অফবিট

ব্রিটেন ও রাশিয়ার দ্বন্দ্বের বলি হতে হয়েছিল তিব্বতকে

গগনচুম্বী পর্বত, অসাধারন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এবং নিজস্ব সংস্কৃতিতে পরিপূর্ন একটি অঞ্চল তিব্বত যেটি কয়েক দশক আগেও একটি স্বাধীন দেশ ছিল। উত্তর হিমালয়ের কোলে বারো লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই তিব্বত বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতম অঞ্চল যেখানে জনবসতি রয়েছে। তিব্বতের বিভিন্ন অঞ্চলের গড় উচ্চতা ৪,৯০০ মিটার। অতীব শান্ত এই দেশটি বর্তমানে চীনের অধীনে রয়েছে, তবে এই অবস্থার জন্য চীনের পাশাপাশি ব্রিটিশরাও সমান দায়ী। তিব্বতকে ব্রিটেন একরকম উপহার দেয় চীনকে। একটা সময় বলা হত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনও সূর্যাস্ত হয়না, এশিয়া থেকে শুরু করে আফ্রিকা হয়ে আমেরিকা মহাদেশ পর্যন্ত ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। ভারতবর্ষেও প্রায় দুইশো বছর রাজত্ব করেছে ব্রিটিশরা। সেই ব্রিটেন ভারতের প্রতিবেশী এই তিব্বতকে চীনকে দিয়ে দেওয়ার পিছনে ছিল ব্রিটিশদের এক গভীর রাজনৈতিক অভিসন্ধি যার কারনে তিব্বতবাসী চিরকালের জন্য চীনের অধীনে চলে যায়। তিব্বত দখলের পর সেখানকার সাংস্কৃতিক পরিবর্তন করে চীন ব্যাপক আকারে।

বর্তমান তিব্বতীয় সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল ৬০০ বিসিতে। ওই সময়ের তিব্বতের ইতিহাসকে রাজতন্ত্রে যুগ বলা হয়। তিব্বতে রাজতন্ত্রের সূচনা হয় রাজা নামরি সোংটসেনের দ্বারা। তার শাসনকালেই তিব্বতের রাজধানী করা হয় লাসাকে। সেসময়েও চীনের সাথে তিব্বতের সমস্যা ছিল সীমানাকে নিয়ে। তখনও চীন তিব্বতকে দখল করবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু চীন তার উদ্দেশ্যে সফল হয়নি। দুইশো বছর ধরে চীন ও তিব্বতের মধ্যে সীমানাকে কেন্দ্র করে বিবাদের পর ৮২১ বিসিতে উভয়দেশের মধ্যে একটি চুক্তি হয় যাকে চীন তিব্বত শান্তি চুক্তি বলা হয়। এই চুক্তিতে ঠিক হয় উভয়দেশই নিজের নিজের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, একে অন্যকে আক্রমন করবেনা। বর্তমানে চীন সামরিক শক্তির বিচারে বিশ্বের তৃতীয় শক্তিশালী দেশ এবং বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থনীতির দেশ কিন্তু ৮০০ বিসি সময়কালে চীন আজকের মতো এতটা শক্তিশালী ছিলনা। বরং সেসময় তিব্বতের প্রভাব ছিল অনেক বেশী। তিব্বতের রাজারা তিব্বতকে একটি শক্তিশালী দেশে পরিনত করেছিল। যেমন তিব্বতের রাজা ত্রিসং ডিউটসেন তার সেনাবাহিনীকে এতটাই শক্তিশালী করেছিল যে শত্রু তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও ভয় পেত। এই জন্য ৮২১ বিসিতে চীন নিজে থেকে তিব্বতকে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিল। চীন ও তিব্বতের বহু জায়গাতেই এই চুক্তির প্রমান রয়েছে। লাসাতে জোখাং বৌদ্ধমঠে এই চুক্তির নিদর্শন রাখা রয়েছে। এরপর কালের পরিবর্তনে ১২৪০ সালে তিব্বত দখল করে নেয় মোঙ্গলরা।

১২০৯ সাল থেকেই দক্ষিন এশিয়াতে মোঙ্গলদের উত্থান হয়। ১২৪৪ সাল পর্যন্ত তিব্বত মোঙ্গলদের অধীনেই ছিল, তিব্বতের পাশাপাশি চীনেরও অনেকাংশ মোঙ্গলদের অধীনে ছিল। কিন্ত মোঙ্গলরা কখনও তিব্বতের ধর্মীয় সংস্কৃতির ক্ষতিসাধন করেনি এবং তিব্বতকে চীনের সাথেও যুক্ত করেনি। মোঙ্গলরা তিব্বতকে রক্ষা করেছিল তার প্রধান কারন ছিল গোদান খান, মোঙ্গল শাসক চেঙ্গিস খানের নাতি ছিল গোদান খান যাকে তিব্বত সহ আরও উত্তর পূর্বে সেনা অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। গোদান খানের সাথে পরিচয় হয়েছিল বৌদ্ধ লামা সাকিয়া পন্ডিতার। গোদান খান লামা সাকিয়া পন্ডিতার দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হন যে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেন। এই কারনেই তিব্বতের ধর্মীয় সংস্কৃতি নষ্ট করেনি মোঙ্গলরা। এরপর ১৬৪৫ সালে তিব্বতে শুরু হয় পঞ্চম দলাই লামার শাসন, তিনি তিব্বতের ধর্মীয় গুরু ছিলেন। তিব্বতের সাথে চুক্তি থাকলেও চীন তিব্বত দখলের স্বপ্ন কখনও ভোলেনি।

১৭১৭ সাল থেকে তিব্বতের সার্বভৌমত্বে পুনরায় সমস্যা দেখা দেয়। মোঙ্গলদের বিভিন্ন জাতি পুনরায় তিব্বত আক্রমন করে তিব্বত দখল করে নেয়। এসময় তিব্বতকে মোঙ্গল শাসন থেকে মুক্ত করে চীনের কিং রাজবংশ। চীনের সবথেকে শক্তিশালী রাজবংশ বলা হয় এই কিং রাজবংশকে। তিব্বত থেকে মোঙ্গলদের সরিয়ে কিং রাজবংশ তিব্বত দখল করে নেয়। এভাবে ৬০০ বিসির পর প্রথম তিব্বত চীনের অধীনে চলে যায়। কিং রাজবংশ তিব্বত ছাড়াও নেপাল, মঙ্গোলিয়া, কোরিয়াও দখল করে নিয়েছিল। ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পর ১৭৭৪ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস তিব্বতে দূত পাঠায় বানিজ্যের জন্য ও কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কিন্তু তিব্বত সেসময় ইউরোপীয়ানদের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিলনা। কিন্তু ব্রিটিশদের বরাবরই তিব্বতের প্রতি আগ্রহ ছিল কারন তিব্বত মধ্য এশিয়া ও চীনের সাথে বানিজ্যের জন্য প্রবেশপথ ছিল। ওয়ারেন হেস্টিংসের সময়ে তিব্বতের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা ব্যার্থ হবার পর বহু বছর তিব্বতের সাথে কোনও যোগাযোগ ছিলনা ব্রিটিশদের। বিংশ শতকে ভারতে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের সময়ে তিব্বতে রাশিয়ান আক্রমনের সম্ভবনা তৈরি হয়। ব্রিটিশ প্রশাসন এতে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের ভয় ছিল রাশিয়া তিব্বত দখল করতে পারে তাহলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনও সমস্যায় পড়বে। এজন্য লর্ড কার্জন ১৯০৩ সালে কর্নেল ইয়াংহাসবেন্ডকে একদল গোর্খার সাথে তিব্বত পাঠায় আলোচনার জন্য। কর্নেল ইয়াংহাসবেন্ড তিব্বতের খাম্বারজং পৌঁছায় জুলাই মাসে। কিন্ত তিব্বত কর্নেল ইয়াংহাসবেন্ড ও তার দলের সাথে কোনওরকম আলোচনা করেনি উপরন্ত খাম্বারজংএ সেনাবাহিনী মোতায়েন করে তিব্বত। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে লর্ড কার্জন তিব্বতের গিয়ানতসেতে সেনা অভিযানের আবেদন করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে। ব্রিটেনের বিদেশমন্ত্রী লর্ড ল্যান্সডাউন সেনা অভিযানের অনুমোদন দিয়ে দেয়। আগস্ট, ১৯০৪ সালে গিয়ানতসে অভিমুখে যাত্রা শুরু করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। তিব্বতের সেনাবাহিনীর কাছে আধুনিক অস্ত্র না থাকায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয় তিব্বতের সেনাবাহিনী এবং সাতশো জন তিব্বতীয় সেনা নিহত হয়। এই যুদ্ধে একজন ব্রিটিশ সেনাও মারা যায়নি। এই যুদ্ধের পরও তিব্বত ব্রিটেনের সাথে সন্ধি করতে রাজি না হওয়ায় কর্নেল ইয়াংহাসবেন্ডের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সেনা তিব্বতের বেশ কীছু অঞ্চল দখল করে রাজধানী লাসাতে এসে পৌঁছায়। তৎকালীন দলাই লামা তিব্বত ছেড়ে পালিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে তিব্বত ব্রিটেনের সাথে লাসা চুক্তি করে। এই চুক্তির শর্ত অত্যন্ত কঠিন ছিল তিব্বতের জন্য। এই চুক্তি অনুযায়ী তিব্বতকে ৭৫ লাখ রুপী ক্ষতিপূরন দেওয়ার কথা বলা হয় এবং ক্ষতিপূরনের নিশ্চয়তা হিসাবে চুম্বি উপত্যকা ৭৫ বছরের জন্য ব্রিটিশরা নিয়ে নেয়। গিয়ানতসে, গারটুক ও ইয়াতুংএ বানিজ্যপথও শুরু করতে বাধ্য হয় তিব্বত। এই চুক্তি অনুযায়ী তিব্বত ব্রিটেন বাদে অন্য কোনও দেশের সাহায্যে রেলপথ, সড়ক ও টেলিগ্রাফ পোস্ট নির্মান করতে পারতোনা। লাসা চুক্তিতে তিব্বতের বিদেশনীতিতে ব্রিটেন নিজেদের নিয়ন্ত্রন নেয় কীছুটা। এই লাসা চুক্তির কঠিন শর্তের বিরোধীতা করে রাশিয়া। ব্রিটেন বুঝে যায় চুক্তির শর্ত না কমালে রাশিয়া তিব্বত আক্রমন করতে পারে। এর জন্য ব্রিটেন লাসা চুক্তির শর্ত কীছুটা কম করে, ব্রিটেন তিব্বতকে দিতে বলা ৭৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরন কমিয়ে ২৫ লাখ টাকা করে দেয়। ব্রিটেন এটাও জানায় তিব্বতের ক্ষতিপূরন দেওয়া সম্পূর্ন হলে ব্রিটেন চুম্বি উপত্যকা থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেবে। তবে ব্রিটেন জানতো এভাবে রাশিয়াকে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবেনা। এর জন্য লাসা চুক্তির দুই বছর পর ব্রিটেন চীনের সাথে আলোচনায় বসে। ব্রিটেন চীনকে জানায় চীন যদি তাদের একটি ক্ষতিপূরন দেয় তাহলে তিব্বতের কোনও ব্যাপারে ব্রিটেন হস্তক্ষেপ করবেনা। এইসময় থেকেই ব্রিটেন তিব্বতকে চীনের কাছে দেওয়ার পক্রিয়া শুরু করে। ১৯১১ সাল চীন, ব্রিটেন ও তিব্বতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। ১৯১১ সালে ডঃ সান ইয়াত সেনের নেতৃত্বে চীনে বিদ্রোহ শুরু হয়। এই সুযোগে তিব্বত চীনের প্রভাবকে তাদের উপর থেকে সরিয়ে দেয়। চীন পুনরায় তিব্বতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। ব্রিটেন দেখলো তিব্বতে চীনের প্রভাব না থাকলে রাশিয়া তিব্বত দখল করতে পারে। এই জন্য ১৯১৪ সালে ব্রিটেন সিমলাতে চীন ও তিব্বতের প্রতিনিধিদের ডাকে একটি বৈঠকের জন্য। এই বৈঠকে ব্রিটেন তিব্বতকে দুই ভাগে বিভক্ত করে আউটার তিব্বত ও ইনার তিব্বত। আউটার তিব্বতকে স্বাধীন ঘোষনা করা হয় এবং ইনার তিব্বতকে চীনকে দিয়ে দেওয়া হয়। তিব্বত চীনের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে চীন থেকে মুক্ত হলেও সরাসরি ব্রিটেনের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা ছিলনা। অতীতে তিব্বত ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। যার জন্য ব্রিটেনের দাবী বাধ্যহয়ে মেনে নেয় তিব্বত। এভাবে রাশিয়ার ভয়ে নিজেদের স্বার্থে ব্রিটিশরা তিব্বত উপহার দেয় চীনকে। 

১৯৫০ সালে চীন সামরিক অভিযানের মাধ্যমে তিব্বতে সম্পূর্ন দখল করে নেয়, তৎকালীন দলাই লামা ভারতে আশ্রয় নেয়। সেই থেকে আজও তিব্বত চীনের অধীনেই রয়েছে। ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলা সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্বের বলি হয় হিমালয়ের কোলে অবস্থিত তিব্বত নামক ছোট্ট দেশটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *