কেন ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল আমেরিকা?
দিনটা ১৭ জানুয়ারি, ১৯৯১, ইরাক ও কুয়েতের আকাশ সীমার মধ্যে একের পর এক আমেরিকান বোম্বার বিমান উড়ছে। আমেরিকার উদ্দেশ্য ছিল ইরাকের স্বৈরাচারী শাসক সাদ্দাম হোসেনকে পরাজিত করা। আসলে এই ঘটনার কিছু মাস আগেই সাদ্দাম হোসেন কুয়েত আক্রমন করে। সাদ্দাম হোসেন গোটা বিশ্বকে জানিয়েছিল তাকে যদি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা হয় তাহলে ভয়ানক যুদ্ধ হবে। কুয়েতকে ইরাকের হাত থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে আমেরিকা, এই মিশনের নাম দেওয়া হয় অপারেশন ডেসার্ট স্ট্রম। কয়েকদিনের মধ্যেই পারস্য উপসাগরের তীরে ছোট গল্ফ দেশটি ভয়ানক যুদ্ধের ময়দান হয়ে যায়। এটি বিশ্বের প্রথম কোন যুদ্ধ যা আন্তর্জাতিক মিডিয়া সরাসরি সম্প্রচার করছিল।
১৯৯১ সালে ইরাক আমেরিকা যুদ্ধ বা গল্ফ যুদ্ধকে ভিডিও গেম যুদ্ধ নাম দেওয়া হয়েছিল কারন এই যুদ্ধে প্রচুর আধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছিল যা দেখে মনে হয়েছিল বোধহয় কোন ভিডিও গেম চলছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই পৃথিবীর সবচেয়ে অশান্ত অঞ্চল হয়ে উঠেছিল মধ্যপ্রাচ্য। আরব ইসরায়েল যুদ্ধ, ইরাক কুয়েত যুদ্ধ, সৌদি আরব ইরানের দ্বন্দ্ব, আইএসআইএস জঙ্গি সংগঠনের উত্থান সিরিয়াতে সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্য বরাবরই অস্থিতিশীল।
১৯৯১ এর ইরাক কুয়েত যুদ্ধের প্রেক্ষাপট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই তৈরি হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের সূত্রপাত হয় যাতে গোটা বিশ্ব দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে যায়। ইরাক সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে চলে যায়, আবার ইরাক মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বন্ধু ইসরায়েলের বিপক্ষে যুদ্ধ করতো এমনকী ইরাক প্যালেস্টাইনের একাধিক সন্ত্রাসী সংগঠনকে সহায়তা করতো যারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কাজকর্ম করতো। এই কারনে ইরাকের সাথে আমেরিকার প্রথম থেকেই কুটনৈতিক সম্পর্ক ভালো ছিলনা।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইরানিয়ান রেভোলিউশন ঘটে যার পর এই এলাকায় প্রভাব বাড়াতে ১৯৮০ সালে ইরাক ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। এই যুদ্ধে ইরাক রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্রের ব্যবহার করে। আট বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে কোন পক্ষই জয় লাভ করেনি, এই যুদ্ধে প্রায় কুড়ি লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৮৮ সালের আগস্ট মাসে ইরাক ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হয়৷ আট বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয় ইরাকের। ইরাক দেওলিয়া হয়ে যায়, বৈদেশিক ঋনের বহর প্রচুর বেড়ে যায় ইরাকের। বেশীর ভাগ ঋনই সৌদি আরব এবং কুয়েত থেকে নিয়েছিল ইরাক। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর দুই দেশই ইরাককে তাদের অর্থ পরিশোধের জন্য চাপ দিতে থাকে, এদিকে ইরাকের মানুষও প্রশাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠাতে শুরু করে। এরকম অবস্থায় ইরাকের নেতা সাদ্দাম হোসেনের কাছে একটাই পথ ছিল তা হল কুয়েত আক্রমন। কুয়েতে বিশ্বের মোট খনিজ তেল ভান্ডারের দশ শতাংশ রয়েছে। সাদ্দাম হোসেন ভাবে ইরাক ও কুয়েত মিলিয়ে বিশ্বের পাঁচ ভাগের এক ভাগ তেলের মালিক হতে পারবে সে এবং দেশের জনগনকেও শান্ত রাখা যাবে তাই সে কুয়েত আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেয়। সাদ্দাম হোসেন কুয়েত আক্রমনের জন্য কারন দেখায় কুয়েতের সাথে ইরাকের সীমান্ত সমস্যা, কুয়েত প্রয়োজনের তুলনায় বেশী তেল উৎপাদন করছে যাতে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমে যাচ্ছে এবং কুয়েত লুকিয়ে ইরাকের তেল চুরি করছে। এসব অভিযোগ এনে সাদ্দাম হোসেন ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট ভোর বেলায় ইরাকি সেনাকে কুয়েত আক্রমনের নির্দেশ দেয়। ছোট একটি দেশ কুয়েতের অল্প সংখ্যক সেনা খুব সহজেই ইরাকি সেনাবাহিনীর সামনে পরাজিত হয় এবং ইরাকের সেনা সরাসরি কুয়েতের সংসদ ভবনে আক্রমন করে। ইরাকের কুয়েত আক্রমনের বারো ঘন্টার মধ্যে কুয়েতের রাজ পরিবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই সুযোগে মাত্র দুই দিনে ইরাক কুয়েত দখল করে নেয়। কুয়েত দখল করেই ইরাক কুয়েতের ব্যাঙ্কগুলি থেকে এক বিলিয়ন ডলার লুঠ করে। গোটা বিশ্ব ইরাকের এমন আক্রমনে হতবাক ছিল। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ সবাই এই আক্রমনের নিন্দা করছিলো। মধ্যপ্রাচ্যের মতো অস্থিতিশীল জায়গায় এই যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতির উপরও প্রভাব ফেলবে তা সবাই বুঝতে পারছিলো।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ৬৬০ ধারা অনুযায়ী সাদ্দাম হোসেনকে এই আক্রমন বন্ধ করবার নির্দেশ দেয়। কিন্তু কুয়েতে আক্রমন বন্ধতো দূরের কথা সাদ্দাম হোসেনের মাথায় তখন অন্য আরেকটি পরিকল্পনা ছিল। কুয়েতে সফল আক্রমনের পর সাদ্দাম হোসেন সৌদি আরব আক্রমনের পরিকল্পনা করে। সেসময় সৌদি আরবের সেনাবাহিনী ইরাকের সেনাবাহিনীর তুলনায় দুর্বল ছিল। সাদ্দাম হোসেনের পরিকল্পনা ছিল কুয়েত ও সৌদি আরব দখল করে বিশ্বের অর্ধেক তেল ভান্ডারের মালিক হওয়া কিন্তু তাঁর এই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। যার প্রধান কারন অপারশন ডেসার্ট শিল্ড।
ইরাকের কুয়েত আক্রমনের চারদিন বাদ অর্থাৎ ৬ আগস্ট আমেরিকার প্রতিনিধিরা সৌদি আরবের রাজা ফাহাদের সাথে বৈঠকে সম্ভাব্য ইরাকি আক্রমনের বিষয়ে জানায়। রাজা ফাহাদ আমেরিকাকে তাদের আকাশ সীমা ব্যবহারের অনুমতি দেয়। জাতিসংঘের একটি বিশেষ সেনাদল গঠন করা হয় যার নেতৃত্বে ছিল আমেরিকা। বলা হয় আমেরিকা ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আগ্রহী ছিলনা প্রথমে কিন্তু আমেরিকাকে রাজি করানোয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের বড় ভূমিকা ছিল। জাতিসংঘের ৬৬১ ধারা অনুযায়ী ইরাকের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এবং ধারা ৬৬৫ অনুযায়ী ইরাকের সমুদ্রপথ অবরুদ্ধ করা হয়। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন সেনা ঘাঁটি থেকে প্রায় আড়াই লাখ সেনাকে পাঠানো হয় সৌদি আরবে। কিছু দিনের মধ্যেই মিশর, সিরিয়া সহ ৩৯ টি এই অপারেশন ডেসার্ট শিল্ডে যুক্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম এত বিশাল সামরিক জোট তৈরি হয়৷ এই জোটের প্রধান দায়িত্ব ছিল ইরাকের থেকে সৌদি আরবকে নিরাপত্তা দেওয়া। ১৯৯০ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘে ৬৭৮ তম ধারা অনুযায়ী ইরাককে ছয় সপ্তাহের অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারি, ১৯৯১ অবধি সময় দেওয়া হয় কুয়েত থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য কিন্তু সাদ্দাম হোসেনের নিজের সেনাবাহিনীর উপর এতটাই বিশ্বাস ছিল যে সে জাতিসংঘের আদেশকে পাত্তাই দেয়নি। অপারেশন ডেসার্ট শিল্ডে সম্মিলিত সেনাবাহিনীর অধিকাংশ ছিল ইউরোপীয়ান পাহাড়ে যুদ্ধে অভ্যস্ত সেনাবাহিনী, মধ্য প্রাচ্যের গরম আবহওয়ায় এবং মরুভূমিতে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিলনা তাদের, তার সাথে ইরাকের সেনাবাহিনীর কাছে বিপদজনক রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্রের ভান্ডার ছিল। যার কারনে মরুভূমিতে যুদ্ধের এবং রাসায়নিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশিক্ষন দেওয়া হতে থাকে সম্মিলিত সেনাবাহিনীকে। এরই মধ্যে সাদ্দাম হোসেন কুর্দ সদস্যদের উপর রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ করে এবং ইরাক ও কুয়েতে তার বিরুদ্ধে হওয়া সামান্য প্রতিবাদও কঠোর ভাবে দমন করতে থাকে সাদ্দাম হোসেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকান সেনাবাহিনীর পীছু হটার কারনে সাদ্দাম হোসেন আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরও উৎসাহি ছিল। সাদ্দাম হোসেনকে দেওয়া ১৫ জানুয়ারির এক সপ্তাহ আগে সৌদি আরবে সম্মিলিত জোটের সেনার সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে সাত লাখ। ইরাকি সেনার রাসায়নিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে অপারেশন ডেসার্ট শিল্ডে প্রথমে সরাসরি ইরাকি সেনাবাহিনীর উপর আক্রমনের পরিবর্তে এয়ার স্ট্রাইকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে কুটনৈতিক স্তরে আলোচনার মাধ্যমে সম্ভাব্য যুদ্ধ এড়াবার জন্য একটা শেষ চেষ্টা করা হয়। আমেরিকার বিদেশমন্ত্রী এবং ইরাকের বিদেশমন্ত্রীর মধ্যে সাত ঘন্টার দীর্ঘ আলোচনা হয়, আমেরিকা ইরাককে জানিয়ে দেয় যুদ্ধে যদি রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার করে ইরাক তাহলে আমেরিকার কাছেও পারমানবিক অস্ত্র রয়েছে। এই বৈঠকও ব্যর্থ হয়।
১৫ জানুয়ারি, ১৯৯১ ইরাককে দেওয়া জাতিসংঘের সময়সীমা শেষ হয়। ১৭ জানুয়ারি সম্মিলিত জোট অপারেশন ডেসার্ট স্ট্রোম শুরু করে। সম্মিলিত জোটের প্রচুর যুদ্ধবিমান কুয়েত ও ইরাকের আকাশসীমায় প্রবেশ করে। এই এয়ার অপারেশনকে ইনস্টান্ট থান্ডার নাম দেওয়া হয়। প্রথমে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে প্রচুর বোম্বিং করা হয়। বাগদাদের গুরুত্বপূর্ন সামরিক স্থাপনা, বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, রেডার ও কমিউনিকেশন সিস্টেম ধ্বংস করে দেওয়া হয়৷ এর পরবর্তী টার্গেট করা হয় ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের বাড়িকে। সম্মিলিত জোটের এই আক্রমনের প্রতিশোধ নিতে ইরাক ইসরায়েল আক্রমন করে। ইসরায়েলে প্রচুর স্কাড মিসাইল হামলা করে ইরাক। আসলে সাদ্দাম হোসেন এখানে একটি অসাধারন স্ট্রাটেজি প্রয়োগ করেছিল। সাদ্দাম হোসেন জানতো ইসরায়েলের সাথে আরব দেশ গুলোর বিরোধীতা আছে। তাই যদি ইরাকের হামলার বিপরীতে ইসরায়েল ইরাক আক্রমন করে তাহলে সম্মিলিত জোট থেকে আরব দেশ গুলো বেরিয়ে যাবে। যার কারনে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ ইসরায়েলকে প্রত্যুতর দিতে বারন করে। ইসরায়েলকে ইরাকের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমেরিকা ইসরায়েলে প্যাট্টিয়ট এয়ারডিফেন্স সিস্টেম ইনস্টল করে যা ইরাকের স্কাড মিসাইল প্রতিরোধ করে। একারনে সাদ্দাম হোসেনের ইসরায়েল আক্রমনের নীতি ব্যার্থ হয়ে যায়। এরপর সাদ্দাম হোসেন সৌদি আরবে আক্রমনের পরিকল্পনা করে যার নাম দেওয়া হয় খাফজির যুদ্ধ কিন্ত সৌদি আরবে আগে থেকেই প্রস্তত ছিল সম্মিলিত জোট। এয়ার স্ট্রাইকে এবং সৌদি আরবে আক্রমনে ব্যার্থ সাদ্দাম হোসেন ইরাকের সেনাবাহিনীকে কুয়েতের তেল ভান্ডারকে বিস্ফোরন করানোর নির্দেশ দেয়। এই অমানবিক ঘটনায় পুরো কুয়েত জ্বলতে শুরু করে।
২৮ ফেব্রুয়ারী সম্মিলিত জোটের সামনে কুয়েত থেকে পালিয়ে যায় ইরাকি সেনা এবং জর্জ বুশ কুয়েতের স্বাধীনতা ঘোষনা করে। গল্ফ যুদ্ধে ইরাক পরাজিত হয় যার কারনে ইরাকের অর্থনীতি ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার ফল আজও ভোগ করছে ইরাকি জনগন। সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য আমেরিকা ২০০৩ সালে আবারও অপারেশন শুরু করে যাকে ইরাক যুদ্ধ বলা হয়।