির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকার কারণে এবং স্বাস্থ্য সংস্থার তরফ থেকে কোন সম্মতি না পাওয়ার জন্য তাকে বন্ধ করতে হয়েছিল এই চিকিৎসা। এই কেমিক্যাল এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছিল স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, হাড়ভাঙ্গা এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি। 

V) নারীদের আবেগোন্মত্ততা বা হিস্টেরিয়া :- মধ্যযুগ থেকে শুরু করে উনিশ শতক পর্যন্ত নারীদের নামে একটি চিকিৎসা শুরু হয়েছিল। এই চিকিৎসাটির নাম ছিল ফিমেল হিস্টিরিয়া। এই চিকিৎসা ছিল মূলত বন্ধ্যাত্ব, যৌনতা হ্রাস বা বেশি, ক্ষুধামন্দা, অনিদ্রা, এবং চাপের। তবে এর মধ্যে একটা বিষয়ে গ্রীকের বাসিন্দারা মনে করতো যে জরায়ু নারীদের শরীরে চলাফেরা করে এবং তারা শ্বাস রোধ করা ও নানান অসুখ ডেকে আনে। এই রোগের চিকিৎসা হিসাবে তারা নারীদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পরামর্শ দিতেন। কারণ তারা মনে করতেন বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর জরায়ু শান্তি থাকবে। এছাড়াও ফিমেল হিস্টিরিয়ায়’আক্রান্ত মহিলাদের মানসিক অ্যাসাইলামে পাঠানো হত। কিন্তু সেই অ্যাসাইলামের ভেতরে কি কার্যকলাপ হতো সেটি ১৮৮৭ সালে সকলের সামনে এনেছিলেন নেলি ব্লাই নামের একজন সাংবাদিক।

নিউইয়র্কের এরকমই একটি মানসিক হাসপাতালে নেলি পাগল সেজে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপরই সেখানে তিনি দেখেছিলেন যে কিভাবে একজন মানসিক রোগীকে অত্যাচার করা হয়। রোগীদের মরফিন ও ক্লোরাল জাতীয় ওষুধ খাইয়ে আরো বিকারগ্রস্ত  করা হতো এমনকি ঠান্ডা জলে স্থান করিয়ে, জল ভর্তি বালতিতে মুখ ডুবিয়ে, ঝাড় দিয়ে তাদের উপর চলত ব্যাপক অত্যাচার। এই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই বড়সড়ো সাড়া ফেলেছিল ইনভেস্টিগেশন জার্নালিজমে। এরপরই ফিমেল হিস্টোরিয়া রোগীদের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কার্যকলাপ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *