অফবিট

কুকুরেরা গন্ধ শুঁকেও খুঁজে না পেতে অবাক করা প্ল্যান করেছিল কয়েদী। বিখ্যাত কিছু জেল পালানোর ঘটনা

পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই অপরাধীদের শাস্তির দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আর কি ধরনের শাস্তি অপরাধীকে ভোগ করতে হবে তা নির্ভর করে অপরাধের ধরণ ও পরিমাণের উপর। কেউ মৃত্যুদণ্ড ভোগ করে, কেউ যাবজ্জীবন,  কেউ আবার বিভিন্ন মেয়াদের কারাবাস। আর অপরাধীদের ধরার জন্য পুলিশদের বের করতে হয় নানা ধরনের অভিনব সব পন্থা যার জন্য তারা অনেক খ্যাতিও অর্জন করে থাকে। তবে এবার যদি বলি পুলিশ নয় ইতিহাসের পাতায় বিখ্যাত হয়ে রয়েছে কিছু অপরাধী। কি অবাক হলেন শুনে? হওয়াটায় স্বাভাবিক। তবে এটাই সত্য। কারন তারা তাদের বন্দী দশা থেকে মুক্তি পেতে যেসমস্ত অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছিল তা সত্যি হতবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা ছিল। কড়া পাহারার মধ্যে থেকেও তারা পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এই রকমই জেল থেকে পালানোর বিখ্যাত কিছু ঘটনাগুলির মধ্যে অন্যতম হল-  

১. জন ডিলিঞ্জার ও তার কাঠের পিস্তল

আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত এক সন্ত্রাসী ছিলেন জন ডিলিঞ্জার। যিনি ডিলিঞ্জার গ্যাঙের অন্যতম এক সদস্য ছিলেন। তার অপরাধের তালিকায় ছিল ২৪টি ব্যাংক ডাকাতি, ৪টি পুলিশ স্টেশনে হামলা করা। এছাড়াও আরও অনেক অপরাধের সাথে জড়িত ছিল তার নাম। অবশেষে জন ডিলিঞ্জার ১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে অ্যারিজোনার টুস্কনে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন পুলিশের কাছে। এরপর ইন্ডিয়ানার লেক কাউন্টি নামের এই জেলে স্থান হয় তার।  

তবে বেশি দিন তাকে জেলে আটকিয়ে রাখা যায় নি কারন তিনি মার্চ মাসের ৩ তারিখে এমন এক কান্ড ঘটিয়ে ছিলেন যা গোটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই হতবাক করে দিয়েছিল। তিনি সামান্য কাঠ কেটে তৈরি করেছিলেন এক খেলনা পিস্তল এবং ওই পিস্তলটি আসলের মতো দেখানোর জন্য তার উপর জুতার কালি ব্যবহার করেছিল। এরপর তিনি প্রহরীদের ওই নকল পিস্তল দিয়ে ভয় দেখিয়েই পালিয়ে যান এবং যাতে তিনি সেখান থেকে তাড়াতাড়ি পালাতে পারে তার জন্য সাথে করে শেরিফের নতুন কেনা V-8 ফোর্ড গাড়িটি নিয়ে গিয়েছিলেন। 

তবে খুব বেশিদিনে পালিয়ে বাঁচতে পারেননি জন ডিলিঞ্জার। ১৯৩৪ সালের ২২ জুলাই তার উপর পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের ৪টি গুলি লাগার কারনে ৩১ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তার। 

২. দ্য গ্রেট এস্কেপ

বেশ কিছু জেল থেকে পালানোর ঘটনার সাক্ষী হয়ে রয়েছে ইতিহাস যা বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই রকমই জেল থেকে পালানোর একটি ঘটনা ঘটেছিল যা ইতিহাসের পাতায় ‘দ্য গ্রেট এস্কেপ’ নামে সুপরিচিত হয়ে রয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিমান বাহিনীর লোকদেরকে বন্দী হিসেবে রাখার জন্য জার্মানরা তৈরি করেছিল ‘স্টালাগ লাফ্‌ট ৩’ এই যুদ্ধবন্দীদের ক্যাম্পটি। সেখানে বন্দী থাকা মানুষদের মধ্যে একজন ছিলেন রজার জয়েস বুশেল যিনি অক্সিলিয়ারি এয়ার ফোর্সের স্কোয়াড্রন লিডার ছিলেন। বুশেল ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে পরিকল্পনা করেছিলেন সেখান থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পালানোর,  তবে একটি নয়, তিনটি এবং তার সাথে সবাইকে নিয়ে। এগুলোর সাংকেতিক নাম টম, ডিক এবং হ্যারি ছিল।    

প্রহরীদের চোখে যাতে সহজে ধরা না পড়ে সেই রকম জায়গা নির্বাচন করেছিলেন সুড়ঙ্গগুলোর করার জন্য। প্রতিটি সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল ভু-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০ ফুট নিচে, এর পিছনে কারন ছিল যাতে পেরিমিটার মাইক্রোফোনের সাহায্যে তাদের অস্তিত্ব ধরা না পড়ে। এই সুড়ঙ্গগুলি আকার বেশ ছোট ছিল, শরীরটি যাতে কোনো রকমে ঢুকিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেরকম। ভেতরে খননকাজের সুবিধার্থে বানানো হয়েছিল এয়ার পাম্প এবং ওয়ার্কশপ। ভেতরের কাঠ ব্যবহার করা হয়েছিল যাতে বালি ধ্বসে না পড়ে। এই কাজে ব্যবহৃত করা কাঠগুলি তারা জোগাড় করেছিল নিজেদের খাটের কাঠ থেকে শুরু করে ক্যাম্পের বিভিন্ন জায়গা থেকে। সুড়ঙ্গের ভেতরে কাজের সুবিধার জন্য যুদ্ধবন্দীরা বৈদ্যুতিক বাতি লাগিয়েছিল এবং মাটি আনা-নেওয়া করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল ছোট গাড়ি। ঠিক যেমনভাবে বিভিন্ন খনিতে রেললাইনের উপর দিয়ে চলা ছোট গাড়িতে করে মাল আনা- নেওয়া করা হয় ঠিক সেই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল এই কাজটি করার জন্য। প্রায় পাঁচ মাস ধরে প্রায় ১৩০ টন মাটি এই গাড়ির সাহায্যে সরাতে সক্ষম হয়েছিল।

‘হ্যারি’র খননকার্য ১৯৪৪ সালের মার্চে সম্পন্ন হয়। তবে সেই সময় একটা ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছিল। এতদিন ধরে কঠোর পরিশ্রম করা যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে কয়েকজনকে এই ক্যাম্প থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বাকি বন্দীরা অমাবস্যার অন্ধকারাচ্ছন্ন এক রাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। তাদের অপেক্ষা অবসান ঘটিয়ে আসে সেই সময়, মার্চের ২৪ তারিখ। যুদ্ধবন্দীরা এক এক করে সুড়ঙ্গপথ দিয়ে পালাতে থাকেন। এভাবে করে ৭৬ জন বন্দী সেখান থেকে বেরোতে সক্ষম হয়েছিল। তবে এরপরই বেঁধেছিল এক বড়সড় ঝামেলা।  ২৫ তারিখের ভোর ৫টার সময় যখন  ৭৭তম বন্দী সুড়ঙ্গ থেকে বের হয় সেই সময় এক প্রহরীর নজরে চলে আসে। এরপরই পালিয়ে যাওয়া বন্দীদের খোঁজে শুরু হয় সাঁড়াশি অভিযান। ৭৬ জনের বন্দীদের মধ্যে  ৭৩ জন বন্দীই ধরা পড়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল ৫০ জনকে এবং বাকিদেরকে ভোগ করতে হয়েছিল সেই বন্দীত্ব এবং নির্যাতন।

এরপর এই সুড়ঙ্গ খনন করার জন্য কি কি ব্যবহার করা হয়েছিল তার  হিসেব করে দেখেছিলেন জার্মানরা। তাদের হিসেবের তালিকায় ছিল খাটের পাটাতন ৪,০০০,  ডাবল বাঙ্ক খাট ৯০টি, ম্যাট্রেস ৬৩৫টি,  বেড কভার ১৯২টি, বালিশের কভার ১৬১টি,  ২০ জন একসাথে খেতে পারার মতো টেবিল ৫১টি, সিঙ্গেল টেবিল ১০টি, চেয়ার ৩৪টি, বেঞ্চ ৭৬টি, কোলবালিশ ১,২১২টি, কাঠের তক্তা ১,৩৭০টি, ছুরি ১,২১৯টি, চামচ ৪৫৮টি, কাটা চামচ ৫৮২টি, ল্যাম্প ৬৯টি, জলের বোতল ২৪৬টি, কোদাল ৩০টি, বৈদ্যুতিক তার ১,০০০ ফুট, দড়ি ৬০০ ফুট এবং তোয়ালে ৩,৪২৪টি ইত্যাদি জিনিসপত্র।  

৩. আলফ্রেড ওয়েটজ্‌লার

আলফ্রেড ওয়েটজ্‌লার ছিলেন সেই সমস্ত ইহুদীদের মধ্যে একজন যারা হলোকাস্টের সময় ইহুদী অসউইৎজ ডেথ ক্যাম্পের ভয়াবহতা থেকে নিজেদের প্রান বাঁচাতে পেরেছিলেন। এই ক্যাম্প থেকে তিনি একা নয় তার সাথে পালিয়েছিলেন রুডলফ ভ্রবা। তারা এই ক্যাম্পের বর্ণনা সর্বপ্রথম বিস্তারিত করার কারনে বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। ভ্রবা এবং ওয়েটজ্‌লার ৩২ পৃষ্ঠার রিপোর্টের মধ্যে ছিল অসউইৎজ ক্যাম্পের গ্রাউন্ড প্ল্যান, মানবদেহ পোড়ানোর চুল্লির বর্ণনা, গ্যাস চেম্বারের কন্সট্রাকশন প্ল্যান এবং গ্যাস চেম্বারে ব্যবহৃত জিক্লন বি গ্যাসের একটি ক্যানিস্টারের মোড়ক। এই রিপোর্টের তথ্যের অনুযায়ী পরবর্তীকালে মিত্রবাহিনী নাৎসি বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। যার ফলে ১,২০,০০০ হাঙ্গেরিয়ান ইহুদী রক্ষা পেয়েছিল।

ওয়েটজ্‌লার এবং ভ্রবা ১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাসে ৭ তারিখ শুক্রবার দুপুর দুটোর দিকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল এক কাঠের স্তুপের আড়ালে। এই এলাকাটি বির্কেনয়ের কাঁটাতার দেওয়া এলাকার বাইরে হলেও তখনও তাদের পুরোপুরি মুক্তি মেলেনি। কারন এই এলাকাটি আরেকটি বড় এলাকার অংশ ছিল যা সার্বক্ষণিক প্রহরারদের দ্বারা চারদিক থেকে ঘেরা থাকত। তারা যাতে ধরা না পড়ে সেই জন্য ক্যাম্পের অন্যান্য বন্দীরা তাদের লুকিয়ে থাকার জায়গাটির চারদিকে কাঠের বোর্ড জমা করে রেখেছিলেন। এমনকি তাদের কোনো অস্তিত্ব যাতে কুকুরেরা গন্ধ শুঁকেও খুঁজে না পায় তার জন্য তারা সেই জায়গাটিতে গ্যাসোলিনে ভিজিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলেন। এইভাবে তারা সেখানে ৪টি রাত কাটিয়ে দিয়েছিলেন।  

১০ এপ্রিল তারা দুজনে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন ১৩৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পোল্যান্ডের সীমান্তের উদ্দেশ্যে।  তাদের পরনে ছিল ডাচ স্যুট, ওভারকোট ও বুট এবং  দিক নির্দেশক হিসাবে তাদের কাছে ছিল বাচ্চাদের মানচিত্রের বইয়ের একটি পৃষ্ঠা মাত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *