খরা এবং বন্যার সমস্যা পুরোপুরি ভাবে মেটাতে ভারত সরকারের অবাক করা প্রকল্প
সুপ্রাচীন কাল থেকে যেকোনও দেশ সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছিল নদীকে কেন্দ্র করেই। যেমন নীল নদীর তীরে বিখ্যাত মিশর সভ্যতা তৈরি হয়েছিল। তেমনি ভারতের সিন্ধু সভ্যতাও সিন্ধু নদীকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছিল। নদী তীরবর্তী অঞ্চলে কৃষিকাজই ছিল প্রাচীন ভারতবাসীর প্রধান জীবিকা। ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে ভারতের নদীগুলিরই। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, গোদাবরী, কাবেরী, ব্রহ্মপুত্র সহ প্রচুর নদী প্রবাহিত হয়েছে ভারতের ভূখন্ড জুড়ে। যার জন্য অতীতকাল থেকেই ভারত সুজলা, সুফলা ও শস্যশ্যামলা, এজন্য ভারতকে নদীমাতৃক দেশও বলা হয়। ভারতের মধ্যে দিয়ে যে পরিমান নদী প্রবাহিত হয়েছে তা বিশ্বের খুব কম দেশেই রয়েছে। ভারত বর্তমানে আর্থিক ও সামরিক দিক দিয়ে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে একটি। প্রায়ই শোনা যায় বর্ষাকালে উত্তর পূর্ব ভারতের ব্রহ্মপুত্র নদীতে বন্যা হয়েছে কিংবা দক্ষিন ও মধ্য ভারতের কিছু এলকায় খরা দেখা দিয়েছে। একই দেশে এরকম বিভিন্নতা হয়ত খুব কম দেশেই দেখা যায়। এরকম অবস্থায় যদি ভারতের সমস্ত নদীগুলোকে একসাথে সংযুক্ত করে দিলে ভারতে কখনও খরা আসবেনা। যেমন যদি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর জল বর্ষাকালে রাজস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া যায় কিংবা গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীকে কাবেরী, গোদাবরী, কৃষ্ণা নদীর সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া যায় তাহলে বর্ষাকালে উত্তর পূর্ব ভারতে কখনও বন্যা হবেনা এবং ভারতের অন্যান্য প্রান্তে কখনও খরা হবেনা। এই জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার নদী সংযোগ প্রকল্প বা রিভার ইন্টারলিঙ্ক প্রজেক্ট শুরু করেছে। এই প্রকল্পে ত্রিশটি মাধ্যমে ৩৭টি নদীকে সংযুক্ত করবার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আপামর ভারতবাসীর জন্য ভারত সরকারের সবচেয়ে বড় প্রকল্প গুলির মধ্যে একটি প্রকল্প এটি যার উদ্দেশ্য ভারতের সব প্রান্তে জলস্তরের ভারসাম্য বজায় রাখা। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশই ভারতে বাস করে কিন্ত সেই তুলনায় বিশ্বের মোট পানীয় জলের ৪ শতাংশই ভারতে রয়েছে। এজন্য ভারতের প্রত্যেক স্থানের মানুষ যাতে জলের সঠিক সরবরাহ পায় এটা সবচেয়ে জরুরী। এই কারনেই ভারত সরকারের নদী সংযোগ প্রকল্প খুবই গুরুত্বপূর্ন একটি প্রজেক্ট।
নদী সংযোগ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য জল সরবরাহ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে ভিন্নতা দূরীকরণ। উত্তর ভারতের নদীগুলোতে অর্থাৎ গঙ্গা, যমুনা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র নদীগুলোতে সারা বছর জল থাকে কারন বর্ষাকাল ছাড়াও হিমালয়ের হিমবাহ গলিত জল এসব নদীতে এসে মেশে। কিন্তু সেই তুলনায় দক্ষিন ও পশ্চিম ভারতের নদীগুলো বেশীরভাগই বর্ষারকালের উপর অর্থাৎ বৃষ্টির জলের উপর নির্ভরশীল যার জন্য গ্রীষ্মকালে এসব নদীতে জলস্তর কমে যায়। ভারতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমান ৪০০০ বিলিয়ন ঘন মিটার। জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই চারমাস ভারতে সবচেয়ে বেশী বৃষ্টিপাত হয়। ভারতের বিশাল ভূভাগে সর্বত্র বৃষ্টিপাত সমান হয়না, উত্তর ও পূর্ব ভারতে বেশী বৃষ্টিপাত হয় কিন্ত সেই তুলনায় পশ্চিম ও দক্ষিন ভারতে বৃষ্টিপাত কম হয়। যার জন্য বছরের পর বছর ভারতের কোনও একপ্রান্তে বন্যা হয় আবার অন্যপ্রান্তে খরা হয়। জলের এই তারতম্য ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষিকাজ ও পানীয় জলের জন্যও সমস্যার কারন। এই জন্য উত্তর ভারতের নদীগুলোকে দক্ষিন ভারতের নদীগুলোর সাথে সংযুক্ত করলে ভারতের সর্বত্র জলস্তর সমান থাকবে। বাঁধ নির্মানের মাধ্যমে নদীর জল ধরে রেখে কম জলযুক্ত এলাকায় জলপ্রবাহের মাধ্যমে এই প্রকল্প সম্পূর্ন করা হবে। পুরো প্রকল্পটি তিনটি ভাগে বিভক্ত উত্তর হিমালয়ের গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র সহ নদীগুলোর সংযোগ, দক্ষিন উপদ্বীপীয় নদীগুলোর সংযোগ এবং আন্তঃরাজ্য নদীগুলোর সংযুক্তিকরন। ভারতের জলশক্তি মন্ত্রনালয় পুরো প্রকল্পের দায়িত্বে আছে। হিমালিয়ান অঞ্চলের ১৪টি নদী সংযোগ প্রজেক্ট, দক্ষিন উপদ্বীপীয় অঞ্চলের ১৬টি নদী সংযোগ প্রজেক্ট এবং ৩৭টি আন্তরাষ্ট্রীয় নদী সংযোগ প্রজেক্টের পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই জনশক্তি মন্ত্রনালয় তৈরি করেছে।
** হিমালিয়ান নদীগুলোর সংযোগ :—- ভারতের প্রধান দুই হিমালিয়ান নদী হচ্ছে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র। হিমালিয়ান নদীগুলোকে সংযুক্তিকরনের জন্য ভারত, নেপাল ও ভুটানে হিমালিয়ান নদীগুলোর উপর একাধিক বাঁধ নির্মান করা হবে। যাতে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যা নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি অতিরিক্ত ২২ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে চাষের জন্য জল সরবরাহ করা যাবে এবং ৩০ মিলিয়ন কিলোওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। গঙ্গার পূর্ব উপনদীগুলো থেকে খালের মাধ্যমে পশ্চিম ভারতের নদীগুলোতে অতিরিক্ত জল পাঠানো হবে। তাছাড়া এই প্রজেক্টের মাধ্যমে ফারাক্কা বাঁধেও অতিরিক্ত জল সরবরাহ করা হবে যাতে কলকাতা বন্দরের পলি অপসারন করা যায়। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে শুধু ভারত নয় নেপাল ও বাংলাদেশও লাভবান হবে। ২০১৫ সালে হিমালিয়ান অঞ্চলে ১৪টি সম্ভাব্য নদী সংযোগ প্রজেক্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।
** দক্ষিন উপদ্বীপীয় সংযোগ :—- এই প্রজেক্টটি মূলত চারটি ভাগে বিভক্ত।
১) মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, পালর, পেন্নার ও কাবেরী নদীর সংযোগ।
২) মুম্বাইয়ের উত্তরে এবং তাপির দক্ষিনে পশ্চিম বাহিত নদীগুলোর সংযোগ।
৩) চম্বল ও কেন নদীর সংযোগ
৪) পশ্চিমে প্রবাহিত নদী থেকে কিছু পরিমান জল অন্যত্র প্রবাহ।
এই প্রজেক্ট ৩৫ মিলিয়ন হেক্টর অতিরিক্ত জমিতে চাষের জল সরবরাহে সহায়তা করবে, বন্যা নিয়ন্ত্রন করবে, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে সাহায্য করবে এবং আঞ্চলিক নৌ চলাচলেও সহয়তা করবে। এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য পূর্ব-ভারত থেকে দক্ষিন ও পশ্চিম ভারতে জলপ্রবাহ পাঠানো। দক্ষিন ভারতের চারটি গুরুত্বপূর্ন নদী মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা ও কাবেরীকে খালের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হবে। এই প্রজেক্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন অংশ ৮০০ কিলোমিটার লম্বা মহানদী গোদাবরী সংযোগ ব্যবস্থা যা ভুটান থেকে উৎপন্ন হওয়া সঙ্কোষ নদীকে তিস্তা, মহানন্দা, সুবর্নরেখা, এবং মহানদীকে অন্ধ্রপ্রদেশের গোদাবরী নদীর সাথে সংযুক্ত করবে।
** আন্তঃরাজ্য নদীগুলোর সংযুক্তিকরন:—- ২০০৫ সালের জুন মাসে এই প্রজেক্টের অনুমোদন দেওয়া হলেও এখনও পর্যন্ত বিহার, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ওড়িশা, তামিলনাড়ুর মধ্যে ২০টি প্রকল্পের বিষয়ে সমীক্ষা করা হয়েছে এবং আরও বেশ কিছু সম্ভাব্য প্রকল্পের সমীক্ষা চলছে।
ভারতে নদী সংযোগের পরিকল্পনা এর আগেও করা হয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ শাসনের সময়েও নদী সংযোগের ব্যাপারে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনে ভারতের কৃষি বিভাগের এক বড় ইঞ্জিনিয়ার আর্থার কটন ভারতে খরা সমস্যা দূরীকরণ এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। তিনি তৎকালীন ইংরেজ সরকারকে প্রস্তাব দেন উত্তর ভারতের গঙ্গা নদীকে দক্ষিন ভারতের কাবেরী নদীর সাথে সংযুক্ত করার। আর্থার কটন এই পরিকল্পনার কারন হিসাবে জানান উত্তর ভারতে বর্ষাকালে গঙ্গার জলস্তর বৃদ্ধি পায় আবার দক্ষিন ভারতে ডিসেম্বর মাসে কাবেরী নদীতে জলস্তর বৃদ্ধি পায়। এজন্য দুই নদীকে সংযুক্ত করা হলে সারাবছর দুই নদীতে জলস্তর সমান থাকবে। আর্থার কটন এই পরিকল্পনার মাধ্যমে অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওড়িশাতে খরা সমস্যা দূর করার চেষ্টা করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনে আর্থার কটনের প্রস্তাব কাজ করা না হলেও পরবর্তীকালে আর্থার কটনের পরিকল্পনার উপযোগীতা সকলেই বুঝতে পেরেছে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭০ এর দশকে পদ্মভূষন সম্মানপ্রাপ্ত বিখ্যাত বাঁধ ডিজাইনার ডঃ কেএল রাও জাতীয় জল গ্রিডের প্রস্তাব দেন। ডঃ কেএল রাও ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সেচ মন্ত্রী ছিলেন। তিনি উত্তর ভারতে বারবার বন্যা এবং দক্ষিন ভারতে জলের ঘাটতি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেন গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রর অববাহিকায় অতিরিক্ত জল রয়েছে এবং মধ্য ও দক্ষিন ভারতে জল কম রয়েছে। তাই তিনি উত্তর পূর্ব ভারত থেকে অতিরিক্ত জল দক্ষিন ও মধ্য ভারতের দিকে নিয়ে আসার প্রস্তাব দেন।
১৯৮২ সালে ন্যাশানাল ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি বা এনডব্লুিউডিএকে ভারতের সমস্ত নদীগুলির সংযোগের সমীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮২ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে এনডব্লুিউডিএ অনেকগুলি প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু কোনও প্রকল্পেরই বাস্তবায়ন হয়নি। অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার ২০১৪ সালের পর থেকে এই প্রজেক্টে বিশেষ জোর দেওয়া শুরু করেছে। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী নদী সংযোগ প্রকল্পে এখনও পর্যন্ত ৭,৬৬৫ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে যার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার অর্থায়ন করেছে ৫,০৩৮.২৮ কোটি টাকা এবং রাজ্যগুলো খরচ করেছে ২,৬২৬.৭০ কোটি টাকা। এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হলে ভারতের সর্বপ্রান্তে জলস্তরের ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং দেশের আর্থিক বিকাশ হবে।