অফবিট

৮ ধরনের মিসাইল দিয়ে ইসরায়েলকে আক্রমণ করবে ইরান। কোন কোন মিসাইল আছে ইরানের অস্ত্রাগারে?

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধ শুরু হয় যার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে আবারও রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে। হামাসকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র, অর্থ সহায়তা করছে ইরান। সম্প্রতি সিরিয়ার দামাস্কাসে ইরানের দূতাবাসের উপর বোম্বিং করেছে ইসরায়েল। এই বোম্বিংয়ের ফলে দূতাবাসে থাকা ইরানের দুজন গুরুত্বপূর্ন জেনারেলের মৃত্যু হয়েছে। এরপরেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের হুমকী দিয়েছে ইরান। তবে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী সর্বদাই প্রস্তুত রয়েছে যেকোনও ধরনের আক্রমন মোকাবিলায়। কিন্ত ইসরায়েল আশঙ্কা করছে ইরান বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলের দূতাবাসেও আক্রমন করতে পারে, এজন্য বেশীরভাগ দেশে ইসরায়েল তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দিচ্ছে। গোটা বিশ্বে ইসরায়েলের অন্তত আশিটি দূতাবাস রয়েছে যার মধ্যে ২৮টি দূতবাস আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। ভারতেও দিল্লিতে ইসরায়েলের দূতবাস ও মুম্বাইয়ে ইসরায়েলের কনস্যুলেট আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। দক্ষিন ইসরায়েলের পাশে গাজা উপত্যকাতে হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে ইসরায়েল সেনাবাহিনী। তবে এরইমধ্যে উত্তর ইসরায়েলের কাছে লেবাননের হিজবুল্লাহও ইসরায়েলে আক্রমন শুরু করেছে। বলা হয় এই হিজবুল্লাহকে ইরান, রাশিয়া, চীন সহায়তা করে। সম্প্রতি হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের একটি ড্রোনও ধ্বংস করে দিয়েছে। যার জন্য ইসরায়েল সেনাবাহিনী বর্তমানে দ্বিমুখী লড়াইয়ে ব্যস্ত। ইরানি গনমাধ্যম গুলোতে প্রচার করা হচ্ছে ইসরায়েল যদি গাজা উপত্যকা থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয় এবং যুদ্ধ বন্ধ করে তবেই ইরান ইসরায়েলকে আক্রমন করবেনা। যদিও ইতিমধ্যে ইসরায়েলে আক্রমন করেছে ইরান। ইরান আমেরিকাকেও হুমকী দিয়েছে আমেরিকা যাতে ইসরায়েলকে সমর্থন না করে নাহলে আমেরিকার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর জবাবে আমেরিকাও ইরানকে সতর্ক করেছে। আমেরিকার নৌবাহিনীর ক্যারিয়ার ব্যাটেল গ্রুপ লোহিত সাগর, ভূমধ্যসাগরে রয়েছে। ইরান ইসরায়েলকে আক্রমন করলে আমেরিকাও ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। 

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে শত্রুতার সূত্রপাত হয় ইরানিয়ান বিপ্লবের সময় ১৯৭৯ সালে। ইরানিয়ান বিপ্লবের আগে ইরানে রাজতন্ত্র ছিল, ইরানের শেষ শাসক ছিল পাহলভি রাজবংশের শাহ মহম্মদ রেজা। ১৯৭৯ সালের আগে ইরান পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে নিজেকে আধুনিকরন করছিলো কিন্তু এর বিরুদ্ধে ইরানের বিপ্লব হয় এবং শাহ মহম্মদ রেজাকে হটিয়ে দিয়ে ইরানের নতুন নেতা হয় আয়াতুল্লাহ খামেনি। সেসময় ইরান সরকার ইসরায়েলকে ছোট শয়তান ও আমেরিকাকে বড় শয়তান বলতো। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের বদলে সবসময় ছায়াযুদ্ধ হয়। ইরান জানে ইসরায়েল সামরিক ভাবে অনেকবেশী শক্তিশালী কারন আমেরিকা ইসরায়েলকে সহায়তা করে প্রযুক্তি, অর্থ ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র দিয়ে। এজন্য ইরান লেবাননে হিজবুল্লাহকে সহায়তা করে উত্তর ইসরায়েলে আক্রমন করার জন্য। আবার সিরিয়াতে বাসার আল আসাদের সরকারকেও ইরান অস্ত্র সহায়তা করে, এসব অস্ত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়। এজন্য ইসরায়েল সময় বিশেষে লেবানন, সিরিয়াতে এয়ারস্ট্রাইক করে। এছাড়া দীর্ঘ কয়েকদশক ধরে বারংবার ইরানের পরমানু কার্যক্রম ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল। এজন্য ১৯৮০ এর দশক থেকেই ইসরায়েল ইরানের মধ্যে শত্রুতা তৈরি হয়েছে। সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে যদি ইরান ইসরায়েলে আক্রমন করে তাহলে বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য ইএমপি বোম্ব ব্যবহার করতে পারে ইসরায়েল। ইএমপি বোম্বের পুরো নাম ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পালস বোম্ব। যদি ইরান ইসরায়েলে মিসাইল আক্রমন করে তাহলে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান ইরানে ইএমপি বোম্ব নিক্ষেপ করবে। এই ইএমপি বোম্ব কোনও জায়গার সম্পূর্ন বিদ্যুৎশক্তি নষ্ট করে দেয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যায়। এই ইএমপি বোম্বের কারনে মানুষের মৃত্যু তেমন হয়না কিন্তু গোটা অঞ্চল বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে পঙ্গু হয়ে যায়। 

ইসরায়েলের ইএমপি বোম্বের রেঞ্জ কতটা সেটাও জানা যায়নি, তবে ইএমপি বোম্ব যেস্থানে ব্যবহার করা হয় তার চারদিকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে সমস্ত ইলেকট্রনিক যন্ত্র অচল হয়ে যায়। ইরান ইসরায়েল এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই ইরান হরমুজ প্রনালী বন্ধ করে দেওয়ার হুমকী দিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, ওমান ও ইরানের মাঝে অবস্থিত হরমুজ প্রনালী আন্তর্জাতিক সমুদ্র বানিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। বিশ্বের ২৪ শতাংশ তেল, প্রকৃতিক গ্যাস সরবরাহ এই অঞ্চল দিয়েই হয়। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে যার জন্য রাশিয়া থেকেও বহুদেশই তেল কিনছেনা৷ এরকম অবস্থায় হরমুজ প্রনালীও বন্ধ করে দিলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম প্রচুর বেড়ে যাবে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহি কিছু মাস আগে আমেরিকার মধ্যস্থতায় আব্রাহাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যাতে ইসরায়েলকে একটি দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। ইরান অভিযোগ করেছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে গোপনে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বা ইনটেলিজেন্স এজেন্টরা রয়েছে। যার জন্য হরমুজ প্রনালী বন্ধ করে দেবার হুমকী দিয়েছে ইরান। হরমুজ প্রনালী বন্ধ করে দেওয়ার অর্থ বিশ্বের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। তাই এরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর সাথেও ইরানের যুদ্ধও হতে পারে।

তবে বর্তমানে ইরান ইসরায়েলকে প্রতিরোধ করতে পূর্ন মোনোযোগ দিয়েছে। ইরানের কাছে আট প্রকারের মিসাইল আছে যেগুলি সরাসরি ইসরায়েলে আঘাত হানতে সক্ষম :—-

১) খাইবার-শেকান:—- ইরান খাইবার-শেকান মিসাইলকে বিশ্বের দীর্ঘতম পাল্লার কৌশলগত ব্যালিস্টিক মিসাইল বলেছে। ইরানের দাবী এই মিসাইল ১,৪৫০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্ততে আঘাত হানতে সক্ষম। এই ৬০০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক বহন করতে সক্ষম। 

২) এমাদ:—- এটি একটি মধ্যমপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল। ইমাদ মিসাইলের রেঞ্জ ১৭০০ কিলোমিটার। এটি ৭৫০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক বহন করতে সক্ষম। 

৩) ফাত্তাহ ২:—- ইরানের তৈরি সর্বাধুনিক মিসাইল এই ফাত্তাহ ২, ইরানের দাবী এটি একটি হাইপারসনিক মিসাইল অর্থাৎ শব্দের গতির তুলনায় পাঁচগুন বেশী গতিতে যেতে সক্ষম এই মিসাইল। নভেম্বর, ২০২৩ সালে ইরান এই মিসাইল জনসমক্ষে আনে। ৪৫০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক বহনে সক্ষম এই মিসাইলের রেঞ্জ ১৫০০ কিলোমিটার। 

৪) হজ কাসেম:—- ইরানের প্রাক্তন জেনারেল কাসেম সোলেইমানির সম্মানে এই মিসাইলের নাম রাখা হয়েছে হজ কাসেম। গত ৩ জানুয়ারী, ২০২০ সালে ইরাকের বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে প্রিডেটর ড্রোন থেকে হেলফায়ার মিসাইল ছুঁড়ে কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করেছিল আমেরিকা। ১,৪০০ কিলোমিটার রেঞ্জের এই হজ কাসেম মিসাইলের ৫০০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক বহন করতে সক্ষম। এই মিসাইলটি শত্রুর রেডার ফাঁকি দিতেও সক্ষম। 

৫) সেজ্জিল ৩:—- ইরানের তৈরি এই ব্যালিস্টিক মিসাইলের রেঞ্জ ৪০০০ কিলোমিটার এবং এটি ৭০০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক বহন করতে সক্ষম। ২০১৪ সালে এই মিসাইলটি তৈরি করে ইরান। সেজ্জিল মিসাইলের তিনটি ভার্সন রয়েছে। সেজ্জিল ১ ও সেজ্জিল ২ ২০০৮-২০০৯ সালেই তৈরি করেছিল ইরান। এই সেজ্জিল শ্রেনীর সর্বাধুনিক মিসাইল সেজ্জিল ৩। 

৬) শাহাব-3 :—- ইরানের তৈরি সবচেয়ে পুরোনো মিসাইলগুলির মধ্যে একটি এই শাহাব ৩ মিসাইল। ২০০৩ সালে ইরান এই মিসাইল তৈরি করে। দীর্ঘদিন ইরান সাফল্যের সাথে ব্যবহার করে আসছে এই মিসাইল। শাহাব ৩ মিসাইলের রেঞ্জ ১৩০০ কিলোমিটার এবং এটি ১২০০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক বহন করতে সক্ষম। 

৭) গদর ১১০:—- ২০০০ কিলোমিটার রেঞ্জের এই মিসাইলটি ৮০০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক বহন করতে সক্ষম। শাহাব ৩এ মিসাইলের উন্নত ভার্সন এই গদর ১১০। এই গদর ১১০কে আইআরবিএম বা ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল বলা হয়। মিডিয়াম রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল (রেঞ্জ ১০০০ কিলোমিটার থেকে ৩০০০ কিলোমিটার) ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইলের (৫৫০০ কিলোমিটারের বেশী রেঞ্জ) মধ্যবর্তী পাল্লার মিসাইলকে আইআরবিএম বলা হয়। গদর শ্রেনীর আরও একটি মিসাইল রয়েছে ইরানের যার নাম গদর ১০১। ইরান দাবী করে এই গদর ১০১ অ্যান্টি স্যাটেলাইট মিসাইল। চীনের ডংফেং ১৫ রকেট প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ইরান এই মিসাইল তৈরি করেছে। 

৮) পাভেহ:—- ইরানের তৈরি দীর্ঘপাল্লার এই ক্রুজ মিসাইলের রেঞ্জ ১৬৫০ কিলোমিটার। ২০২৩ সালে ইরান এই মিসাইল তৈরি করেছে। ইরানের সৌমার ক্রজ মিসাইল শ্রেনীর সবচেয়ে আধুনিক সংস্করন এই পাভেহ মিসাইল। এই মিসাইলের বিস্ফোরক বহন ক্ষমতা এখনও জানা যায়নি। পাভেহ মিসাইল ইরানের তৈরি একটি স্মার্ট মিসাইল। একসাথে যখন অনেকগুলো পাভেহ মিসাইল লঞ্চ করা হয় তখন প্রত্যেকটি পাভেহ মিসাইল একে অপরের সাথে সংযোগ রক্ষা করে। এছাড়া লক্ষ্যবস্তর কাছাকাছি পৌঁছে পথ পরিবর্তন করার ক্ষমতাও রয়েছে এই পাভেহ মিসাইলের। 

তবে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী। বহু স্তরীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা ইসরায়েল সম্পূর্ন সুরক্ষিত। অ্যারো ২, অ্যারো ৩, ডেভিড স্লিং এবং বিখ্যাত আয়রন ডোম আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা ইসরায়েলের আকাশ শত্রুর মিসাইল, যুদ্ধবিমান, ড্রোন ও হেলিকপ্টার থেকে সুরক্ষিত। ইরান সমর্থিত হামাস, হিজবুল্লাহ, ইয়ামেনের হুথী বিদ্রোহীরা বহুবার ইসরায়েলে মিসাইল, রকেট আক্রমন করেছে কিন্তু ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ৯৯ শতাংশ আক্রমনই প্রতিরোধ করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *