অফবিট

ইসলামিক গ্রুপের বিমান হাইজ্যাকের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সেরা কাউন্টার টেরিরিজম

দিনটা ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৪, অন্যান্য দিনের মতোই কর্মব্যস্ত আলজেরিয়ার রাজধানী আলজেরিস এর হউরি বোঔমেডিয়েন বিমানবন্দর। সকাল এগারোটা নাগাদ এয়ারফ্রান্সের ৮৯৬৯ বিমান প্যারিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার জন্য তৈরি। সমস্ত যাত্রী সিটবেল্ট বেঁধে নিয়েছে, বিমানের ক্যাপ্টেন ও সহকারী পাইলট যাত্রা করবার জন্য তৈরি কিন্তু একদম শেষ মহূর্তে হঠাৎই বিমানে প্রবেশ করে চারজন ব্যাক্তি। সশস্ত্র এই চারজন ব্যাক্তির গায়ে আলজেরিয়ান রাষ্ট্রপতির বিশেষ পুলিশের পোষাক ছিল এবং পোষাকে এয়ার আলজেরিয়ার লোগো ছিল। দুজন পুলিশ যাত্রীদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করা শুরু করে এবং বাকী দুজন হাতিয়ার নিয়ে পাহাড়া দিতে থাকে। সময় পেরিয়ে যাওয়া সত্বেও ৮৯৬৯ বিমান রানওয়ে থেকে টেকঅফ না করায়, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সন্দেহ হয়। খবর দেওয়া হয় আলজেরিয়ান পুলিশের বিশেষ দল জিআইএসকে। কিছুক্ষনের মধ্যেই জিআইএস বিমানকে ঘিরে ধরে। এরই মধ্যে বিমানে থাকা দুজন পুলিশ যাত্রীদের দিকে বন্দুক তুলে ধরে, সাথে সাথে সবাই বুঝে যায় বিমান হাইজ্যাক হয়েছে। আসলে বিমানে পুলিশের পোষাকে থাকা ওই চার ব্যাক্তি আর্মড ইসলামিক গ্রুপ বা জিআইএ সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য ছিল। হ্যান্ড গ্রেনেড, ডিনামাইট, একে ৪৭ বন্দুক, উজি সাব মেশিনগানের মতো ভারী হাতিয়ার যুক্ত একটি চার সন্ত্রাসীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এই বিমান হাইজ্যাকের।

এয়ার ফ্রান্সের বিমান ৮৯৬৯ এ থাকা জিআইএ জঙ্গি সংগঠনের চারজনের নেতৃত্ব ভার ছিল আবদুল আবদুল্লাহ ইয়াহিয়ার হাতে। আলজেরিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দের রহমান সাথে সাথে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে পৌঁছে যান। সেখান থেকে বিমানে থাকা সন্ত্রাসীদের সাথে কথা শুরু হয়। বিমানের ককপিট থেকে আবদুল ইয়াহিয়া জানায় ইসলামিক স্টেটের দুজন সদস্য আব্বাসি মাদানি ও আলি বেলহাজকে মুক্তি দিতে হবে। এই দুজনকেই আলজেরিয়ান সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছিল। আব্দের রহমান জঙ্গিদের জানায় সে আলজেরিয়ান সরকারকে সাথে কথা বলবে কিন্তু তার আগে বিমানে থাকা বাচ্চা ও মহিলাদের নিরাপদে ছেড়ে দিতে হবে। বিমানে মোট ২২০ জন যাত্রী ও বারো জন বিমান কর্মী ছিল। এদিকে ফ্রান্সে তখন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড ব্লাডুর, ফ্রান্সের বিদেশমন্ত্রী অ্যালান জু এবং নিরাপত্তা অফিসারদের মধ্যে জরুরি বৈঠক শুরু হয়ে যায়। এর দুই ঘন্টা পর বিমানের পাইলটকে নির্দেশ দেওয়া হয় বিমানকে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে যাত্রা করানোর। কিন্তু ক্যাপ্টেন জানায় রানওয়ে বন্ধ করে দিয়েছে আলজেরিয়ান কর্তৃপক্ষ তাই বিমান টেকঅফ করা সম্ভব নয়। পাইলট বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে রানওয়ে পরিষ্কারের অনুরোধ জানায় কিন্তু আলজেরিয়ান কর্তৃপক্ষ পাইলটের কথা শোনেনি। সন্ত্রাসীরা বিমান বোম্ব দিয়ে উড়িয়ে দেবার ধমক দেয় কিন্তু তাও রানওয়ে খোলা হয়নি। এরপর বিমানে থাকা এক আলজেরিয়ান পুলিশকে মাথায় গুলি করে বিমান থেকে ফেলে দেয় জঙ্গিরা, যা দেখে সবাই ভীত হয়ে পড়ে। এরপর আবার বিমান থেকে আলজেরিয়ান কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে জঙ্গিরা এবং পুনরায় রানওয়ে খোলার নির্দেশ দেয় কিন্তু এবারও আলজেরিয়ান কর্তৃপক্ষ অসম্মতি জানায়। এরপর জঙ্গিরা ৪৮ বছর বয়সী বুই গিয়াং নামে একজন ভিয়েতনামি যাত্রীকেও কপালে গুলি করে মেরে ফেলে। এই পুরো ঘটনা শুনে ফ্রান্স সরকার আলজেরিয়াকে অনুরোধ করে তাদের মিলিটারি দল পাঠাবার আলজেরিয়া বিমান বন্দরে যাতে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর বিশেষ দলের সদস্যরা থাকবে। কিন্তু আলজেরিয়ান সরকার ফ্রান্সের এই অনুরোধ প্রত্যাখান করে দেয়, আলজেরিয়ান সরকার তাদের দেশে হওয়া এই রাজনৈতিক সংকটে বাইরের দেশের কোনও সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে দিতে চাইছিল না। এইসময় আলজেরিয়াতে গৃহযুদ্ধ চলছিল যার কারনে আলজেরিয়ার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া যে কোনও বিমানে প্রতিনিয়ত মিসাইল আক্রমনের ভয় ছিলো। যে বিমানটি হাইজ্যাক করা হয়েছিলো সেটি এয়ারবাস এ ৩০০ মডেলের ছিল। এর আগেও ১৯৭৬ সালে উগান্ডাতে একটি এ ৩০০ বিমান হাইজ্যাক করা হয়েছিল। 

হাইজ্যাকের সাত ঘন্টা হয়ে যাওয়ার পরে পরিস্থিতি একটু শান্ত হয়। বিমানের ক্যাপ্টেন জঙ্গিদের সাথে একটু ভাব জমিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করে। এদিকে স্পেন সরকার ফ্রান্সের মিলিটারিকে স্পেনের মাজোরকাতে আসার অনুমতি দেয়। এখান থেকে আলজেরিয়ার দূরত্ব সবচেয়ে কম, যে কারনে যে কোনও পরিস্থিতির জন্য ফ্রান্সের মিলিটারি তৈরি থাকতে চাইছিল। সেই মতো সেদিন রাত আটটার সময় ফ্রান্সের বিশেষ মিলিটারি ফোর্স ন্যাশনাল জেন্ডারমেরি ইন্টারভেনশন গ্রুপ বা জিআইজিএন একটি এ ৩০০ বিমানে করে মাজোরকাতে উপস্থিত হয়। জিআইজিএন দল পালমা দে ম্যালরকা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর আলজেরিয়া সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দেয় ফ্রান্সের মিলিটারিকে আলজেরিয়াতে আসতে দেওয়া হবেনা।

২৫ ডিসেম্বর সকালে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড ব্লাডুর প্যারিস পৌঁছায় সেখানে আলজেরিয়ান গুপ্তচর সংস্থার এক এজেন্টের সাথে তার বৈঠক হয়। সেখানে জানা যায় হাইজ্যাকারদের আসল উদ্দেশ্য বিমানটিকে ফ্রান্সে নিয়ে এসে আইফেল টওয়ারকে ধ্বংস করা এতে বিমানে থাকা সমস্ত যাত্রী মারা যাবে। ২৫ ডিসেম্বর আবদুল ইয়াহিয়া বেশ কিছু যাত্রীকে মুক্ত করে দেয় যাদের মধ্যে বেশীরভাগই ছিল মহিলা ও বাচ্চা। কিন্ত তখনও বিমানে ১৭০ জন যাত্রী ছিল। 

ফ্রান্স সরকার আবদুল ইয়াহিয়ার মাকে আলজেরিয়া পাঠায় ছেলেকে অনুরোধ করে সব যাত্রীদের নিরাপদে ছেড়ে দেবার জন্য কিন্তু এই পদক্ষেপে আরও ক্ষেপে যায় আবদুল ইয়াহিয়া। জঙ্গিরা এরপর বিমানে থাকা ফ্রান্সের দূতাবাসে কাজ করা দুজন কর্মীকে আটক করে আলজেরিয়ান সরকারকে হুমকী দিয়ে বলে যদি রাত ৯ঃ৩০ এর মধ্যে রানওয়ে পরিষ্কার করে তাদের টেকঅফের অনুমতি না দেওয়া হয় তাহলে প্রতি ৩০ মিনিটে একজন করে যাত্রীকে হত্যা করা হবে। কিন্তু তাও আলজেরিয়ান সরকার সন্ত্রাসীদের কোন কথা শুনতে রাজি হয়নি।

রাত ৯ঃ৩০ এর পর আবদুল ইয়াহিয়া একজন ফ্রান্সের যাত্রীকে গুলি করে হত্যা করে তার মৃতদেহ বিমানের বাইরে ফেলে দেয়। এরপরেই ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি লিয়ামাইন জিরাউলকে স্পষ্ট জানায় এর পর প্রতিটি মানুষের মৃত্যুর দায় আলজেরিয়ান সরকারের হবে৷ ফ্রান্সের কথায় বাধ্য হয়ে আলজেরিয়া বিমান ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে টেকঅফের নির্দেশ দেয়। হাইজ্যাকের ৩৯ ঘন্টা পর, তিনজন যাত্রীর মৃত্যুর পর অবশেষে বিমান টেকঅফ করে কিন্তু বিমানে বেশী জ্বালানি না থাকার কারনে বিমানটি পুনরায় জ্বালানি সংগ্রহের জন্য মার্সেইলি প্রোভিন্স বিমানবন্দরে নামে। কিন্তু জঙ্গিরা জানত না বিমানবন্দরে আগে থেকেই মোতায়েন ছিল ফ্রান্সের এলিট জিআইজিএন কম্যান্ডো ইউনিট।

ফ্রান্সের সবচেয়ে দক্ষ কাউন্টার টেরিরিজম ইউনিট এই জিআইজিএন, বিমানটিকে আলজেরিয়ার বাইরে নিয়ে আসার পরিকল্পনা তাদেরই ছিল। মার্সেইল পৌঁছানোর পরই জঙ্গিরা যোগাযোগ করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এবং জানায় তাদের ২৭ টন জ্বালানি লাগবে। তারা এটাও জানায় বিমান সকাল ৯ঃ৪০ এ টেকঅফ করবে। 

বিমানে জ্বালানির দরকার ছিল নয় টন কিন্তু হাইজ্যাকাররা ২৭ টন জ্বালানি দাবি করায় জিআইজিএন বুঝে যায় প্যারিসে আক্রমন করতে চায় তারা। সাথে সাথে জিআইজিএন পরিকল্পনা করে যা হোক করে হোক সময় নষ্ট করতে হবে। সেজন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নির্দেশ দেওয়া হয় বিমানের ইঞ্জিন ঠিক করা হবে এবং জরুরী সামগ্রী বিমানে পাঠানো হবে সেজন্য দেরী হবে টেকঅফে। হাইজ্যাকাররা প্যারিসে সাংবাদিক সম্মেলন করবার কথা জানিয়েছিল, তার বদলে তাদের মার্সেইলিতেই সাংবাদিক সম্মেলনের কথা বলা হয় এতেও রাজী হয়ে যায় হাইজ্যাকাররা। 

এগুলো সবই জিআইজিএন এর পরিকল্পনা ছিল যাতে না বুঝেই তাদের ফাঁদে পা দেয় সন্ত্রাসীরা। বিমানে জরুরি জিনিস রাখা ও পরিষ্কারের জন্য জিআইজিএন এর কিছু কম্যান্ডো পরিষ্কার কর্মীর পোষাকে এসে বিমানের ভিতরের পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখে যায়। জিআইজিএন অপেক্ষা করছিল সন্ধ্যা হওয়ার তার পরেই তারা অপারেশন শুরু করবে। জিআইজিএন এর পুরো কম্যান্ডো ইউনিট তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। বেশ কিছু স্নাইপার তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় তৈরি ছিল। এদিকে বহুক্ষন ধরে কোন মিডিয়া কর্মী এবং জ্বালানি না আসায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল হাইজ্যাকাররা। তারা বিমানবন্দরে কন্ট্রোল টাওয়ার লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। এদিকে সন্ধ্যা হলে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে জিআইজিএন এর দল বিমানে সিঁড়ি লাগিয়ে প্রবেশ করে। প্রথম দলকে প্রবেশ করতে দেখে হাইজ্যাকাররা গুলি চালাতে থাকে, এই সুযোগে দ্বিতীয় দল অন্য দিক দিয়ে প্রবেশ করে। প্রথমেই একজন জঙ্গি মারা যায়। বাকী তিন জঙ্গী দুই দলকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকলে জিআইজিএন এর  অন্য একটি দল বিমানে প্রবেশ করে স্মোক গ্রেনেড ফেলে দেয় ফলে জঙ্গিরা সঠিক কিছু দেখতে পাচ্ছিলনা, তারা শুধু গুলি চালাচ্ছিল। এদিকে যাত্রীরা জিআইজিএন এর নির্দেশে আগেই মাটিতে শুয়ে পড়েছিল। প্রায় কুড়ি মিনিটের গুলি বিনিময়ের পর অবশিষ্ট তিনজন জঙ্গি মারা যায়। এই ঘটনায় বিমানের ক্যাপ্টেন সহ চার যাত্রী এবং নয় জন জিআইজিএন কম্যান্ডো আহত হয়েছিল। এয়ার ফ্রান্স ৮৯৬৯ এ এই সফল অপারেশনের পর জিআইজিএন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাউন্টার টেরিরিজম ইউনিট গুলোর মধ্যে একটি হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *