পৃথিবীর রাজনৈতিক সংকট না মেটালে আরও একটি বিশ্বযুদ্ধ যেকোনো মুহূর্তে বাঁধতে পারে
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারন হিসাবে বলা হয় অস্ট্রিয়ার ডিউক ফ্রান্সিস ফার্ডিনান্ডকে সার্বিয়ার জাতীয়তাবাদী দ্বারা হত্যা। সেসময় সার্বিয়াকে রাশিয়া সমর্থন করতো এবং অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি বড় সাম্রাজ্য ছিল। তবে বলা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আরও একটি বড় কারন ছিল শক্তির সমতা রক্ষা। কোন একটি দেশ যদি শক্তিশালী হয়ে ওঠে তাহলে আশেপাশের দেশ গুলো নিজেদের মধ্যে জোট গঠন করে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করে। বিংশ শতকের শুরু থেকেই ইউরোপের দেশ গুলোর মধ্যে জাতীয়তাবাদ জাগ্রত হতে শুরু করে সাথে বিভিন্ন দেশের মধ্যে স্ট্রাটেজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠা শুরু হয়। বসনিয়াতে অস্ট্রিয়ার ডিউকের হত্যার পর অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। অস্ট্রিয়াকে সমর্থন করতো জার্মানি, অটোম্যান সাম্রাজ্য, এদিকে সার্বিয়াকে সমর্থন করতো রাশিয়া। রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্ত হয় কারন রাশিয়ার ভূমধ্যসাগরে প্রবেশাধিকার দরকার ছিল, ভূমধ্যসাগরে সেসময় অটোমানদের প্রভুত্ব ছিল ফলে রাশিয়া এই সুযোগ কাজে লাগায়। আবার ফ্রান্স জার্মানির থেকে তাদের দখল হয়ে যাওয়া এলাকা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্ত হয়, এভাবে গোটা ইউরোপ একটি ভয়ানক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনাকালীন সময়ের মতোন বর্তমানেও বিশ্বরাজনীতিতে একাধিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যেমন চীনকে সরিয়ে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বানিজ্যিক সঙ্গী হয়ে উঠেছে মেক্সিকো। প্রাক্তন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে যে বানিজ্যযুদ্ধ চলছিলো অবশেষে ফল দেখা যাচ্ছে। চীনের প্রতি নির্ভরতা কমার অর্থ যদি ভবিষ্যতে চীন ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধ হয় তাহলে বানিজ্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতি কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি কিম জং উন রাশিয়া সফরে যায় এবং সেখানে কিম জং উন সরাসরি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন করেছে, আবার রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন উত্তর কোরিয়ার সাথে সম্ভাব্য সামরিক সহযোগিতার কথা জানিয়েছে। উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়া দুটি দেশের সাথেই চীনের সুসম্পর্ক রয়েছে সুতরাং চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে একটি জোট তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন সমীক্ষা জানাচ্ছে বিশ্বের বহু দেশের যেমন ভারত, ব্রাজিল, জিম্বাবুয়ে, চীন, রাশিয়ার আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে জিঙ্গোইজম চলছে। জিঙ্গোইজম শব্দের অর্থ তীব্র জাতীয়তাবাদ যার মধ্যে সামরিক সক্ষমতা ও বিদেশনীতিও যুক্ত আছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এমন অনেক দেশ আছে যারা বাধ্য হয়ে এই মহা বিনাশকারী যুদ্ধে অংশ নেয় কারন তারা ইউরোপীয়ান শক্তিগুলোর উপনিবেশ ছিল। এখনও বিশ্বে বেশ কিছু দেশের নির্দিষ্ট অঞ্চলে কিছু মার্সেনারি দল রয়েছে যারা অর্থের বিনিময়ে শক্তিশালী দেশ গুলোর হয়ে কাজ করে যেমন ওয়াগনার গ্রুপ যারা রাশিয়া ও আমেরিকা উভয়ের হয়েই কাজ করে। ওয়াগনার গ্রুপ আফ্রিকাতে আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএর হয়েও কাজ করে। সুইডেন ও ফিনল্যান্ড দুটি দেশ আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ ছিল কিন্তু ইদানিং এই দুটি দেশ ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার চেষ্টা করছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ও জার্মানির ধারনা ছিল তাদের শক্তিশালী সেনাবাহিনী, যুদ্ধজাহাজ রয়েছে, ব্রিটেনের ধারনা ছিল তাদের নৌবাহিনী সবচেয়ে শক্তশালী, রাশিয়ার জার নিকোলাস দ্বিতীয়র ধারনা ছিল তার ১৫ লাখ সদস্য বিশিষ্ট বিশাল সেনাবাহিনী রয়েছে এবং তার দেশ স্বয়ং ঈশ্বর রক্ষা করছে, অর্থাৎ ইউরোপ জুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ বিরাজ করছিল। ঠিক তেমনই বর্তমান দিনেও বিশ্ব দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। যেমন এই মহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে অস্থিতিশীল অঞ্চল হচ্ছে মধ্য প্রাচ্য, এখানে ইরান বনাম আরব দেশ এবং ইসরায়েল বনাম প্যালেস্তাইন বিবাদ বহু বছর ধরেই চলছে। ইরানকে সমর্থন করে ইয়ামেন এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ সংগঠন, অন্যদিকে সৌদিআরব সহ বাকী আরব দেশগুলো একটি জোটে রয়েছে, এই জোটকে আবার সহায়তা করছে আমেরিকা, ব্রিটেন সহ ইউরোপীয়ান দেশগুলো।
সম্প্রতি ইরান সমর্থন পাচ্ছে রাশিয়া ও চীন থেকে। ইরান, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার মধ্যে একটি মিল হচ্ছে এই সব কটি দেশই আমেরিকা সহ পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে সুতরাং খুব স্বাভাবিক ভাবেই ইরান, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া একটি জোট তৈরি হচ্ছে। ইসরায়েল প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বে ইসরায়েলকে সমর্থন করে পশ্চিমা দেশ গুলো, অন্যদিকে প্যালেস্টাইনকে সমর্থন করে আরব দেশ গুলো। তবে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন সৌদিআরবের সাথে আলোচনা করছে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে। যদি সৌদি আরব ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে দেয় তাহলে বহু আরব দেশই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু যদি এটা হয় তাহলে প্যালেস্টাইনের গাজাতে থাকা হামাস সরাসরি ইরানের পক্ষে ঝুঁকে পড়বে। আর্মেনিয়া ও আজাবাইজানের মধ্যে নার্গোনা কারবাক অঞ্চল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ, বিবাদ রয়েছে। এখানে আর্মেনিয়াকে সহায়তা করছে রাশিয়া। এবার যদি দক্ষিন এশিয়ার দিকে দেখা হয় তাহলে এখানে সমস্যা রয়েছে, ভারত পাকিস্তান, ভারত চীন সমস্যা দীর্ঘকাল ধরে রয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিন এশিয়ায় সবচেয়ে বেশী সমস্যা তৈরি করছে চীনই। চীন তিব্বত, তুর্কিমেনিস্থান, মঙ্গোলিয়া, মান্চুরিয়ার অংশ দখল করে নিজেদের এলাকা বাড়িয়েছে, চীনের এই এলাকা বৃদ্ধি এখনও চলছেই। চীন ভারতের আকসাই চীন দখল করেছে, অরুনাচল প্রদেশ, লাদাখ, সিকিমেও চীনের সাথে ভারতের বিবাদ রয়েছে। চীন ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে ব্যবহার করছে।
অন্যদিকে দক্ষিন চীন সাগরে আধিপত্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স, জাপান সহ একাধিক দেশের সাথে চীনের বিরোধ রয়েছে। চীন তাইওয়ানকেও তাদের অংশ বলে দাবি করে। যার কারনে আমেরিকা দক্ষিন কোরিয়া, তাইওয়ান, জাপান, ভারতকে সহায়তা করছে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে চীন বিরোধী কোয়াড জোট গড়ে উঠেছে। আবার আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিপিন্সের মধ্যে নতুন কোয়াড জোট তৈরি হয়েছে। চীন সবসময় তার আশেপাশের প্রতিবেশী দেশ গুলোর সাথে সমস্যা তৈরি করে এবং নিজের এলাকা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে কারন চীনের কমিউনিস্ট সরকার তাদের ক্ষমতা বজায় রাখতে তীব্র জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ইউরোপ থেকেই যার কারনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করা হয় যার উদ্দেশ্য ইউরোপীয় দেশ গুলোর মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা। কিন্তু ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছে।
ফিনল্যান্ড, সুইডেন, ইটালি, ব্রিটেনে দক্ষিনপন্থী দল ক্ষমতায় আসায় পুনরায় জাতীয়তাবাদ জাগ্রত হচ্ছে। যার কারনে ইউরোপও ভবিষ্যতে অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। ইতিমধ্যেই একবছরের বেশী সময় ধরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ চলছে যাকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট বলা হচ্ছে। আমেরিকা সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে চাইনিজ সংস্থা গুলোকে যার কারনে চীনের ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সুতরাং বিশ্বজুড়ে দিকে দিকে সাংঘাত ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এরকম মহাবিনাশক যুদ্ধ যাতে ভবিষ্যতে না হয় তার জন্য জাতিসংঘ গঠন করা হয়েছিল কিন্তু বর্তমানে বিশ্বে যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হছে তা স্পষ্ট প্রমান করে জাতিসংঘের প্রভাব কমে আসছে। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে বর্তমানে বিশ্বে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতোনই অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হচ্ছে, যদি এখনই কুটনৈতিক স্তরে আলোচনার মাধ্যমে এটা সমাধান করা না যায় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আরও একটি বিশ্বযুদ্ধ হতেই পারে।