অফবিট

মেশিন গান থেকে শুরু করে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত হওয়া দশটি নতুন অস্ত্র এবং প্রযুক্তি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে মানব ইতিহাসে যত যুদ্ধ হয়েছিল সেগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো এত দীর্ঘসময় ধরে চলেনি। ১৯১৪ সালে শুরু হয়ে চার বছর পর ১৯১৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল। ১৯১৪ সালের আগে মানব ইতিহাসে হওয়া সমস্ত যুদ্ধ কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস কিংবা সর্বোচ্চ এক বছর ধরে হয়েছিল। তবে একমাত্র এথেন্স ও স্পার্টানদের মধ্যে হওয়া পেলোপোনেসিয়ান যুদ্ধ বহু বছর ধরে চলেছিল, এছাড়া কোনও যুদ্ধই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতোন এত দীর্ঘ সময় ধরে চলেনি এবং এত ভয়াবহ হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অতীতের সমস্ত যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘতম ও ভয়াবহ ছিল কারন এই যুদ্ধে বিশ্বের বেশীরভাগ দেশ যুক্ত ছিল যার জন্য এর নাম বিশ্বযুদ্ধ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আধুনিক প্রযুক্তি ও মারনাস্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছিল যা অতীতে কোনও যুদ্ধে কখনও ব্যবহার করা হয়নি। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এমন দশটি নতুন অস্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে কখনও করা হয়নি:—- 

১) রাসায়নিক অস্ত্র :—- প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সর্বপ্রথম ক্ষতিকর রাসায়নিক গ্যাসকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হয়। গ্রেনেড, আর্টিলারির মধ্যে ক্ষতিকর ফসজিন, ক্লোরিন ও মাস্টার্ড গ্যাসকে ব্যবহার করা হত। এসব গ্যাস মানুষের ফুসফুস, চোখ, কান, নাক ও গলার ক্ষতি করে। এছাড়া এসব ক্ষতিকর গ্যাসের প্রভাবে চামড়ায় ফোস্কা পড়ে যেত এবং শ্বাসরোধ হয়ে মানুষের মৃত্যুও হত। জার্মানি সর্বপ্রথম রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ শুরু করে ইয়াপরেসের যুদ্ধে। এরপর ধীরে ধীরে মিত্রশক্তি অর্থাৎ ব্রিটেন, ফ্রান্সও এসব ক্ষতিকর গ্যাসের প্রয়োগ শুরু করে। এই রাসায়নিক অস্ত্রের প্রভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৯০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৪০,০০০ মানুষ আহত হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে টিয়ার গ্যাসও ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে সাধারন যুদ্ধাস্ত্রের তুলনায় রাসায়নিক অস্ত্র ততটা কার্যকরী হয়নি প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে কারন একটা সময় পর উভয়পক্ষের সেনাই বিশেষ মাস্ক ব্যবহার শুরু করে রাসায়নিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জেনেভা সম্মেলনে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু তারপরেও রাসায়নিক অস্ত্রের উন্নয়ন হতেই থাকে। আজও বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তে যুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের কথা শোনা যায়। 

২) মেশিন গান:—- প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মেশিন গানের ব্যবহার ব্যাপক পরিমানে শুরু হয়। মেশিন গানের আগে এই ধরনের একটি বন্দুক ছিল যার নাম ছিল গ্যাটলিং গান কিন্তু এটির ওজন অত্যন্ত বেশী ছিল এবং এটি চালাতে অনেকজন লোক লাগতো। এরপর ব্রিটিশরা তৈরি করে ভিকারস গান কিন্তু এটি চালাতেও ছয়জন লোকের প্রয়োজন ছিল, এরপর আমেরিকানরা তৈরি করে লইস গান কিন্তু এটাও অতটা নির্ভরযোগ্য ছিলনা। এরপর তৈরি করা হয় মেশিনগান, একটি সৈন্য মেশিনগান কোনও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে শত্রুর দিকে ফায়ার করতো একটানা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সোম্মের যুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনীর মেশিনগানের সামনে ব্রিটিশ সেনা ব্যাপক সমস্যায় পড়েছিল। আজ বিশ্বের সমস্ত দেশের সেনাবাহিনীতেই অত্যাধুনিক মেশিনগান রয়েছে। 

৩) ফ্লেম থ্রোয়ার:—- এই ধরনের অস্ত্রে একটি বন্দুকের মধ্যে দিয়ে আগুন বের হয় যা আশেপাশের জিনিস পুড়িয়ে দেয়। যদিও অতীতে চীন ও বাইজেনটিয়ান সাম্রাজ্যের মানুষ আগুনের এরকম ব্যবহার জানতো কিন্তু আগুনকে বন্দুকের মাধ্যমে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই ব্যাপক আকারে শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তী অনেক যুদ্ধেও ফ্লেম থ্রোয়ার ব্যবহার করা হয়েছিল। 

৪) ট্রেশার বুলেটস:—- বন্দুক থেকে গুলি চালানোর পর তা সোজা গিয়ে লক্ষ্যবস্তকে গিয়ে আঘাত হানে। বন্দুক থেকে গুলি নির্গত হওয়ার পর লক্ষ্যবস্ততে আঘাতহানা পর্যন্ত গুলির যাত্রাপথকে ট্রাজ্যেক্টরি বলা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তীব্র বোম্বিং এবং রাতের বেলায় যখন উভয়দলের সেনাবাহিনী ফায়ারিল করতো তখন প্রায়সময়ই সেনারা বুঝতে পারতোনা তাদের গুলি শত্রুকে আঘাত হেনেছে কীনা। এর জন্য ট্রেশার বুলেটস তৈরি করা হয়। এই ধরনের গুলির পিছনে হালকা সাদা ধোঁয়া বের হত যাতে একজন ব্যক্তি বন্দুকের গুলির ট্রাজ্যেক্টরি বুঝতে পারতো। বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাতের বেলায় ট্রেশার বুলেটস এর ব্যবহার খুব বেশী পরিমানে হওয়া শুরু হয়। আজও সব দেশের সেনাবাহিনী মেশিনগানে অল্পকীছু সংখ্যক ট্রেশার বুলেটস ব্যবহার করে। 

৫) ট্যাঙ্ক:—- আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যেক দেশের সেনাবাহিনীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ন অস্ত্র হচ্ছে ট্যাঙ্ক। এই ট্যাঙ্কের প্রথম ব্যবহার শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সর্বপ্রথম মার্ক ১ ট্যাঙ্ক তৈরি করে। তবে প্রথমদিকে এই ট্যাঙ্ক ততটা কার্যকর ছিলনা। কিন্তু যুদ্ধের অগ্রগতির সাথে সাথে ব্রিটিশদের ট্যাঙ্ক প্রযুক্তিও আধুনিক হয়ে যায়। ব্রিটেন মার্ক ১ ট্যাঙ্ককে আরও উন্নত করে মার্ক ৪ ট্যাঙ্ক তৈরি করে ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন ১,২০০ টি মার্ক ১ ও ৪ ট্যাঙ্ক তৈরি করেছিল। ১৯১৭ সালে কামব্রাই এর যুদ্ধে ব্রিটেন ৪৬০টি মার্ক ৪ ট্যাঙ্ক মোতায়েন করেছিল জার্মানির বিরুদ্ধে। ফ্রান্সও ১৯১৫ সালে রেনল্ট লাইট ট্যাঙ্ক তৈরি করেছিল। যুদ্ধ চলাকালীন ফ্রান্স ৩,০০০ এর আেশী ট্যাঙ্ক তৈরি করেছিল। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে একটি শক্তিশালী ট্যাঙ্ক বাহিনী ছিল। কিন্ত জার্মানদের ট্যাঙ্ক প্রযুক্তি তেমন কিছু ছিলনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। 

জার্মানি এইসময় এ৭ভি ট্যাঙ্ক তৈরি করেছিল কিন্তু জার্মান ট্যাঙ্ক প্রযুক্তি ততটা দক্ষ ছিলনা। জার্মানি মাত্র ২০টি এ৭ভি ট্যাঙ্ক তৈরি করেছিল।

কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরো বিপরীত ঘটনা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান নাজি সেনাবাহিনীর কাছে একটি শক্তিশালী ট্যাঙ্ক ইউনিট ছিল। মিত্রশক্তি বিশেষ করে ফ্রান্স জার্মান ট্যাঙ্কবাহিনীর সামনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।

৬) ডেপথ চার্জ :—- প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সাবমেরিন বা ইউবোট বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনী ব্রিটিশ নৌবাহিনীকেও ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। জলের তলায় জার্মান সাবমেরিন লুকিয়ে টর্পেডো ছুঁড়ে পালিয়ে যেত যাতে মিত্রশক্তির বহু জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। এজন্য ডেপথ চার্জ তৈরি করা হয়। ডেপথ চার্জ একটি বোম্বের মতো, সমুদ্রের যেখানে সাবমেরিন আছে সেখানে যুদ্ধজাহাজ থেকে ডেপথ চার্জ নিক্ষেপ করা হয় জলের তলায়। সাবমেরিনের কাছাকাছি এসে ডেপথ চার্জ বিস্ফোরিত হয়ে যায় যাতে সাবমেরিন জলের তলাতেই ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে বিশ্বের সব নৌবাহিনীই তাদের যুদ্ধজাহাজে ডেপথ চার্জ প্রযুক্তি ব্যবহার করে। 

৭) এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল:—- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের কোনও ব্যবস্থাই ছিলনা। যার জন্য এইসময় একবার কোনও বিমান আকাশে ওড়ার পর সে ভূমি থেকে সম্পূর্ন রূপে বিচ্ছিন হয়ে পড়তো। পরে পাইলট রেডিও টেলিগ্রাফ ব্যবহার শুরু করে। ১৯১৭ সালে প্রথমবার কোনও পাইলট বিমান থেকে সরাসরি ভূমিতে থাকা সংযোগ স্টেশনে নিজের আওয়াজ পৌঁছায়। এভাবেই শুরু হয় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থা। 

৮) এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার :— এই ধরনের যুদ্ধজাহাজে যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থাকে যা শত্রুর জলসীমায় ঢুকে আক্রমন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন বিশ্বের প্রথম এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এইচএমএস ফিউরিয়াস তৈরি করে। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে কোনও দেশের নৌবাহিনীর মেরুদণ্ড বলা হয়। তবে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার অত্যন্ত ব্যায়বহুল এজন্য বিশ্বের খুব কম সংখ্যক দেশের নৌবাহিনীতেই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীতে দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রয়েছে। সবচেয়ে বেশী এগারোটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রয়েছে আমেরিকার নৌবাহিনীতে। 

৯) ভ্রাম্যমান এক্সরে মেশিন:— প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শুধু ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের ব্যবহারই হয়নি বরং এমন কিছু প্রযুক্তিরও ব্যবহার হয়েছিল যেগুলো আজও মানব সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এক্সরে মেশিনের আকার খুব বড় ছিল, এই জন্য এক্সরে মেশিন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেকটা দূরে রাখা থাকতো। কিন্ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আহত সেনাকে এক্সরে সেন্টারে নিয়ে আসাই সমস্যা ছিল। এই জন্য মাদম কুরী ছোট ছোট এক্সরে মেশিন তৈরি করেন যাতে গাড়ি করে এইসব মেশিন একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। মাদাম কুরীর এক্সরে মেশিনের কারনে আহত সেনাদের চিকিৎসায় সুবিধা হয়। বর্তমানে এক্সরে মেশিন চিকিৎসা বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ন অঙ্গ। 

১০) ড্রোন নির্মান :—- ১৯১৬ সালে আমেরিকার পিটার হিউইট এবং এলমার স্পেরি আমেরিকার নৌবাহিনীর জন্য একটি ড্রোন তৈরি করেছিল। আমেরিকার লং দ্বীপে ১৯১৮ সালের ৬ মার্চ এই ড্রোনটি পরীক্ষাও করা হয়। ১৮.৫ ফুট লম্বা এই ড্রোনটির ওজন ছিল ১৭৫ পাউন্ড। যদিও সেই সময়ে এই ড্রোন ঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি। কিন্তু ড্রোন তৈরির একটা প্রাথমিক ধারনা বিশ্ব তখনই পেয়ে যায়। ১৯২৫ সালে এই ড্রোন প্রজেক্ট বন্ধ করে দেয় পিটার ও এলমার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *