অফবিট

শয়তানের বাইবেল কাকে বলা হয়?

খ্রিষ্টান ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের ব্যাপারে সবাই জানে কিন্তু ডেভিলস বাইবেল বা শয়তানের বাইবেল সম্পর্কে খুব কম লোকই হয়ত জানে। শয়তানের বাইবেল নামটাই বড় অদ্ভুত কিন্তু এমন একটি বই সত্যিই আছে বলে মনে করা হয়। বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় এই বইটি শয়তান নিজে এক রাতের মধ্যে লিখেছিল। ৬৩০ পৃষ্ঠার এই বইটিকে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো বই গুলোর একটি বলা হয়। শয়তানের বাইবেল নামে এই বইটিকে কোডেক্স গিগাস বলা হয়, অত্যন্ত ভারী এই বইটির ওজন ৮৫ কিলোগ্রাম যা ওঠাতে দুজন লোকের প্রয়োজন। বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ও রহস্যময় বই বলা হয় ৯২ সেন্টিমিটার লম্বা কোডেক্স গিগাসকে। 

তেরো শতকে ১২০৪ থেকে ১২৩০ সালের মধ্যে কোনও এক সময়ে এই বইটি লেখা হয়েছিল। চেক প্রজাতন্ত্রের পোডলাজাইসে বেনেডিক্টাইন মঠে লেখা হয়েছিল এক রাতের মধ্যে। সেন্ট বেনেডিক্টের বানী অনুযায়ী এখানে ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মের অনুসরন হত। সেসময় চেক প্রজাতন্ত্র বোহেমিয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই মঠের এক সাধু মঠের নিয়ম ভেঙে কিছু অপরাধ করে যার কারনে বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। ভয়ানক মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছিল তাকে, জীবন্ত অবস্থায় দেওয়ালে গেঁথে দেবার আদেশ দেওয়া হয় ওই সাধুকে। তখন সেই ব্যক্তিটি বোহেমিয়ান রাজার কাছে অনুরোধ করে প্রান বাঁচানোর জন্য কিন্তু তার শাস্তি বহাল থাকে। বাঁচার শেষ অবলম্বন হিসাবে সেই ব্যক্তিটি রাজাকে জানায় তাকে এক রাতের জন্য দয়া করা হোক সে একটি বই লিখতে চায় যাতে রাজা সহ সাম্রাজ্যের মঙ্গল হবে। রাজা সেই ব্যক্তির কথায় সম্মত হয় এবং বলা হয় যদি সে এক রাতের মধ্যে এমন একটি অদ্ভুত বই লিখতে পারে তাহলে তার শাস্তি মুকুব করা হবে। এরপর ওই ব্যক্তিটি বই লিখতে শুরু করে, মধ্যরাতে সে বুঝতে পারে তার একার পক্ষে বই এক রাতে লেখা সম্ভব নয়, তখন সে একটি নিষিদ্ধ প্রার্থনা শুরু করে। এই প্রার্থনার মাধ্যমে সে নরকের রাজা বা শয়তান লুসিফারকে ডাকে এবং নিজের আত্মা লুসিফারকে উৎসর্গ করে। এর বিনিময়ে শয়তান সেই রাতেই বইটি লেখে। বলা হয় ৬৩০ পাতার তিন ফুট লম্বা এই বইটি লেখা হয়েছিল ১৩০ টি পশুর চামড়ার উপর। পরের দিন সকালেই সেই ব্যক্তি যখন ঘুম থেকে ওঠে সে দেখে তার সামনে ৬৩০ পাতার বিশাল একটি বই রাখা রয়েছে। মঠের অধ্যক্ষরা যখন বইটি দেখে তারাও অবাক হয়ে যায়। এই বইয়ে বোহেমিয়ান ক্যালেন্ডার, কালো জাদু, ভূত, পিশাচ সম্পর্কিত তথ্য ছাড়াও বইটির শেষে স্বর্গের নকশা রয়েছে। 

বইটিতে শয়তানের একটি বিশাল ছবি আছে যার হাতে ও পায়ে চারটি করে আঙুল রয়েছে এবং পরনে একটি রাজকীয় কাপড় রয়েছে যার অর্থ সে নরকের রাজা লুসিফার। বইটি ল্যাটিন ভাষায় লেখা হয়েছিল, এছাড়া জায়গায় জায়গায় গ্রীক, হিব্রু ও স্যালভিক ভাষার প্রয়োগ রয়েছে। এই বইটিতে শয়তানের পূজো করা ও শয়তানকে ভালো প্রমানের প্রচেষ্টা করা হয়েছে। যার কারনে এই বইকে দি ডেভিলস বাইবেল বা কোডেক্স গিগাস বলা হয়। কোডেক্স গিগাস একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ সবচেয়ে বড় বই। এই বইটি মধ্যযুগে লেখা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হস্তলিপি। বই লেখার পরের দিন সকালেই রহস্যময় ভাবে মৃত্যু হয়ে যায় ওই সাধুর। 

এই ঘটনা কতটা সত্য তা বলা সম্ভব নয় কারন এই বই কোথা থেকে, কবে এসেছে সে ব্যাপারে কোনও সুস্পষ্ট তথ্য নেই শুধু এই ঘটনাটুকুই জড়িত আছে এই বই সম্পর্কে। এই বইয়ের একদম প্রথম পাতায় হারমেন নামে এক ব্যাক্তির নাম আছে এবং তার নীচে ১০ নভেম্বর তারিখ লিখে বিশেষ কিছু শব্দ লেখা আছে যা অনুবাদ করলে এটা দাঁড়ায় যে ওই ব্যক্তি তার অপরাধের ক্ষমার জন্য এই বই শয়তানকে দিয়ে লিখিয়েছে। একারনে বলা হয় ওই সাধুটির নাম ছিল হারমেন।

প্রথমদিকে এই বই ওই মঠেই দীর্ঘকাল রাখা ছিল। এই বই যারাই পড়তে গেছে তাদের সাথেই অঘটন ঘটেছে। বেশ কিছু সন্ন্যাসী প্রথমদিকে এই বই পড়তে গিয়ে জানায় বইয়ের অক্ষর হাওয়ায় ভাসে। পরে এই বই স্যাডলিক মঠ নামে অন্য একটি মঠকে দিয়ে দেওয়া হয় কিন্ত কিছুদিনের মধ্যে সেই মঠে মহামারী শুরু হয়ে যায়। স্যাডলিক মঠে এই বই ৭০ বছর থাকার পর এই বই ১৪৭৭ সালে ব্রোউমোভ মঠের লাইব্রেরিতে রাখা হয়। ১৫৯৪ সালে কোডেক্স গিগাসকে রোমান সম্রাট রুডলফ দ্বিতীয় এই বই ওই মঠ থেকে ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য নিয়ে যায়। রুডলফ দ্বিতীয় কালো জাদুর উপর খুব বিশ্বাস করতো যার কারনে সে এই বইটি নিয়ে গিয়েছিল। এই বইয়ে শয়তানের একটি বড় ছবি আছে যার প্রতি এতটা আকর্ষিত হয়েছিল রুডলফ দ্বিতীয় যে সে এই বইটি প্রাগে নিয়ে গিয়েছিল তার সাথে। ১৬১৮ সাল পর্যন্ত প্রাগে এই বইটি তার কাছেই ছিল, রুডলফ দ্বিতীয়কে পরে রাজ্যপাঠ হারাতে হয়। ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ অবধি মধ্য ইউরোপে মানব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস যুদ্ধ ত্রিশ বছরের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ৪.৫ থেকে ৮ মিলিয়ন সাধারন মানুষ ও সেনার মৃত্যু হয়। 

১৬৪৯ সালে প্রাগ থেকে এই বই সুইডেনের সেনারা লুঠ করে স্টকহোমে নিয়ে আসে এবং সুইডেনের মহারানি ক্রিস্টিনাকে দেওয়া হয়৷ রানী তার ব্যক্তিগত সংগ্রহের তালিকায় এই বইটিকে রেখেছিল। কিন্তু মাত্র ছয় বছরের মধ্যে রানীকে তার রাজ্যপাঠ হারাতে হয়। ১৬৫৪ সালে মহারানী ক্রিস্টিনা তার রাজপাঠ ছেড়ে দিয়ে রোমে চলে যান। তিনি রোমে যাওয়ার সময় তাঁর সমস্ত ব্যক্তিগত জিনিস নিয়ে যান কিন্তু এই বইটি তিনি নিয়ে যান। এরপর কোডেক্স গিগাসকে স্টকহোমে ত্রি ক্রোনোর দুর্গে রাজকীয় লাইব্রেরিতে রেখে দেওয়া হয়। কিন্ত ১৬৯৭ সালের ৭ মে লাইব্রেরিতে আগুন লেগে যায় যার কারনে ২৪,৫০০ বই এবং ১,৪০০ হস্তলিপি পুড়ে নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু কোডেক্স গিগাস কোনও রকমে বেঁচে যায়। বলা হয় সেইসময় লাইব্রেরিতে থাকা কোনও ব্যক্তি বইটা বাঁচানোর জন্য জানলা দিয়ে ছুঁড়ে নীচে ফেলে দিয়েছিল। ১৮৭৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর  পর্যন্ত এই বইটি মহারানী ক্রিস্টিনার রাজ দুর্গের লাইব্রেরিতেই রাখা ছিল। 

১৮৭৮ সালের ১ জানুয়ারি সুইডেনের জাতীয় লাইব্রেরিতে রাখা হয়, তখন থেকে আজ অবধি বইটি সেখানেই রাখা আছে। এই বইয়ের ব্যাপারে অনেক রহস্যময় ঘটনা প্রচলিত আছে। ১৮৭৮ সালে সুইডেনের জাতীয় লাইব্রেরির একটি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছিল যাতে বলা হয় লাইব্রেরির এক কর্মচারী কোনও কারনে রাতে লাইব্রেরিতেই থাকতে বাধ্য হয়। সেদিন রাতে ওই ব্যক্তি দেখে যে বইটি যেখানে রাখা ছিল সেখানে না থেকে নীচে চলাফেরা করছে, ওই বইটির সাথে আরও কিছু বই চলাফেরা করছে। ওই ব্যক্তিটি বইটির আশেপাশে কিছু রহস্যময় জিনিসের উপস্থিতি লক্ষ্য করে। এসব দেখে ওই ব্যাক্তিটি দীর্ঘদিন মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আরও একটি ঘটনা শোনা যায় এই বইয়ের ব্যাপারে। স্টকহোমে জাতীয় লাইব্রেরিতে অগাস্ট নামে এক কর্মচারী একদিন রাতে তার এক বন্ধুকে নিয়ে লাইব্রেরিতে যায় ওই বইটি দেখাতে। তার যখন বইটি হাতে নিয়ে খোলে বইটির ভিতর থেকে অনেক চিৎকারের আওয়াজ পাওয়া যায়, এরকম অনেক ঘটনা রয়েছে কোডেক্স গিগাসকে ঘিরে। সুইডেনের স্টকহোমে জাতীয় লাইব্রেরিতে এই বই রাখা হয়েছে যা সাধারন মানুষ গিয়ে দেখতে পারে। বইটির পাশেই ডিজিট্যাল সিস্টেম বইটির কপিও রাখা হয়েছে যেটা যে কেউ গিয়ে পড়তে পারে। বইটির ৫৭৭ তম পাতায় শয়তানের বড় একটি ছবি রয়েছে। এই বইটির সামনের পাতায় পোডলাজাইসের বেনেডিক্টাইন মঠের কথা উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিকগন বলেন তেরো শতকে এই মঠ ততটা সমৃদ্ধ ছিলনা যে এত বিশাল বই লিখতে পারে, তাহলে কি করে এই বই সেসময় ওই মঠে লেখা হল! সেকারনেই বিশ্বাস করা হয় শয়তান নিজে এক রাতের মধ্যে এই বই লিখেছে। এই বইয়ের ভিতর বোহেমিয়ান সাম্রাজ্যের কিছু সাধুর ব্যাপারে লেখা রয়েছে যার কারনে বলা হয় আজ থেকে প্রায় আটশো বছর আগে বোহেমিয়ান সাম্রাজ্যেই এই বই লেখা হয়েছে। বইটি যাতে নষ্ট না হয়ে যায় সেকারনে সুইডেনের জাতীয় লাইব্রেরিতে ক্লাইমেট কন্ট্রোল কেসের মধ্যে রাখা হয়েছে। 

বইটিতে ৬৩০ টি পাতা থাকলেও বিগত কয়েক বছরে বইটিতে ৬২০ টি পাতা দেখা যায়, বাকী দশটি পাতা কিহল, কি করে উধাও হল? এটাও একটা রহস্য। এই বই সম্পর্কে পুরো অনুসন্ধান করে দেখা গেছে এই বইয়ের প্রত্যেক লাইনে প্রতিটি অক্ষরের মাপ সমান, হাতে লিখে সব অক্ষরে একই নিখুঁত মাপ অসম্ভব! তাছাড়া পরীক্ষা করে দেখা গেছে এই বই এতটা লম্বা, বড় এবং এতে এত ছোট ছোট শিল্পকার্য রয়েছে যে এটা লিখতে শুরু করতে শেষ করতে অন্তত ২৫ -৩০ বছর লাগবে, এক রাতে এই বই কোনও মানুষের পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। কোডেক্স গিগাসকে বিশ্বের সবচেয়ে অভিশপ্ত বই বলা হয়। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *