জাপানের বিরুদ্ধে লড়তে আমেরিকা বাদুড় দিয়ে বোমা বানাতে চেয়েছিল
হলিউডের বিখ্যাত ব্যাটম্যান বিগেনস সিনেমাতে ব্যাটম্যান বলছে সে প্রতীক হিসাবে বাদুড়কেই বেছে নিয়েছিল, কারন ছোটবেলা থেকেই সে বাদুরকে ভয় পেত যার কারনে সে চাইতো তার শত্রুও যেন তাকে ভয় পায়। আমাদের সমাজে বিভিন্ন প্রানীর মধ্যে বাদুড়কে ততটা পচ্ছন্দ করা হয়না, অনেকেই বাদুড়কে ভয় পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা উভয়েই বিভিন্ন সামরিক প্রজেক্টে পশু পাখি ব্যবহার করে পরীক্ষা করে। যেমন আমেরিকা একবার বেড়ালের মধ্যে মাইক্রোফোন বসিয়ে বেড়ালকে গোয়েন্দা হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিল, বেশ কয়েকটি নেকড়েকে রঙ করে জাপানি সেনাদের ভয় দেখানোর পরীক্ষাও করেছিল আমেরিকা। ঠিক তেমনি আমেরিকা একবার বাদুড়কেও ব্যাবহার করে তাদের শত্রুদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমেরিকার এই পরিকল্পনা সফল হয়নি বরং তাদের নিজেরাই সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল।
ঘটনার সূত্রপাত হয় আমেরিকার এক দাঁতের ডাক্তার ডঃ লেটেল এস অ্যাডামসের থেকে। লেটেল ডাক্তার হওয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞানীও ছিল। ডঃ লেটেল ১৯৩০ সালে আমেরিকার সরকারকে জানায় সে একটি পদ্ধতি তৈরি করেছে যাতে চিঠি অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যাবে। এই পদ্ধতির নাম বেশ জটিল ছিল। শিপ টু শিপ, শিপ টু সোর, সোর টু শিপ, এয়ার মেল ট্রান্সফার সিস্টেম এন্ড অ্যাপারেটাস নামক এই পদ্ধতিতে ডঃ লেটেল তাড়াতাড়িই চিঠি পৌঁছাছিল।
১৯৩৪ সালে আমেরিকান সরকার তাঁকে অনুমতি দেয় এই পদ্ধতি ব্যাবহারের যদিও সার্বিক ভাবে বৃহৎ পরিসরে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়নি। ডঃ লেটেলের এই নতুন পদ্ধতিতে প্রভাবিত হয় অ্যানা এলেনোর রুজভেল্ট যিনি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের স্ত্রী ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১ সালে জাপান আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দরে আক্রমন করে। জাপানের এই অমানবিক আক্রমনের পর আমেরিকার মানুষ রীতিমতো জাপানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ চাইছিলো। সেসময় একদিকে যেমন আমেরিকাতে তরুনরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে জাপানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চাইছিল অন্যদিকে বহু মানুষ আমেরিকান সরকারকে রীতিমতো চিঠি লিখে জাপানের বিরুদ্ধে কিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে তা জানাচ্ছিলো। ডঃ লেটেলও পার্ল হারবারের ঘটনার প্রতিশোধ নিতে চাইছিলো।
একদিন তিনি কার্লসবাড ক্যাভেরিনস জাতীয় পার্ক থেকে বাড়ি ফিরছিলেন সেসময় তিনি রাস্তায় প্রচুর বাদুড় দেখতে পান। আমেরিকার কার্লসবাড ক্যাভেরিনে দেশটির সবচেয়ে বেশী বাদুড় পাওয়া যায়। বাদুড় দেখেই ডঃ লেটেলের মাথায় একটি পরিকল্পনা আসে। তিনি ভাবেন আমেরিকাতে প্রচুর বাদুড় আছে, জাপান ভূমিকম্প প্রবন দেশ হওয়ায় দেশটির সিংহভাগ বাড়ি কাঠের তৈরি, বাদুড় সাধারনত ঘরের কোনে থাকে, তাহলে জাপানে এসব বাদুড় পৌঁছে দিয়ে যদি কোনও ভাবে আগুন ধরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে জাপানে ব্যাপক ক্ষতি হবে অর্থাৎ তিনি বাদুড়কে বোম্ব হিসাবে ব্যাবহারের সম্পর্কে ভাবেন।
এরপরের মাসেই জানুয়ারি, ১৯৪২ সালে তিনি আমেরিকান সরকারের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লেখেন যাতে তিনি বলেন যদি বাদুড়ের মধ্যে ছোট বোম্ব যুক্ত করে জাপানের উপর ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে জাপানের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট বিস্ফোরন ঘটবে যাতে জাপান সরকার বাধ্য হবে আমেরিকার সামনে আত্মসমর্পনে। ডঃ লেটেল এই চিঠি গিয়ে সরাসরি দেন এলানোর রুজভেল্টকে এবং তিনি এই চিঠি দেন তাঁর স্বামী ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের এই আইডিয়া এতটা পচ্ছন্দ হয়েছিল যে তিনি আমেরিকার ইনটেলিজেন্স বিভাগের প্রধানকে এই চিঠি দিয়ে ব্যাট বোম্ব তৈরির ব্যাপারে জানান।
ডঃ লেটেল নিজেও তাঁর এই প্রজেক্টের জন্য উপযুক্ত লোক খুঁজছিল। ডঃ লেটেল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান সেখানে তাঁর সাথে পরিচয় হয় অধ্যাপক ডঃ ডোনাল্ড রেডফিল্ড গ্রিফিনের। বলা হয় ডঃ ডোনাল্ড গ্রিফিন সেসময় আমেরিকায় বাদুড় বিষয়ে সবচেয়ে বেশী জানতেন। ডঃ ডোনাল্ড গ্রিফিনই প্রথম আবিষ্কার করেন বাদুড়ের চোখের দৃষ্টিশক্তি কম এবং বাদুড়ের শ্রবন ক্ষমতা অত্যন্ত বেশী। ডঃ ডোনাল্ডের পচ্ছন্দ হয় ডঃ লেটেলের ব্যাট বোম্ব তৈরির আইডিয়াটি। তিনিও আমেরিকার আমেরিকান সরকারকে চিঠি লিখে ব্যাট বোম্ব তৈরির বিষয়ে সমর্থন জানান। ব্যাট বোম্ব কথাটি শুনলেই হয়ত মনে হবে বাদুড়কে ধরে তার মধ্যে বোম্ব ইন্সটল করে জাপানের উপর ছেড়ে দেওয়া কিন্তু বিষয়টা এতটা সহজ ছিলনা। কিছু বাদুড়ের আকৃতি খুবই ছোট আবারা কিছু বাদুড়ের আকৃতি এতটাই বড় যে তাদের ডানার দৈর্ঘ্যই প্রায় ছয় ফুট। সাধারনত এত বড় আকৃতির বাদুড় ফিলিপিন্সে পাওয়া যায় এদের জায়েন্ট ফ্লাইং ফক্স ব্যাট বলা হয়। সুতরাং কোন প্রজাতির বাদুড়কে এই প্রজেক্টে ব্যবহার করা হবে তার খোঁজ শুরু করে ডঃ লেটেল ও ডঃ ডোনাল্ড, অবশেষে ব্যাট বোম্বের জন্য মেক্সিকোর ফ্রি টেল বাদুড় প্রজাতিকে বেছে নেওয়া হয়।
এই ধরনের বাদুড় আমেরিকাতে প্রচুর পাওয়া যেত এবং এই বাদুড় গুলি সর্বোচ্চ ১৮ গ্রাম ওজন বহন করতে সক্ষম ছিল। যার কারনে ১৮ গ্রাম কম ওজনের বোম্ব তৈরির কাজ শুরু হয়। আমেরিকান লুইস ফ্লিসার ও তার দল সাড়ে সতেরো গ্রাম ওজনের নেপ্লাম বোম্ব তৈরি করে। মে, ১৯৪৩ সালে এই বোম্বের প্রথম পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার জন্য সাড়ে তিন হাজার বাদুড়কে ধরা হয় এবং তাদেরকে আচ্ছন্ন রাখার জন্য ফ্রিজে ভরে পরীক্ষাগারে নিয়ে আসা হয়। সেখানে তাদের মধ্যে নেপ্লাম বোম্ব ইনস্টল করা হয়। এরপর একটি বিমানে সমস্ত বাদুড়কে নিয়ে পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় গিয়ে সেখান থেকে বাদুড় গুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই পরীক্ষায় অধিকাংশ বাদুড় পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে সরাসরি ভূমিতে এসে পড়ে কারন অনেক বাদুড়ের আচ্ছন্ন ভাবই কাটেনি তখনও, যার কারনে ব্যাট বোম্বের প্রথম পরীক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায়।
আমেরিকান সেনাবাহিনী ভাবে অনেক দূর থেকে বাদুড় ধরে এনে দীর্ঘক্ষন ফ্রিজে আচ্ছন্ন করে রাখার কারনে হয়ত এই পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে যার করনে পরবর্তী ব্যাট বোম্ব পরীক্ষা এমন জায়গায় করা হয় যেখানে খুব সহজেই প্রচুর বাদুড় পাওয়া যায়। কিন্তু এবার ভয়ানক বিপদের সম্মুখীন হয় আমেরিকান সেনাবাহিনী। বেশ কিছু বাদুড় নির্দিষ্ট জায়গাতেই যায় কিন্তু অনেক বাদুড় রানওয়ে, এয়ারফিল্ড, বাঙ্কারে গিয়ে ফেটে যায় যার কারনে আমেরিকান সেনাবাহিনীর যথেষ্ট ক্ষতি হয় এবং সামরিক বাহিনী এই ব্যাট বোম্ব প্রজেক্ট বন্ধের নির্দেশ দেয়। এরপর এই প্রজেক্টের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমেরিকান নেভিকে। নৌবাহিনী এই প্রজেক্টের নাম দেয় এক্স রে।
ডিসেম্বর, ১৯৪৩ সালে প্রজেক্ট এক্সরের প্রথম পরীক্ষা করা হয় তবে এবারেও তেমন সফল হয়নি এই বোম্ব। ১৯৪৪ সালের আগস্ট মাসে আমেরিকান নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল আর্নেস্ট জে কিং জানিয়ে দেয় প্রজেক্ট এক্স রের আর পরীক্ষা করা হবেনা৷ ততদিনে আমেরিকা পরমানু বোম্বের উপর কাজ করছিল এবং ১৯৪৫ সালে শেষপর্যন্ত জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পরমানু বোম্ব ফেলার মাধ্যমে পার্ল হারবারের ঘটনার প্রতিশোধ নেয় আমেরিকা এবং জাপান আত্মসমর্পন করে। এই কারনে ব্যাট বোম্ব আর কোনওদিন তৈরিই করা হয়নি।