জাপানিরা যে বাঙালিকে ভগবানের মতো পূজা করে
নিউজ ডেস্ক – সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে গোটা ১০০ জন ব্যক্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজে একা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়ে টিকে থাকাটা সহজ ব্যাপার নয়। এমনই এক জন ছিলেন যে গোটা আইনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে নিজের মতামত তাদের সামনে রাখার সাহস করেছিলেন। অ্যামোনিয়ার বঙ্গবীর বলেন রাধাবিনোদ পাল। একজন গণিতের অধ্যাপক থেকে ইন্টারন্যাশনাল বোর্ডের বিচারক হয়ে ওঠার পথ খুব একটা সহজ ছিল না রাধাবিনোদ পালের কাছে। বহু বাধা ঝড় জল সমাজের অবজ্ঞা পেরিয়ে আজ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে পেরেছেন রাধা বিনোদ পাল। গোটা বিশ্বে সিংহ ভাগ মানুষই হয়তো চেনেন না এই ব্যক্তিকে। তাহলে আসুন একটু পরিচয় করা যাক এই বঙ্গবীরের সঙ্গে।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার সলিমপুর গ্রামে ১৮৮৬ সালে জন্ম হয় রাধাবিনোদ পালের। ছোটবেলা থেকেই তিনি বিভিন্ন পরীক্ষায় নিজের মেধা প্রমাণিত করেছেন। যার কারনে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তাকে। ১৮০৫ সালে রাজশাহি কলেজ থেকে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। রাধা বিনোদের নেক ছিল গণিতশাস্ত্রে। সেই মোতাবেক ১৮০৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর পাস করেন তিনি। এরপর কিছুদিন এলাহাবাদে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিসে কেরানীর চাকরী করেছিলেন। বিয়ের জিগরি পাওয়ার পর চাকরি নিলেন ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে। গণিতের শিক্ষকতা করার পাশাপাশি কোর্টে ওকালতির চর্চাও করছিলেন তিনি।
পরবর্তীতে ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে এল এল এম এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। এখানেই শেষ নয় তার পঠন পাঠনের জীবন। এরপর উচ্চ স্তরে আইনি চর্চার জন্য কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করেন। আইন চর্চার তুলনায় রাধাবিনোদ পাল কে কোথায় বেশি টানতো বিশ্লেষণ।১৯২৪ সালে আইনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন তিনি।
রাধাবিনোদ পাল আন্তর্জাতিক আইন সংস্থাগুলোর সদস্যপদ লাভ করেন। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক দিক নয়, তার ন্যায় বিচারের সুখ্যাতিও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। তখনও ভারতে ইংরেজ শাসন চলছে। তার মাঝেই ১৯৪১ সালে তিনি ভারত সরকারের আইন উপদেষ্টা, তারপর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এরপর ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন। তখন ১৯৪৬ সাল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। ফিরে এলেন বাংলাদেশে, শেকড়ের তরে। সলিমপুরের মাটির ঘ্রাণেই বাকিটা জীবন শান্তিতে কাটাতে চান। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা ছিল অন্যরকম।
দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল তাকে বিচারক হিসেবে চাইছে। সেখানে ১১ জনের একজন হয়ে যাবেন তিনি। আন্তর্জাতিক অপরাধের ন্যায় বিচার করবেন। কিন্তু টোকিও পৌঁছে তার ভুল ভাঙল। তাকে মেধাবী যোগ্য বিচারক হিসেবে এখানে আনা হয়নি। বরং অবহেলিত দেশের ক্ষুদ্র প্রতিনিধি হিসেবে বিচারকদের প্যানেলে একটা সমতা রক্ষার জন্য আনা হয়েছে। সেখানে রাধাবিনোদ কী মতামত দেন তা কারোর কাছেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল আলাদা একটি হোটেলে। বাকি ১০ জনের জন্য ছিল ভিন্ন ব্যবস্থা।
বিচারের সময় চলে এলে রাধাবিনোদ ভিন্ন মত পোষণ করলেন। জাপান যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধচলাকালে যে কম অপরাধ ঘটায়নি তা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু দোষ শুধু জাপানের একার ছিল না। নাগাসাকি, হিরোশিমাতে বোমাবাজি করে মানবতার অপমান না করলেও জাপান আত্মসমর্পণ করতো। এইসব যুদ্ধাপরাধের জন্য, হাজার হাজার নিরীহ মানুষ হত্যার জন্য এই শক্তিশালী দেশগুলোরও তাহলে শাস্তি পাওনা আছে। তার এই কথায় ফুঁসে উঠল প্যানেল। তাদের ধারণা, ভারতীয় উপমহাদেশে পাশ্চাত্যের আগ্রাসন বিরোধী এই বাঙালি নিতান্তই মিত্রশক্তি বিদ্বেষী। অভিযোগগুলোর তিনটি ভাগ ছিল- এ, বি ও সি। এ শ্রেণীর অভিযোগ ছিল শান্তিবিরোধী অপরাধ। বি আর সি শ্রেণীতে ছিল প্রচলিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। রাধাবিনোদ পাল ট্রাইব্যুনালকে মনে করিয়ে দিলেন এ এবং সি শ্রেণীর অভিযোগ কার্যকর হবে না। কারণ জাপান যখন যুদ্ধে যায় তখনও আন্তর্জাতিক আইনে এমন কোনো আইন অন্তর্ভুক্ত ছিল না, যদি আইনই না থাকে, তাহলে জাপান আইন কিভাবে ভাঙল? পুরো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে রাধাবিনোদ লিখলেন তার ঐতিহাসিক রায়। যার কিয়দংশ প্রকাশিত হয়েছে।
ধারণা করা হয়, এই রায় ছিল ১,২৩৫ পৃষ্ঠার। তিনি লিখেছিলেন জাপান তার অধিকৃত ভূমিতে যা করেছে তা ন্যাক্কারজনক, কিন্তু যে লোকগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ যোগাড় করতে পারেনি ট্রাইব্যুনাল। তিনি তার রায়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন, অভিযুক্তদের করা অপরাধ যুক্তরাষ্ট্রের হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে করা অপরাধের চেয়েও বেশি ঘৃণ্য কিনা। যুদ্ধচলাকালে ব্রিটিশ ও আমেরিকান বিমানবাহিনী শত্রুদেশের সাধারণ নাগরিকদের সর্বোচ্চ মৃত্যু নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কারে ব্যস্ত ছিল।
রাধাবিনোদ জাপানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন বলে ভাববার অবসর নেই জাপান যা করেছিল, তিনি তার পক্ষে ছিলেন। বর্তমান সময়ে, জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিজের আগ্রাসী ভূমিকা লুকাতে রাধাবিনোদ পালের রায়কে ব্যবহার করে। তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এই ঘটনায় খুশি হতেন না। ১৯৫২ সালে হিরোশিমায় এক বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি বলেন, “ জাপান যদি আবারো সমরবাদের উত্থান চায়, তবে তা হবে, এইখানে, এই হিরোশিমায় শায়িত নিরীহ মানুষদের আত্মার প্রতি চরম অসম্মান।”