মার্কিন মুলুকের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘতম এবং ব্যয়বহুল মামলা। হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের কোণঠাসা করতে এক বিরাট ষড়যন্ত্র রচনা করেছিল প্রবাসী দেশ গুলি। আর সেই ষড়যন্ত্রের সাথে যোগ দিয়েছিল দেশীয় শক্তিও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলি তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত গদর পার্টি একত্রে সমগ্র ভারত জুড়ে যে ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লব গড়ে তোলার ষড়যন্ত্র করেছিল সেটি ইতিহাসের পাতায় হিন্দু-জার্মান-ষড়যন্ত্র মামলা (Hindu- German Conspiracy Case ) নামে খ্যাত হয়ে রয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের পিছনে মূল উদ্দেশ্যই ছিল ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করা। ব্রিটিশ শাসনকে সমূলে নির্মূল করতে একই সময়ে ভারতে শুরু হয়েছিল লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছিল হিন্দু-জার্মান-ষড়যন্ত্র মামলা। এই মামলাটি ছিল মার্কিন মুলুকের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘতম এবং ব্যয়বহুল মামলা।
হিন্দু-জার্মান-ষড়যন্ত্র মামলা ১৯১৭ সালের ২০ নভেম্বর শুরু হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং চলেছিল দীর্ঘ ১৫৫ দিন ব্যাপী অর্থাৎ ১৯১৮ সালের ২৪ এপ্রিল ইতি টানে এই মামলার। এই মামলায় প্রধান অভিযুক্তদের তালিকায় উঠে এসেছিল ওয়াশিংটন ডিসি এবং সান ফ্রান্সিসকোর কনস্যুলার অফিসার সহ ৯ জন জার্মান নাগরিক, ৯ জন আমেরিকান এবং ১৭ জন ভারতীয় গদর পার্টির কর্মী ও সদস্যদের নাম। ভারতীয়দের মধ্যে উল্লখযোগ্য ছিলেন তারকনাথ দাস, চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী, গোবিন্দ বিহারী লাল, রামচন্দ্র, ভগবান সিং, গোপাল সিং এবং সন্তোষ সিংহ এর মতো প্রমুখেরা। এছাড়াও এই মামলার সাথে জড়িত থাকার আঙুল উঠেছিল স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিকেও। এই মামলা পরিচালনা করেছিলেন মার্কিন অ্যাটর্নি অ্যানেট অ্যাবট অ্যাডামস। এই মামলা পরিচালনার জন্য মোট ৪ লক্ষ ৫০ হাজার ডলার ব্যয় হয় মার্কিন সরকারের এবং ২৫ লক্ষ ডলার ব্যয় হয় ব্রিটিশ সরকারের।
ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের শুরুটা হয়ে গিয়েছিল ১৮৬০-৭০ সাল থেকেই। কিন্তু সেই আন্দোলন চরম শিখরে পৌঁছেছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের পর থেকে।
১৯১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ওঠেছিল ‘প্যাসিফিক কোস্ট হিন্দুস্তান অ্যাসোসিয়েশন’ নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠনটি মূলত লেল্যাণ্ড স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লালা হরদয়ালের নেতৃত্বে প্রবাসী ছাত্রদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল যাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ধারণার সঞ্চার ঘটাতে সাহায্য করেছিলেন অধ্যাপক লালা হরদয়াল। পরবর্তীকালে এই সংগঠনটির নাম বদলে রাখা হয়েছিল গদর পার্টি এবং এই দলের সভাপতি ছিলেন সোহান সিং ভকনা। “গদর পার্টি” এই নামটি লালা হরদয়ালই ‘গদর’ নামে প্রকাশিত করেন এবং একটি উর্দু পত্রিকার নামানুসারে এই নাম রেখেছিলেন। উর্দু শব্দ ‘গদর’ কথাটির অর্থ হল বিপ্লব। শুধু ভারতের মধ্যেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জোয়ার সীমাবদ্ধ ছিল না। সেই জোয়ারের প্রভাব পড়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়া, ইউরোপ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে। এই প্রবাসী ভারতীয়দের সংগঠিত করে গড়ে তোলা হয় এক বৃহত্তর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পরিকল্পনা। গদর পার্টির কার্যকলাপ শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভের সময় থেকেই। এই পার্টিকে সহায়তা করার তালিকায় ছিল ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন দেশীয় শক্তির পাশাপাশি জার্মানি সহ, অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত তুরস্ক। এই পার্টির কয়েকজন সদস্য পাঞ্জাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য ভারতে এসেছিলেন। দেশের মাটিতে প্রত্যক্ষ বিপ্লব ঘটার পরিবর্তে মার্কিন মুলুকের মাটিতে সংগঠিত হয়েছিল এই ষড়যন্ত্রটি। এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিল মূলত সমাজতান্ত্রিক এবং উগ্র বামপন্থী বিপ্লবী সংগঠনগুলি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল বহু ভারতীয় বিপ্লবীরা। তাদের অনুসন্ধানের কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। বার্লিন ভারত কমিটির সদস্য হিসেবে কয়েকজন ভারতীয় বিপ্লবী বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ছড়িয়ে পড়েছিলেন মস্কো, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে । এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন লালা হরদয়াল, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মৌলানা বরকতউল্লাহ, রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ এবং তাঁর ভাই পরমানন্দ প্রমুখ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১৩ সালে গড়ে উঠা গদর দলে যোগ দিয়েছিলেন আলেক্সাণ্ডার বার্কম্যান, এমা গোল্ডম্যান, এবং অ্যাগনেস স্মেডলির মতো আইরিশ সমাজতন্ত্রীরাও। বিশ্বযুদ্ধের সময় একদিকে জার্মানি নিজস্ব পরিকল্পনা করছে অন্যদিকে ব্রিটিশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণের জন্য এই গদর পার্টির সদস্যরা বার্লিন, রাশিয়া এবং ইউরোপের বেশ কিছু সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীদের একত্রিত করে।
কথায় বলা হয় যে, শত্রুর শত্রু আমার মিত্র। সেই পলিসি এপ্লাই করেছিল মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহেরু এবং অ্যানি বেসান্তের মতো ভারতের নরমপন্থী কংগ্রেস নেতারা। সেই সময় জার্মানির শত্রু ছিল ব্রিটিশরা। যার ফলে তাঁরা মনে করেছিল যে তাঁদের সাথে জার্মানির এই গদর দলের মিত্রতা বদলে ভারতকে স্বশাসন এনে দেবে। অন্যদিকে বিপ্লবের নতুন পথ উন্মোচন করার চেষ্টা করতে থাকে ভারতের বিপ্লবীরা। ভারতে এই পরিস্থিতিতে বিপ্লবীদের মতাদর্শের বিষয় নিয়ে মাইয়া রামনাথ এবং সীমা গান্ধীর মতো ঐতিহাসিকরা বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রথম দিকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল মার্কিন শক্তি। কিন্তু পরবর্তীকালে মার্কিন সরকার এবং মার্কিন সংবাদপত্রগুলি সন্দেহ করেছিল যে আমেরিকার নিউ জার্সির অস্ত্র-ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে জার্মানি। আর এই কাজের দায়ভার চাপিয়ে দিতে পারে ব্রিটিশদের উপর।
জার্মানির আর্থিক সহায়তায় ১৯১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে নিয়োজিত বিপ্লবীদের কাছে চিন থেকে ভারতে অস্ত্র ভর্তি জাহাজ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এবং পরিকল্পনা করা হয় মার্কিন প্রদেশের পশ্চিম উপকূল থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে ভারতে অস্ত্র-শস্ত্র পাঠানোর।
১৯১৭ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ পুলিশ ব্যাঙ্ককে গ্রেপ্তার করেছিল সুকুমার চ্যাটার্জি নামের এক বিপ্লবীকে। পুলিশের কাছে তাঁর স্বীকারোক্তি অনুসারে তিনি ম্যানিলা এবং ব্যাঙ্ককে অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রেরণের করেছিলেন। এছাড়াও এই বিপ্লবী জার্মানির রিয়েল এস্টেট এজেন্টদের কাছ থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় এক বৃহত্তর গণ অভ্যুত্থান সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। ঠিক এর পরপরই ওয়াশিংটনের হকুয়াম বন্দরে ‘এ স্কুনার’ এবং ‘অ্যানি লারসেন’ নামের দুটি জাহাজ ধরা পড়ে এবং একইসঙ্গে ব্রিটিশরা বাজেয়াপ্ত করে সিঙ্গাপুরের এস এস মাভেরিক জাহাজ।
জানা যায় যে ভারত এবং নিউইয়র্কে জার্মান কনস্যুলার অফিসিয়াল ফ্রানজ ভন প্যাপেন জার্মান ‘ক্রাপ’ কোম্পানির কর্মচারী হ্যান্স টাউসারকে অস্ত্র কিনে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে এই নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কিছু ঐতিহাসিকের মতে অস্ত্র কেনার দায়িত্বভার দেওয়া হয়েছিল আইরিশ বিপ্লবী জোসেফ ম্যাকগারিটিকে। প্রথমে টেক্সাস থেকে এই রাইফেল, পিস্তল, গোলা বারুদ ইত্যাদি সমস্ত অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সান দিয়েগোতে। পরিকল্পনা অনুসারে, অ্যানি লারসেন জাহাজ এবং এস এস মাভেরিক জাহাজটি মার্কিন প্রদেশের সান পেড্রো বন্দর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের সোকোরো দ্বীপের কাছে একত্রিত হত। সন্দেহের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমেরিকান কোম্পানির অধীনে সুপার কার্গো হিসেবে এই দুটি জাহাজকে নিবন্ধিত করা হয়েছিল। সিঙ্গাপুরে ব্রিটিশদের কাছে ধরা পড়ে যায় মাভেরিক জাহাজটি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পারসিদের ছদ্মবেশে পাঁচজন গদর কর্মী ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণকালে উগ্র জাতীয়তাবাদের নিন্দা করেছিলেন। যার ফলে তাঁর উপর খুবই ক্ষুন্ন হয়েছিলেন প্রবাসী ভারতীয়রা। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হিন্দুদের বিপ্লবের পরিপন্থী বলে মনে করায় তিনি যখন আমেরিকা গিয়েছিলেন, তখন সেখানে তাঁর বক্তৃতা বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করা হয়েছিল। এই পরিকল্পনার সাথে জড়িত থাকার তালিকায় যুক্ত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম যা ১৯১৮ সালের শেষদিকে গদর পার্টির এক সদস্য চন্দ্রকান্তের চিঠির মাধ্যমে দাবি করা হয়েছিল। তবে হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর নাম জড়িত হলেও পরবর্তীকালে তিনি নিজের স্বীকারোক্তি জানিয়েছিলেন একটি চিঠি এবং টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনকে। এরপর ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডের হস্তক্ষেপে এই মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আদালতে এই মামলার রায় ঘোষণার দিন রাম সিং তাঁর সহকারী রামচন্দ্রকে আদালত চত্বরে পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। ওই সময়ই রাম সিংকেও গুলি করেন আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত সশস্ত্র মার্শাল। এই মামলার রায়ে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল তারকনাথ দাস এবং ভগবান সিংকে। তাঁদেরকে ভারতে নির্বাসিত করতে চেয়েছিল ব্রিটিশ সরকার তবে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল আমেরিকার বিচারবিভাগ। ১৯১৯ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় গদর পার্টিকে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তারকনাথ এবং ভগবান সিং দেশের মাটিতে পা রাখতে পারেন নি। এরপর দেশ স্বাধীনতা লাভের পর তাঁরা ফিরে আসে দেশে। এরপর থেকে তাঁদের বাকি জীবনটা কেটেছিল হিমাচল প্রদেশে।