অফবিট

মহাকাশে আধিপত্য বিস্তার করতে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধ

বিখ্যাত আমেরিকান কল্পবিজ্ঞান সিনেমা স্টার ওয়ার। যা ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ১৯৭৭ সালে এই গল্পের সূচনা হয়, এরপর ধীরে ধীরে বেশ কিছু সিনেমা তৈরি হয়েছে এই সিরিজের। তবে কল্পবিজ্ঞানের স্টার ওয়ারের মতোই বাস্তবেও এমন স্টার ওয়ারের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল ১৯৫৫-৭৫ সালে। মহাবিশ্বে আধিপত্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে বিশ্বের দুই শক্তিশালী দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল যাকে মহাকাশ যুদ্ধ বা স্টার ওয়ার বলা হয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। কেনই বা সূত্রপাত হয়েছিল এই মহাকাশে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা?  কী কী মিশন করেছিল দুই দেশ? শেষ পর্যন্ত বিজয় কার হয়েছিল? এইসব ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে দুই সুপারপাওয়ারের উদ্ভব হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের। দুজনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা প্রমানের জন্য উভয়ের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। মহাকাশে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতাও তখনই শুরু হয়। মহাকাশ নিয়ে প্রতিযোগিতার সূত্রপাত জানতে হলে সময়ের একটু পেছনে যেতে হয়। সালটা তখন ১৯৩০, ইউরোপে অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানি সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। হিটলারের নাজি সেনার সামনে একের পর এক দেশের পতন ঘটছে। যুদ্ধে একাধিক উন্নত হাতিয়ার ব্যবহার করছে নাজি সেনা। জার্মান প্রযুক্তি সেইসময় জগৎবিখ্যাত ছিল। নাজি জার্মানির এক বিজ্ঞানী পরীক্ষামূলক ব্যালেস্টিক মিসাইল তৈরি করে এই সময়, এছাড়াও নাজি বিজ্ঞানীরা তরল জ্বালানি বিশিষ্ট রকেট ইঞ্জিন তৈরি করে ফেলেছিল। জার্মানির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে আর্টিলারির মতো রকেটের ব্যবহার, সেজন্য নাজি অফিসাররা ইঞ্জিনিয়ারদের এক বিশেষ দল তৈরি করে। ১৯৩২ সালে এক নাজি বিজ্ঞানী ওয়ার্নার ভন ব্রাউন রকেট ব্যাবহারের সংজ্ঞাই পাল্টে দেয়। ভন ব্রাউনই প্রথম কোন ব্যক্তি যে রকেট ব্যবহার করে মহাকাশ বিজয়ের স্বপ্ন দেখেছিল যার জন্য তাকে আধুনিক মহাকাশ ভ্রমনের জনক বলা হয়। তবে তিনি তার কাজ শুরু করার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় যাতে জার্মানির পরাজয় হয়। এরপর অপারেশন পেপারক্লিপের মাধ্যমে আমেরিকা ও পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির বেশীরভাগ ইঞ্জিনিয়ার ও বহু জার্মান প্রযুক্তি নিজেদের দেশে নিয়ে আসে। ভন ব্রাউন সহ তার গোটা দলকে আমেরিকা জার্মানি থেকে রাতারাতি উঠিয়ে নিয়ে আসে এবং দেশে মিসাইল ও মহাকাশ প্রযুক্তির উপর কাজ শুরু করে। জার্মানির বিখ্যাত ভি-২ রকেটও আমেরিকা নিয়ে নেয়। তবে আমেরিকা একা নয় সোভিয়েত ইউনিয়নও জার্মানির প্রযুক্তি নিয়ে যায় তবে সবচেয়ে বেশী লাভ আমেরিকারই হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল পূর্ব জার্মানি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে এবং পশ্চিম জার্মানি ছিল আমেরিকার অধীনে।

পূর্ব জার্মানিতে অবস্থিত বিখ্যাত জার্মান মহাকাশ কেন্দ্র পিনিমুন্ডার রকেট সেন্টার সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে যায়। বেশ কিছু জার্মান বিজ্ঞানীকে গোপনে তখন সোভিয়েত ইউনিয়নও নিজেদের দেশে নিয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মান ভি-২ রকেটের সোভিয়েত ভার্সন আর-১ তৈরি করে। আমেরিকাও তাদের নিজস্ব ভার্সন আর-২ তৈরি করে। ১৯৫৫ সালে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি আইসেনহাওয়ার জানায় আমেরিকা ১৯৫৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠাবে। আমেরিকার এই ঘোষনার সাথে সাথেই সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের মহাকাশ গবেষনার গতি বাড়িয়ে দেয় এবং আর-৭ নামে বিশ্বের প্রথম ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম তৈরি করে এবং স্পুটনিক-১ নামে একটি স্যাটেলাইট তৈরি করে। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফল ভাবে স্পুটনিক-১ কক্ষপথে স্থাপন করে এবং দুই মাস পর স্পুটনিক -২ নামে আরও একটি স্যাটেলাইট পাঠায় যাতে লাইকা নামে একটি কুকুরকেও পাঠানো হয়। সাথে সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে মহাকাশে কোন প্রানীকে পাঠানোর রেকর্ড নিজেদের নামে করে নেয়। মূলত এইসময় থেকেই শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে মহাকাশে আধিপত্য স্থাপনের প্রতিযোগিতা। ১৯৫৮ সালের মে মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন স্পুটনিক ৩ লঞ্চ করে। ১৯৫৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের লিউনিক ৩ মহাকাশযান চাঁদের অন্ধকার দিকের ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের একের পর এক সাফল্যে আমেরিকা চাপে পড়ে যায়। ১৯৫৭ সালে স্পুটনিক-১ লঞ্চের পরই আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনিডি দ্রুত প্রজেক্ট ভ্যানগার্ড শুরু করে যাতে খুবই অল্পসময়ে রকেট তৈরি করা হয়। কিন্তু লঞ্চের সময় রকেট জ্বলে যায়, যার ফলে গোটা বিশ্বে আমেরিকাকে ব্যাঙ্গ করা হয়। ব্যার্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ১৯৫৮ সালের ১ অক্টোবর আমেরিকা নাসা বা ন্যাশনাল এরোনটিকস এন্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তৈরি করে। নাসা একটি গুরুত্বপূর্ণ মিশনে কাজ শুরু করে তা হচ্ছে মহাকাশে মানুষ পাঠানো। আমেরিকার বায়ুসেনা থেকে বাছাই করা পাইলটদের ট্রেনিং দোওয়া শুরু হয়। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি এফ কেনেডি নিজে এই প্রজেক্টে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু আমেরিকার আগেই ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল ভস্তক-১ মহাকাশযান পাঠায় পাঠায় যাতে ইউরি গ্যাগারিনকে মহাকাশে পাঠানো হয়। ভস্তক-১ ১০৮ মিনিটে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করে। এর সাথে সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে প্রথম মানুষ পাঠানোর কৃতিত্বেরও অধিকারী হয়ে যায়।

এই ঘটনার একমাস পরেই অ্যালান শেফার্ড নামে এক মহাকাশচারীকে মহাকাশে পাঠায় আমেরিকা। এই মিশনের আগে নাসা প্রজেক্ট মার্কারি নামে একটি মিশন করেছিল যাতে সোভিয়েত ভস্তকের থেকেও ছোট, হালকা মহাকাশযান তৈরি করে তাতে শিম্পাঞ্জিকে পাঠিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত মহাকাশ প্রতিযোগিতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। এরপর আবারও একবার সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশযান পাঠায় মহাকাশে যেটি ২৫ ঘন্টায় পৃথিবীকে ১৬ বার প্রদক্ষিন করে আসে। ১৯৬২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী আমেরিকা দ্বিতীয়বার মহাকাশে মানুষ পাঠায়। এই মিশনে অংশ নেওয়া জন গ্লেন হন প্রথম আমেরিকান মহাকাশচারী যিনি পৃথিবীর কক্ষপথে যান। তবে এতক্ষন পর্যন্ত আমেরিকা যাই করুক না কেন সোভিয়েত ইউনিয়ন তা আগেই করে ফেলেছিল। সুতরাং আমেরিকা নতুন কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়। 

১৯৬২ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনোডি ঘোষনা করে আমেরিকা চাঁদে মানুষ পাঠাবে এবং অ্যাপোলো প্রজেক্টের সূচনা করেন তিনি। এর জন্য মরিয়া আমেরিকা নাসার বাজেট ৫০০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। ৩৪,০০০ নাসার কর্মচারী ও অতিরিক্ত ৩,৭৫,০০০ লোক অ্যাপোলো প্রজেক্টে কাজ করতে শুরু করে। তবে ১৯৬৩-৬৫ এর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বেশ কয়েকটি মিশন সম্প্নন্ন করে৷ 

সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে প্রথম মহিলা মহাকাশচারী ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভাকে পাঠায়। ১৯৬৩ সালে ভস্তক-৬ মহাকাশযানে তাকে মহাকাশে পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। তিন সদস্য বিশিষ্ট মহাকাশযানও পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এদিকে আমেরিকা ব্যাস্ত ছিল তাদের অ্যাপোলো প্রজেক্ট নিয়ে। নাসা অ্যাপোলো মিশনের জন্য চাঁদে সাতটি রোবটযান পাঠায় যার দুটি ধ্বংস হয়ে যায় কিন্তু পাঁচটি সফল ভাবে অবতরন করে। এদিকে গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমেরিকা দেখতে পায় একটি বিশাল রকেট সোভিয়েত লঞ্চ প্যাডে রয়েছে, আমেরিকা ভাবে এটা বোধহয় সোভিয়েত ইউনিয়ন চন্দ্র অভিযানের জন্য ব্যবহার করবে। কিন্তু সোভিয়েত এই রকেট উৎক্ষেপন ব্যার্থ হয়ে যায়, কী মিশন ছিল এটার তা আজও জানা যায় নি। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই কেপ কেনেডি মহাকাশ কেন্দ্র থেকে চাঁদের উদ্দেশ্যে অ্যাপোলো-১১ মহাকাশযান লঞ্চ করে আমেরিকা। ২০ জুলাই অ্যাপোলো -১১ চাঁদের মাটিতে সফল ভাবে অবতরন করে। এই মহাকাশযানে থাকা নীল আর্মস্ট্রং প্রথম ব্যাক্তি হন যিনি চাঁদের মাটিতে পা রাখেন। ২৪ জুলাই অ্যাপোলো-১১ পৃথিবীতে ফিরে আসে।

আমেরিকার এই মিশন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বিশাল এক বিজয় ছিল আমেরিকার। তবে আমেরিকার এই অ্যাপোলো -১১ মিশন নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। বলা হয় আমেরিকা পৃথিবীতেই কোন এক বিশেষ মহাকাশ সেন্টারে এটা ঘটিয়েছিল। অ্যাপোলো-১১ এর পর আমেরিকা অ্যাপোলো-১৭ অবধি আরও ছয়টি অ্যাপোলো মিশন করেছিল যার মধ্যে অ্যাপোলো-১৩ তেই একমাত্র দুর্ঘটনা ঘটেছিল। চন্দ্রভিযানে ব্যার্থ হলেও ১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেনেরা-৭ নামক মহাকাশযান পাঠায় যা ভেনাস মিশনে যায়। ১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন স্যালোট-১ নামে বিশ্বের প্রথম মহাকাশস্টেশন স্থাপন করে। এই বছরই মঙ্গলের মাটিতে প্রথম মহাকাশযান মার্স-৩ অবতরন সোভিয়েত ইউনিয়নই করে। ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মহাকাশ প্রতিযোগিতায় স্পষ্টতই সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। তবে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর থেকে এখনও অবধি মহাকাশ গবেষনায় আমেরিকার আশেপাশেও কেউ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *