অফবিট

সিরিয়ার পরমানু প্রোজেক্ট ধ্বংস করে দিতে ইসরায়েলের গোয়েন্দাদের দুর্ধর্ষ অপারেশান

দিনটা ২২ এপ্রিল, ২০০৪ উত্তর কোরিয়ার রিয়ং চিয়ং এলাকায় এক মালগাড়িতে হঠাৎই তীব্র বিস্ফোরন হয়। বিস্ফোরনের তীব্রতা এতটাই বেশী ছিল যে রিখটার স্কেলে এর মাত্রা দেখায় ৩.৬, এই ঘটনার পরেই উত্তর কোরিয়ার সরকার বিবৃতি দিয়ে জানায় মালগাড়িতে তরল পেট্রোলিয়াম ছিল, বিদ্যুৎ এর তারে শটসার্কিট হওয়ায় এই বিস্ফোরন হয়েছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া এই ঘটনা নিয়ে বিশেষ কোন অনুসন্ধানের আগেই উত্তর কোরিয়া সরকার এই বিস্ফোরনের ঘটনাস্থল বন্ধ করে দেয় এবং পুরো দেশে আগামী পাঁচ বছরের জন্য মোবাইল পরিষেবা বন্ধ করে দেয়। আন্তর্জাতিক স্তরে এই ঘটনা নিয়ে বিশেষ আলোচনা না হলেও উত্তর কোরিয়া থেকে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি দেশ ইসরায়েল উত্তর কোরিয়ান সরকারের এই বিবৃতি বিশ্বাস করতে পারছিল না। যার কারনে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এই ঘটনার অনুসন্ধান আরাম্ভ করে। 

মোসাদের প্রধান মীর দোগান নিজে এই অনুসন্ধানের নেতৃত্বে ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক ইনটেলিজেন্স সংস্থা বলা হয় মোসাদকে। মোসাদের নেটওয়ার্ক এতটা শক্তিশালী যে আজ পর্যন্ত আশেপাশের কোন আরবদেশ ইসরায়েলকে পরাস্ত করতে পারেনি। মোসাদ ইসরায়েলের শত্রুদের খুঁজে খুঁজে শেষ করে তা সে যত বছরই সময় লাগুক। মোসাদ যখন উত্তর কোরিয়ার ট্রেন বিস্ফোরনের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করে তখন মোসাদ একটা তথ্য জানতে পারে যে সিরিয়ার একটি বিমান এই ঘটনার কিছু মাস আগেই উত্তর কোরিয়ায় এসেছিল। সাথে সাথে মোসাদ তাদের নজরদারি আরও বাড়িয়ে দেয়। ইসরায়েল তৈরির পর থেকে ইসরায়েলের উপর আশেপাশের আরব দেশ গুলো যেমন মিশর, জর্ডান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, লেবানন একাধিক বার আক্রমন করেছে, তারপর থেকেই মোসাদ সমস্ত আরবদেশে তাদের ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। মোসাদ দীর্ঘদিন ধরেই জানতো কিছু আরব দেশ পরমানু শক্তি অর্জনের চেষ্টা করছে। এর আগে ১৯৮১ সালে সাদ্দাম হোসেন চেষ্টা করেছিল ইরাকে পরমানু বোম্ব তৈরি করতে কিন্তু তখনও ইসরায়েল ইরাকের পরমানু কার্যক্রম ধ্বংস করে দিয়েছিল। তারপর দীর্ঘদিন ধরে কোনও আরব দেশ পরমানু বোম্ব তৈরি করার চেষ্টাও করেনি।

২০০০ সালে সিরিয়ার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাসার আল আসাদ উত্তর কোরিয়ার সাথে যোগাযোগ শুরু করে পরমানু বোম্ব তৈরির জন্য। সিরিয়া উত্তর কোরিয়ার সাথে এতটা গোপনে যোগাযোগ শুরু করে যে আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ, ইসরায়েলের মোসাদ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি। সিরিয়ার মতোন দেশ যে গোপনে পরমানু বোম্ব তৈরি করার চেষ্টা করছে সেটা কেউ ভাবতেও পারেনি। সর্বপ্রথম সিআইএ ২০০৪ সালে জানায় সম্ভবত সিরিয়া পরমানু বোম্ব তৈরি করছে। কিন্তু পরমানু কার্যক্রম করবার মতোন কিছু প্রমান সিরিয়াতেও পাওয়া যায়নি। 

২০০৪ সালের ২২ এপ্রিল উত্তর কোরিয়ায় যে বিস্ফোরন হয়েছিল তার তীব্রতা এতটাই ছিল যে তাতে পুরো একটি গ্রাম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এই বিস্ফোরনে গ্রামে থাকা দশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। উত্তর কোরিয়া এই পুরো ঘটনা চেপে দিয়েছিল কিন্তু মোসাদ দুই বছর ধরে অনুসন্ধান এই তথ্য জানতে পারে এবং তারা এটাও খোঁজ পায় যে ২০০৪ থেকে ২০০৬ এর মধ্যে সিরিয়া ও উত্তর কোরিয়ার শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়েছে কোন গোপন বিষয়ে। তখনই মোসাদ ধারনা করে সম্ভবত উত্তর কোরিয়ার থেকে পরমানু প্রযুক্তি নিচ্ছে সিরিয়া এবং ওই ট্রেনে কোন তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরন হয়েছে কারন সাধারন পেট্রোল ট্রেনে বিস্ফোরনের তীব্রতা এতটা ভয়াবহ হয়না। আরও কয়েক মাস তদন্তের পর মোসাদ সিরিয়ার একজন শীর্ষস্থানীয় জেনারেলকে টার্গেট করে এবং হানি ট্রাপের মাধ্যমে সেই ব্যক্তির ল্যাপটপ থেকে জানা যায় সিরিয়া উত্তর কোরিয়ার সাথে এক বিলিয়ন ডলারের পরমানু বোম্ব তৈরির চুক্তি করেছে। একটি মাটির নীচের পরীক্ষা কেন্দ্রের তথ্য পাওয়া যায় কিন্তু সিরিয়া ততদিনে পরমানু বোম্ব তৈরি করে ফেলেছে কিনা এবং পরমানু কার্যক্রম সিরিয়ার ঠিক কোন জায়গায় হচ্ছে সেটা জানা যায়নি। এব্যাপারে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ ইসরায়েলকে সহায়তা করে। রীতিমতো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অনুসন্ধানের পর জানা যায় সিরিয়ার ইউফ্রেরিস নদীর তীরে অবস্থিত আল কাবির মরুভূমিতে এই পরমানু কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। 

পশ্চিম এশিয়ার দীর্ঘতম নদী ইউফ্রেটিস এবং টাইগ্রিস নদীর তীরেই অতীতের মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এই আল কাবির মরুভূমি সিরিয়ার চোদ্দটি প্রদেশের মধ্যে একটি প্রদেশ দিয়ার এজ জোরে অবস্থিত। পূর্ব সিরিয়ায় ইরাক সীমান্তবর্তী এই প্রদেশে জনসংখ্যা খুবই কম। মোসাদ জানতে পেরে যায় সিরিয়ায় পরমানু কার্যক্রমের অবস্থান কিন্ত পরমানু বোম্ব সিরিয়া তৈরি করে ফেলেছে কিনা সেটা তখনও জানা যায়নি। এই তথ্য পাবার জন্য ইসরায়েলের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনা ইউনিট সায়েরেত মাতকালকে ডাকা হয়। 

সায়েরেত মাতকাল ইসরায়েলের অত্যন্ত শক্তিশালী বিশেষ সেনা ইউনিট যাদের গুরুত্বপূর্ন মিশনে ব্যবহার করা হয়। সায়েরেত মাতকালের কম্যান্ডোদের দায়িত্ব দেওয়া হয় আল কাবির মরুভূমি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে আসার। পরমানু বোম্ব তৈরি হয়েছে কিনা তা পরীক্ষাকেন্দ্রের আশেপাশের অঞ্চলের মাটি, জলের নমুনায় তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা করলে বোঝা যায়। এই নমুনা সংগ্রহ করবার কাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ন ছিল কারন সিরিয়ার সেনাবাহিনী, ইনটেলিজেন্ট ইউনিটকে ফাঁকি দিয়ে এই জায়গা থেকে ফাঁকি দিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে হবে, যদি ইসরায়েলের কোনও এজেন্ট ধরা পড়ত তাহলে আন্তর্জাতিক স্তরে ইসরায়েলকে দোষী সাব্যস্ত করে সিরিয়া যুদ্ধ ঘোষনা করতো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল সিরিয়ার এয়ারডিফেন্স সিস্টেমকে এড়িয়ে হেলিকপ্টারকে করে এই স্থানে পৌঁছানো। 

২০০৭ সালের আগস্ট মাসে সায়েরেত মাতকালের বিশেষ কম্যান্ডোরা আল কাবির থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ফিরে আসে। নমুনা পরীক্ষা করে জানা যায় পরমানু বোম্ব তখনও তৈরি হয়নি তবে সিরিয়ার ওই পরমানু পরীক্ষাকেন্দ্রে প্লুটোনিয়াম রিয়্যাক্টার পরমানু বোম্ব তৈরির শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। এরই মধ্যে মোসাদ খবর পায় উত্তর কোরিয়া থেকে একটি শেষ সাপ্লাই এসেছে যাতে পূর্ন পরমানু বোম্ব তৈরি করা যাবে। এই খবর পাওয়ার সাথে সাথেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মোসাদকে সিরিয়ায় অপারেশনের আদেশ দিয়ে দেয়। 

মোসাদ এয়ারস্ট্রাইকের মাধ্যমে সিরিয়ার পরমানু কার্যক্রম ধ্বংসের পরিকল্পনা করে। সেই মতো ইসরায়েলের রামাত ডেভিড এয়ারবেস থেকে ৬ সেপ্টেম্বর রাত বারোটার সময় দশটি এফ ১৫ যুদ্ধবিমান সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় কিন্ত তিনটি এফ ১৫ বিমানে সমস্যা থাকায় সেগুলো বেসে ফিরে আসে এবং বাকী সাতটি বিমান সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যায়। প্রতিটি এফ ১৫ এ লেজার গাইডেড বোম্ব, মিসাইল, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম ছিল। আল কাবির মরুভূমির কাছে সিরিয়ার একটি রেডার সিস্টেমকে এফ ১৫ প্রথমে জ্যাম করে বোম্বিং এর মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়, এরপর পরমানু পরীক্ষাকেন্দ্রে একের পর এক বোম্বিং করে এফ ১৫.কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো পরমানু কেন্দ্র ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েল। 

২০০১ সাল থেকে সিরিয়ার এত পরিশ্রম মাত্র কয়েক মিনিটে ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েল। ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান সিরিয়ায় গিয়ে নিরাপদে অপারেশন শেষ করে ফিরে আসে এই সম্পূর্ন সময় সিরিয়ার এয়ারডিফেন্স সিস্টেমকে জ্যাম করে দিয়েছিল এফ ১৫। এই পুরো অপারেশনের নাম দেওয়া হয় অপারেশন আউট সাইড দি বক্স বা অপারেশন ওরচার্ড। 

৬ সেপ্টেম্বর সকালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইহুদ ওলমার্ট এই অপারেশনের খবর সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাসার আল আসাদকে জানায়। বাসার আল আসাদ পুরো ঘটনা জেনেও চুপ ছিল মিডিয়াতে কিছু জানায়নি কারন ইসরায়েল সিরিয়ায় ঢুকে এয়ারস্ট্রাইক করেছে এই খবর প্রকাশ হলে আন্তর্জাতিক স্তরে সিরিয়ার সম্মান নষ্ট হত। তবে মোসাদ এই অপারেশনের পরও সিরিয়ার উপর নজর রেখেছিল কারন মোসাদ জানতো সিরিয়া আবারও চেষ্টা করবে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইহুদ ওলমার্ট তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসপ তাইপে এরদোগানকে জানায় বাসার আল আসাদকে পুনরায় পরমানু কার্যক্রম শুরু না করার ব্যাপারে বলতে। কিন্তু বাসার আল আসাদ ২০০৮ সালেই আবারও পরমানু কার্যক্রম শুরু করে। মোসাদ জানতে পারে সিরিয়ার পরমানু কার্যক্রমের মাস্টার মাইন্ড মহম্মদ সুলেমান যে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর শীর্ষ ব্যাক্তি। বাসার আল আসাদ মহম্মদ সুলেমানের উপর নির্ভরশীল অনেকাংশে। মহম্মদ সুলেমানকে হত্যা করার জন্য মোসাদ আরেকটি পরিকল্পনা তৈরি করে। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে মহম্মদ সুলেমান যখন ছুটি কাটাতে তার বাড়িতে যায় তখন মোসাদের স্নাইপার ইউনিট হত্যা করে মহম্মদ সুলেমানকে। এরপরে সিরিয়ায় পরমানু কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় চিরদিনের মতোন৷ মজার ব্যাপার হল সিরিয়া মহম্মদ সুলেমানের হত্যার ব্যাপার আজও স্বীকার করেনি। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *