অফবিট

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বড় নৌযুদ্ধ কোন কোন দেশের মধ্যে হয়েছিল জানেন?

বর্তমানে প্রায় সমস্ত শক্তিশালী দেশেরই প্রতিরক্ষা বিভাগ তিনটি ভাগে বিভক্ত স্থলসেনা, বায়ুসেনা ও নৌসেনা। আধুনিক যুদ্ধে বলা হয় আকাশে নিয়ন্ত্রন রয়েছে যে দেশের সেই দেশই যুদ্ধে এগিয়ে থাকে। কিন্তু অতীতে যুদ্ধে নৌসেনার গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। ইউরোপীয়ান দেশগুলো ষোলো শতক থেকে তাদের নৌবাহিনীর জোরে গোটা বিশ্বে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ইউরোপীয়ান শক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী ছিল ব্রিটেন কারন ব্রিটেনের নৌবাহিনী ছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনী। শক্তিশালী নৌবাহিনীর কারনেই ব্রিটেন ভারত, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া সহ বিশ্বের এক চতুর্থাংশ জায়গায় তাদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ব্রিটেন নিজে ইউরোপের মূল ভূখন্ড থেকে ইংলিশ চ্যানেল দ্বারা বিচ্ছিন্ন একটি দেশ কিন্তু ব্রিটেনের উপনিবেশ এত বড় ছিল যে বলা হত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনও সূর্যাস্ত হয়না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর কাছে বিপক্ষ বিশেষ করে জার্মান নৌবাহিনীর পারাজিত হয় প্রতিবার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই স্থলসেনা ও নৌসেনার পাশাপাশি বায়ুসেনারও আত্মপ্রকাশ ঘটে। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্রিটিশ নৌবাহিনী সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল, প্রায় সমস্ত দেশই জানতো ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে হারানো প্রায় অসম্ভব। ইউরোপীয়ান দেশগুলো বিশেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানিও ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে ভয় খেত। যদিও ব্রিটিশ নৌবাহিনীর পর ফ্রান্সের নৌবাহিনীই সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল তবুও ব্রিটেনকে হারাবার জন্য তা যথেষ্ট ছিলনা। 

একবার জার্মানির রাজা ব্রিটেন সফরকালীন ব্রিটেনের নৌশক্তি দেখার পর জার্মানিও দেশে ব্রিটেনের মতোই যুদ্ধজাহাজ তৈরি শুরু করে। জার্মানিও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ব্রিটেনের মতোই উপনিবেশ তৈরির। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রধান পাঁচটি কারনের একটি ছিল ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলো সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করা। এইসময় ব্রিটেন একটি নতুন ধরনের যুদ্ধজাহাজ তৈরি করে যার নাম এইচএমএস ড্রেডনট। ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে থাকা সমস্ত যুদ্ধজাহাজ ও বিশ্বের বাকী সমস্ত যুদ্ধজাহাজ থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল এই এইচএমএস ড্রেডনট। তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে দ্রুতগতির যুদ্ধজাহাজ ছিল এইচএমএস ড্রেডনট, এই যুদ্ধজাহাজে শক্তিশালী কবচ ছিল এবং ভারী মেশিনগান ছিল। ব্রিটেনের দেখাদেখি জার্মানিও ড্রেডনটের মতো যুদ্ধজাহাজ নির্মান শুরু করে এইসময়। ব্রিটেন ও জার্মান নৌবাহিনীর মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় যুদ্ধজাহাজ তৈরি করার। সেসময় আরও এক ধরনের যুদ্ধজাহাজ তৈরি করা হয় যার নাম ব্যাটেল ক্রজার। ক্রজার একটি বিশাল আয়তনের যুদ্ধজাহাজ যতে প্রচুর অস্ত্র থাকতো। বিশালাকৃতির ক্রুজারগুলির গতি বৃদ্ধির প্রয়োজনে ক্রজারগুলির কবচ এইচএমএস ড্রেডনটের মতো মজবুত ছিলনা। 

১৯১৪ সালের জুলাই মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেই আগস্ট মাসে জার্মানির আশপাশে সমুদ্রপথ অবরুদ্ধ করে দেয় ব্রিটিশ নৌবাহিনী। বাইরে থেকে অস্ত্র সহ খাদ্যদ্রব্য সমস্ত কিছু আমদানি জার্মানিতে আটকে দেয় ব্রিটেন। এই কারনে জার্মানি সমস্যায় পড়ে কিন্তু জার্মানির থেকেও অসুবিধায় পড়ে আমেরিকা। আমেরিকা জার্মানিকে খাদ্যদ্রব্য, অস্ত্র বিক্রি করতো ব্রিটেনের কারনে আমেরিকার রপ্তানিতে সমস্যা হয়। তবে ব্রিটেন আমেরিকার বিরুদ্ধে যায়নি কারন ব্রিটেন জানতো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাদের আমেরিকাকে প্রয়োজন। এই জন্য ব্রিটেন আমেরিকার রপ্তানিকৃত দ্রব্য নিজেরা কিনে নিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দুই বছর ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অবরোধের কারনে ব্যাপক সমস্যায় পড়েছিল জার্মানি। জার্মান ও ব্রিটিশ নৌবাহিনীর মধ্যে এইসময় কয়েকটি ছোট সংঘর্ষও হয়েছিল কিন্ত প্রতিবারই ব্রিটেন জয়লাভ করেছিল কারন খোলা সমুদ্রে ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে হারানো ছিল একপ্রকার অসম্ভব। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ও জার্মান নৌবাহিনীর মধ্যে প্রথম সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয়েছিল ১৯১৬ সালে যাকে জাটল্যান্ডের যুদ্ধ বলা হয়। জাটল্যান্ড উপদ্বীপের পশ্চিমে উত্তর সাগরে এই যুদ্ধ হয়েছিল এইজন্য এই যুদ্ধের নাম হয় জাটল্যান্ডের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে উভয়পক্ষের প্রায় ২৫০টি জাহাজ অংশ নিয়েছিল। সেসময় ব্রিটেনের বিশাল নৌবাহিনীর প্রধান ছিল অ্যাডমিরাল জন জেলিকো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লন্ডনে একটি বিশেষ ঘরে অনেক ব্যক্তি জার্মান সংকেত ডিকোড করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পাঠাতো, এই ঘরকে রুম ৪০ বলা হত। অ্যাডমিরাল জন জেলিকোও রুম ৪০ থেকে জার্মানদের ব্যাপারে তথ্য পেত প্রতিনিয়ত। ১৯১৬ সালের জানুয়ারি মাসে জার্মান নৌবাহিনীর একটি বিশাল যুদ্ধজাহাজ বহরের দায়িত্ব দেওয়া হয় রেইনহার্ড শিয়ারকে। দায়িত্ব পেয়েই শিয়ার জার্মানির রাজা কাইজার উইলিয়াম দ্বিতীয়কে জানায় জার্মানি এতদিন যুদ্ধে ব্রিটেনের থেকে পিছিয়ে আছে কারন জার্মান নৌবাহিনী ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে পূর্নাঙ্গ ভাবে আক্রমন করেনি৷ রেইনহার্ড শিয়ার কাইজার উইলিয়াম দ্বিতীয়র কাছে উত্তর সাগরে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমনের অনুমতি চায়। রেইনহার্ড শিয়ারের পরিকল্পনা ছিল জার্মান নৌবাহিনীর সমস্ত বড়বড় যুদ্ধজাহাজকে নিয়ে একটি শক্তিশালী নৌবহর তৈরি করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে উত্তর সাগরে ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে আক্রমন করা যাতে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অবরোধ ভেঙে যায়। কিন্তু রেইনহার্ড শিয়ার জানতোনা সে যে পরিকল্পনার কথা জার্মানির রাজা কাইজার উইলিয়াম দ্বিতীয়কে বলছে তা লন্ডনের রুম ৪০তে বসে থাকা ব্রিটিশ এজেন্টরা সব শুনতে পেয়ে যাচ্ছে। রুম ৪০ থেকে এই পুরো পরিকল্পনার খবরই অ্যাডমিরাল জন জেলিকো জানতে পেরে যায়। 

১৯১৬ সালের ৩১মে জার্মানির হাই সী ফ্লীট উত্তর সাগরে ব্রিটিশ গ্রান্ড ফ্লীটকে আক্রমন করে। ব্রিটিশ নৌবাহিনী আগে থেকেই প্রস্তত ছিল তারা পরিকল্পনার খবর আগে থেকেই জানতে পেরে গিয়েছিল। উত্তর সাগরে ব্রিটিশ গ্রান্ড ফ্লীটে অন্তত ১৫১টি যুদ্ধজাহাজ ছিল বিপরীতে জার্মান হাই সী ফ্লীটে ৯৯টি যুদ্ধজাহাজ ছিল। ৩১মে উভয় নৌবাহিনীর মধ্যেই জাটল্যান্ডের যুদ্ধ শুরু হয়। একদিনের এই যুদ্ধে রেইনহার্ড শিয়ার বুঝে যায় ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে পরাজিত করা অসম্ভব। সেজন্য ১ জুন সন্ধ্যাবেলায় রেইনহার্ড শিয়ার সমস্ত জার্মান যুদ্ধজাহাজকে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়। তবে একদিনের এই যুদ্ধে জার্মানির তুলনায় ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশী হয়েছিল। জাটল্যান্ডের যুদ্ধে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ৬,০৯৪ জন সেনা মারা গিয়েছিল , ৬৭৪ জন আহত হয়েছিল, ১৭৭ জন জার্মান নৌবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিল এবং ১৪টি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এর বিপরীতে জার্মান নৌবাহিনীর ২,৫৫১ জন সেনার মৃত্যু হয়েছিল, ৫০৭ জন আহত হয়েছিল এবং ১১টি যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তবে জার্মান নৌবাহিনীরর দশটি যুদ্ধজাহাজ এতবেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে এগুলো আর ঠিক করা সম্ভব ছিলনা। জাটল্যান্ডের যুদ্ধে ব্রিটিশ ও জার্মান উভয়পক্ষই নিজেদের বিজয় দাবী করে। জার্মানি তাদের বিজয় দাবী করে কারন তাদের হতাহতের সংখ্যা ব্রিটিশদের তুলনায় অনেক কম ছিল। ব্রিটেন তাদের জয় দাবী করে কারন জার্মান নৌবাহিনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল উত্তর সাগরে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অবরোধকে ভাঙা যাতে তারা সফল হতে পারেনি। জাটল্যান্ডের যুদ্ধের পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আর কখনও খোলা সমুদ্রে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস করতে পারেনি জার্মান নৌবাহিনী। জার্মানি ইউবোট বা সাবমেরিন তৈরি করে মিত্রশক্তির জাহাজের উপর আক্রমন করা শুরু করে। জার্মান ইউবোট মিত্রশক্তির যুদ্ধজাহাজ, বানিজ্যিক জাহাজের উপর আক্রমন করছিলো ক্রমাগত যার জন্য আমেরিকাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয় মিত্রশক্তির পক্ষে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানির পক্ষে ছিল। তাই গ্যালিপোলি উপদ্বীপে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নৌ অভিযান করেছিল ব্রিটেন যাতে অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানিকে সাহায্য না করে। তবে এই গ্যালিপোলি অভিযানে সফল হয়নি ব্রিটিশ নৌবাহিনী। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ নৌবাহিনী মিত্রশক্তির বিজয়ে একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছিল। পিটার হার্টের লেখা জাটল্যান্ড ১৯১৬ বইয়ে এই জাটল্যান্ড যুদ্ধের কথা বিস্তারিত ভাবে বর্ননা করা হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই সর্বপ্রথম বায়ুসেনার ব্যবহারও শুরু হয়েছিল। ১৯০৩ সালে প্রথম বিমান তৈরি হয় এবং ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যার জন্য সেসময় যুদ্ধের প্রথমদিকে উভয়পক্ষই বিমান ব্যবহার করতো একে অন্যের উপর নজর রাখার জন্য। সেসময় বিমানে পাইলট নিজের কাছেই বন্দুক রাখতো। যদি শত্রুপক্ষের বিমান আশেপাশে আসতো তাহলে পাইলট গুলি করতো। যুদ্ধের অগ্রগতির সাথে সাথে বিমানের ডিজাইনও উন্নত হতে শুরু করে। বিমানে বোম্ব বহন করা শুরু হয় এবং মেশিনগান লাগানোও শুরু হয়। দুইপক্ষের পাইলটই এবার আকাশেই ডগফাইট শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যে পাইলট বেশী বিমান ধ্বংস করতো তাদের এশেস সম্মান দেওয়া। সমাজে এশেস পাইলটদের প্রচন্ড সম্মান ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে বিখ্যাত এশেস ছিল ২২ বছর বয়সী এক জার্মান পাইলট ম্যানফ্রেড ফন রিচথোফেন যার সাংকেতিক নাম ছিল দি রেড ব্যারন। ২০ মাসে ৮০টি বিমান ধ্বংস করেছিল  ম্যানফ্রেড ফন রিচথোফেন, যার মধ্যে ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসেই ২১টি বিমান ধ্বংস করেছিল সে। তবে ১৯১৮ সালের ২১ এপ্রিল এক ডগফাইটে মৃত্যু হয় তার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *