স্বাধীনতা সংগ্রামী ক্ষুদিরাম বসুর অবদান
১৫ ফুট উঁচু ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তাঁর চোখে ছিল না ভয়ের ছাপ। হাসিমুখে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছিলেন এই তরুণ যুবক। তাঁর দেশের প্রতি এতটাই ভালোবাসা ছিল যে মৃত্যুর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও তিনি নিরন্তন ভেবে গিয়েছিলেন দেশের জন্য। এই তরুণ যুবক আর কেউ নয় ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে দুঃসাহসিক বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু।
৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৯ সালে মেদিনীপুর জেলার হাবিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন ক্ষুদিরাম বসু। তাঁর পিতার নাম ত্রৈলোক্যনাথ বসু এবং মা ছিলেন লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। ক্ষুদিরাম হিসাবে পরিচিত এই বিখ্যাত নামটি হয়েছিল তাকে খুদের বিনিময়ে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য। কারণ তার দুই পুত্র সন্তানের মৃত্যু হয়েছিল শৈশবকালে সেই জন্য তার তিন কন্যার পর যখন তার আরেকটি পুত্র সন্তানের জন্ম হল তখনকার সমাজের নিয়ম অনুসারে তিনি তার বড় বোনের কাছে এই পুত্রকে তিন মুঠি খুদের (শস্যের খুদ) বিনিময়ে বিক্রি করে দেন।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি প্রথমে তাঁর মা এবং পরে তাঁর পিতাকে হারান। এরপর থেকে তিনি তাঁর বড় বোন অপরূপার কাছে লালিত পালিত হয়েছিলেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের বিদ্যালয় থেকে লাভ করার পর তাঁকে তমলুকের ‘হ্যামিল্টন হাই স্কুলে’ ভর্তি করেন তাঁর বড় বোন অপরূপার স্বামী অমৃতলাল রায়।
১৯০২ সালে তাঁর ভগ্নীপতি অমৃতের সাথে চলে আসেন মেদিনীপুর শহরে। সেখানে তিনি মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন।
মেদিনীপুরে তাঁর জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। পা রাখেন বৈপ্লবিক জীবনে এবং যোগ দেন একটি নবগঠিত বৈপ্লবিক দলে । ১৯০২-০৩ সালে মেদিনীপুরে আসেন বিপ্লবী নেতা শ্রীঅরবিন্দ এবং সিস্টার নিবেদিতা। সেখানে তারা জনসম্মুখে বক্তব্য রাখেন। সেই বক্তব্য দ্বারা ক্ষুদিরাম বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল বিপ্লবে যোগ দিতে। ওই একই বছর অর্থাৎ ১৯০২ সালে মেদিনীপুরে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু এবং রাজনারায়ণ বসুর প্রভাবে গড়ে উঠেছিল একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন। সেই সংগঠনের নেতা ছিলেন হেমচন্দ্র দাস কানুনগো এবং তাঁর সহকারী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। এটি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ব্রিটিশ বিরোধীদের দ্বারা পরিচালিত হত। সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন মেদিনীপুরের কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক। ওই স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ক্ষুদিরাম সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সংস্পর্শে আসেন। এরপর তিনি মেদিনীপুরের কলেজিয়েট স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ করেন।
দেশজুড়ে শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী এবং স্বদেশী আন্দোলন। দেশের প্রতি ভালোবাসায় পড়াশোনা ছেড়ে দেশাত্মক মূলক কাজের দিকে ঝোঁকেন। যোগ দেন সত্যেন বসুর গুপ্ত সমিতিতে। সেখানে তিনি শরীর চর্চা, রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি পিস্তল চালানো শেখেন। সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন ক্ষুদিরাম। ইংল্যান্ডে উৎপাদিত কাপড় পুরনো থেকে শুরু করে ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত লবণ বোঝায় নৌকা ডোবানোর মতো ব্রিটিশ বিরোধী কাজকর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তৎকালীন সময়ের “সোনার বাংলা” নামক বিপ্লবী পত্রিকা মেদিনীপুরে আয়োজিত কৃষি ও শিল্প মেলায় বিলি করেন। যার জন্য ক্ষুদিরাম ১৯০৬ সালে প্রথমবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তবে তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ওই একই কাজ আবারও করেন যার জন্য তাঁকে পুলিশ পুনরায় ধরেন এবং তাঁর বিচার উঠেছিল আদালতে। বয়স অল্পের জন্য তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
১৯০৭ সালে বিপ্লবীরা হাটগাছায় ডাকের থলি লুট করেন দলের অর্থের প্রয়োজন মেটাতে। মনে করা হয় এই দলের সাথে ক্ষুদিরামও জড়িত ছিলেন। এমনকি ওই বছরের ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে নারায়ণগড় রেল স্টেশনের কাছে বঙ্গের ছোটলাটের বিশেষ রেলগাড়িতে বোমা আক্রমণের ঘটনার সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন বলে মনে করা হয়। এরপর মেদিনীপুর শহরে অনুষ্ঠিত হওয়া এক রাজনৈতিক সভায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে ক্ষুদিরাম যুক্ত থাকার জন্য তাঁর জামাইবাবু সরকারি চাকরিতে অসুবিধার সম্মুখীন হন। যার জন্য তাঁকে ত্যাগ করতে হয়েছিল তাঁর জামাইবাবুর আশ্রয়। ওই সময় তাঁকে মেদেনীপুরের উকিল সৈয়দ আব্দুল ওয়াজেদের বোন আশ্রয় দিয়েছিলেন।
এরই মধ্যে বিপ্লবীদের টার্গেটে চলে আসে ব্রিটিশ বিচারক কিংসফোর্ট। কারন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বহু বিপ্লবীদের কঠোর সাজা দিয়েছিলেন। আন্দোলন দমন করার জন্য নির্মম অত্যাচার শুরু করেছিলেন। ওই সময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনের অংশগ্রহণ করেছিলেন সুশীল সেন নামক ১৩ বছর বয়সই এক বালক। যার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়। ওই সময় নিয়ম ছিল ১৫ বছর বয়সের চেয়ে কম কাউকে বেত্রাঘাত করা যাবে না। সেই নিয়ম ভঙ্গ করে বিচারক কিংসফোর্ট রায় দেন ১৫ টি বেত্রাঘাতের। সেই রায় অনুযায়ী বেত্রাঘাত করায় সুশীল সেন রক্তাক্ত হয়ে সেখানেই কাতরাতে কাতরাতে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। এই নির্মম আচরণে বাংলার তরুণ সমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। শুরু হয় কিংসফোর্ডকে হত্যা করার পরিকল্পনা। আর এই পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন ওই সময়ে বারীনকুমার ঘোষের কলকাতাস্থ মানিকতলায় মুরারীপুকুরে বাগান বাড়িতে সংগঠিত হওয়া একটি সশস্ত্র বিপ্লবী দল। যে দলটি ইতিহাসে পাতায় “যুগান্তর বিপ্লবী” দল নামে পরিচিত হয়ে রয়েছে।
কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য যুগান্তরের বিপ্লবীরা, হেমচন্দ্র দাস কানুনগোকে দিয়ে পুস্তক বোমা তৈরি করানো হয়। ১২০০ পৃষ্ঠার ওই পুস্তক বোমা ব্রিটিশ বিচারক কিংসফোর্ডের গার্ডেনরিচের ঠিকানায় পার্সেল করে পাঠানো হয়। তবে দুর্ভাগ্যবশত কিংসফোর্ড সেই বইটি না খুলে, তুলে রাখে আলমারিতে। যার ফলে বিফল হয়ে যায় বিপ্লবীদের এই পরিকল্পনা।
নিরাপত্তার কারণে কিংসফোর্ডকে কলকাতা থেকে বিহারের মজফফরপুরে বদলি করে দেওয়া হয়।
এরপর সুবোধ মল্লিক, হেমচন্দ্র, চারুদত্ত, বারীনকুমার ও অরবিন্দ ঘোষের সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে কিংসফোর্ডকে হত্যা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরামের উপর।
কিংসফোর্ড হত্যার উদ্দেশ্যে ১৯০৮ সালের ১৫ এপ্রিল, প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু মুজাফফরপুর রেল স্টেশনে মিলিত হয়ে রওনা দিলেন ক্লাব হাউজের দিকে। কারন ইউরোপিয়ান ক্লাবে তাস খেলতে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সাদা ফিটন গাড়িতে করে যেতেন কিংসফোর্ড এবং ঠিক সন্ধ্যে সাড়ে আটটা নাগাদ তিনি ফিরতেন। সেখানেই তারা রিভলবার ও বোমা নিয়ে প্রস্তুত থাকে এবং সতর্কতার সাথে অপেক্ষা করতে থাকেন। যাতে এইবার কোনভাবে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ না হয়। সেই জন্য তারা ঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে থাকে। এইভাবে কেটে যায় পাঁচদিন। এরপর ষষ্ঠদিন অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল ১৯০৮, এই দিনটি তারা তাদের এই অভিযান পরিচালনা করার সঠিক সময় বলে বিবেচনা করে। ওইদিন ঠিক রাত আটটায় সাদা ফিটন গাড়িটি এগিয়ে আসছিল অন্ধকার পথ ধরে। একটু কাছে আসতেই গাড়িটিকে লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়ে মারে তারা। পরিকল্পনা মতো গাড়িতেই বিস্ফোরিত হয় বোমাটি কিন্তু এরপরেও ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকী কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে ব্যর্থ হন। কারণ ওইদিন ওই গাড়িতে কিংসফোর্ডের বদলে ছিলেন ইংরেজ মিসেস কেনেডি ও তার কন্যা সন্তান।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থল আসেন পুলিশ এবং ঘোষণা করে যে আক্রমণকারীকে ধরতে সাহায্য করলে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। ততক্ষণে ওই দুই বিপ্লবী পালিয়ে গিয়েছিলেন মোজাফফরপুর থেকে। আত্মরক্ষার স্বার্থে তারা তাদের কাছে দুটি রিভলবার সংরক্ষণ করে এবং দুজন দুটি আলাদা পথে পালিয়ে যান। সকাল আটটা নাগাদ তারা পায়ে হেঁটে মুজাফফরপুর থেকে ওয়েনি স্টেশনে পৌঁছান। ওই স্টেশনের কাছে একটি দোকানে জল খেতে গিয়ে কনস্টেবলের হাতে ধরা পড়ে যান ক্ষুদিরাম। তবে সেখান থেকে প্রফুল্ল চাকী রক্ষা পেয়ে গেলেও অবশেষে ধরা পড়ে যাওয়ায় তিনি নিজের রিভলবারের গুলিতে আত্মঘাতী হন(দ্বিমত রয়েছে এই তথ্য নিয়ে)।
তিনি ধরা পড়ে যাওয়ার পরও তাঁর থেকে কোনরকম কোন গোপন তথ্য বা কোন সহকারীর পরিচয় পাননি ব্রিটিশরা এবং তিনি নিজের ওপর বোমা নিক্ষেপে সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুসারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। কিন্তু সেই আদেশ শুনেও তাঁর চোখে মুখে কোন রকমের কোন ভয়ের বা কষ্টে ছাপ দেখতে পাননি বিচারপতি। তিনি সেই রায় হাসিমুখে গ্রহণ করেছিল।
এরপর ১৯০৮ সালে ১১ আগস্ট মজফফরপুর জেলেই ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তখন তার বয়স ছিল ১৮ বৎসর ৭ মাস ১১দিন।
এই ফাঁসী কার্যকর করার আগে তাঁর শেষ ইচ্ছা কি জানতে চাওয়া হলে – তিনি জানিয়েছিলেন যে, ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি পেলে তাঁর বোমা বানানোর শিক্ষা তিনি ভারতবর্ষের তরুণ সমাজকে শিখিয়ে যেতে চান। কিন্তু সেই ইচ্ছে তার ইচ্ছে হয়েই রয়ে গিয়েছিল।
এর পরিবর্তে তার দ্বিতীয় ইচ্ছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর বোন অরূপাদেবীর সাথে তিনি দেখা করতে চান। কিন্তু তাঁর জামাইবাবু বাধা দেওয়ার জন্য তাঁর সেই ইচ্ছেও পূরণ হয় না। তবে তাঁকে বোনের স্নেহে আশ্রয় দেওয়া মেদেনীপুরের উকিল সৈয়দ আব্দুল ওয়াজেদের বোন (নাম জানা যায় নি) তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন নিজের বিপদের কথা চিন্তা না করেই।
তাঁর স্মরণে ‘একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি।’ এই গানটি রচনা করেছিলেন বাঁকুড়ার লোককবি পীতাম্বর দাস। যা পরবর্তীকালে অর্থাৎ দেশ স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের সুখ্যাত সংগীতশিল্পী লতা মাঙ্গেশকর এই গানটি রেকর্ড করেছিলেন।