অফবিট

প্রাচীন রোমে ক্রীতদাসেরা মালিকদের কাছে নিজের পুরো জীবনটাই লিখে দিত। কতোটা অত্যাচার হত মেয়েদের সাথে?

পৃথিবীতে আদিম পর্ব পার হতেই যখন মানুষ একটু সভ্যতার আয়ত্তে আসে তখন থেকেই রাজত্ব এবং ক্রীতদাসীদের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। কারণ যে শ্রেণী বেশি শক্তিশালী এবং সকলকে পরিচালনা করতে পারত তারা হত রাজা এবং বাদবাকি অবশিষ্ট জনগণ হত কিছু জন প্রজা এবং কিছু ব্যক্তি ক্রীতদাস।

৩৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে প্রচলিত এই ক্রীতদাস প্রথা মধ্যযুগ পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল ইউরোপে। কিন্তু ১৯ শতাব্দীতে এই দাস প্রথার সম্পূর্ণরূপে অবলুপ্তি ঘটেছিল। তবে প্রাচীন রোমে সম্পূর্ণরূপে ক্রীতদাস প্রথার প্রচলন ছিল মধ্যযুগে। অন্যান্য দেশে ক্রীতদাস প্রথা একটি নিয়মের মধ্যে বদ্ধ থাকলেও রোমে বেনিয়ম ছিল এটি। যার কারণে ইতিহাসে খচিত রয়েছে যে রোমে ক্রীতদাসরা ধনী ব্যক্তিদের কাছে বেশি শোষিত হয়েছিল। কারণ রোমান যুগে দাসপ্রথা ছিল একটি জটিল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা।

প্রাচীন রোমের ইতিহাস অনুযায়ী সেখানকার ক্রীতদাসদের নিজস্ব কোন স্বাধীনতা ছিল না। ধনী ব্যক্তিরা কিংবা তাদের মালিকেরা তাদের যেমনভাবে পরিচালনা করতো তেমনভাবেই জীবনযাপন হতো ক্রীতদাসদের। প্রাচীন রোমের সকল মানুষদের মধ্যেই ৫০ ভাগ ছিল ক্রীতদাস। কিছু ক্রীতদাস ছিল মুক্ত ও স্বাধীন তাদের পয়সা দিয়ে কাজ করিয়ে নিতো ধনী ব্যক্তিরা এবং কিছু ক্রীতদাস ছিল পরাধীন, এ সকল ক্রীতদাসেরা সর্বক্ষণ মালিকদের বাড়ির কাজকর্ম,ব্যবসা, ক্ষেতে চাষ করত। রোমানের নানান  ঐতিহাসিক নিদর্শন তৈরির পেছনেও বিরাট অবদান রয়েছে ক্রীতদাসদের। অর্থাৎ এক কথায় বলা যেতেই পারে পরাধীন ক্রীতদাসেরা মালিকদের কাছে নিজের পুরো জীবনটাই লিখে দিত।

সে ক্ষেত্রে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে যে রোমানে এত ক্রীতদাস তৈরি হলো কি করে! এই প্রশ্নের উত্তর খুবই সোজা। রোমানের এত সংখ্যক ক্রীতদাস ওখানকার কি বাসিন্দা? মোটেও নয়। মূলত যুদ্ধে পরাজিত দেশের সৈন্যদের বন্দি করে আনত রোমান সৈন্যরা। এমনকি জলদস্যুরাও বহু মানুষকে বন্দী করে নিয়ে আসতো রোমানে। এই সকল বন্দী ব্যক্তিদের মধ্যে কিছু সংখ্যক  মানুষ দাসে পরিণত হত তো কিছু সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হত। এছাড়াও একদা রোমানে দাস কেনাবেচার বাজার ছিল। ঈজিয়ান সাগরের মধ্যে দেলোস দ্বীপে ছিল সেই বাজার, যেখানে প্রত্যহ ১০ হাজার নারী পুরুষকে কেনাবেচা করা হত দাস হিসেবে। তবে তখন যে শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ বিক্রি করা হতো তাই না বহু ব্যক্তিরা তাদের সন্তানদেরও বিক্রি করে দিতেন। রোমান আইনে কঠোর ব্যবস্থা না থাকলেও এবং ক্রীতদাসেদের উপর সীমাহীন শোষণ  করা বেআইনি না হলেও নিজেকে একজন দাস হিসেবে বিক্রি করা ছিল বেআইনি।

যুদ্ধে পরাজিত ও জলদস্যুর হাতে আক্রান্ত সকল দাসদের দুটো ভাগে ভাগ করা হতো রোমে। প্রথমটি ছিল শহুরে ক্রীতদাস ও দ্বিতীয়টি গ্রামীণ ক্রীতদাস। যারা গ্রামে বসবাস করত সেই ক্রীতদাসদের কাজ ছিল খুবই কঠিন। কারণ, গ্রামে অভিজাত ব্যক্তিরা অধিকাংশই ক্রীতদাসদের জমি কিনে নিতে এবং ওই জমিতেই তাদের দিয়ে লাঙ্গল চালানো ,ফসল তোলা, জাঁতাকলে শস্য ভাঙা, মাড়াইকলে আঙুর আর জলপাই নিঙড়ানো, পশু চরানো ইত্যাদি কঠিন কঠিন কাজ করানো হতো। কৃষিকাজ ছাড়াও তারা বাড়িঘরের কাজকর্ম যেমন পরিষ্কার করা রান্নাবান্না করা এমন সব কাজে যুক্ত থাকত।

অন্যদিকে, শহরে যেহেতু চাষের কোন ব্যবস্থা নেই তাই শহুরে ক্রীতদাসদের কাজ ছিল কারখানায় কাজ করা কিংবা মালিকের ব্যবসার হিসাব পত্র রাখা ও দোকানপাট সামলানো। কারণ প্রচুর দাস এমন ছিলো যারা ল্যাটিন ও রোমান লিখতে ও পড়তে জানতো। কিন্তু প্রাচীন রোমে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ জন কৃষক কাজ করত রৌপ্য খনিতে। এছাড়াও বাণিজ্যের কাজে ব্যবহৃত বড় বড় জাহাজের মোটা দড়ি টানতে প্রয়োজন হত প্রায় ৫ থেকে ৬ জন লোক। তাই বড় বড় জাহাজগুলির ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যে ১৫০ থেকে ২০০ জন কৃতদাস দাড় টানতো। একদিকে যেমন কারখানায় কাজে প্রয়োজন হতো ঠিক সেরকমই নানান স্থাপত্য ও বাড়ি তৈরি করতে এমনকি প্রহরী ও স্মিথ হিসাবেও কাজ করতো দাসেরা।

যেহেতু প্রাচীন রোমে গ্রাম হোক কিংবা শহর দাসেদের উপর নির্মম অত্যাচার করা হতো তাই আগামী দিনে ক্রীতদাসরা যাতে বিদ্রোহ ঘোষণা না করে তার ব্যবস্থাও করে রাখা হয়েছিল। তখনকার সময় প্রত্যেকটি বাড়ির দেয়ালের গায়ে লেখা থাকত কোন দাস মালিকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে কিংবা মালিককে হত্যা করলে অথবা কোন রূপ পালানোর চেষ্টা করলে তার শাস্তি হবে বেত্রাঘাত। এমনকি যে সমস্ত দাসেরা মালিকদের নির্মম অত্যাচারের বেড়াজাল ভেঙে দিয়ে পালিয়ে যেত তাদের খুঁজে আনার জন্য থাকতো নির্দিষ্ট লোক এবং যারা পলাতক দাসদের খুঁজে দিত তাদের জন্য ধার্য ছিল অর্থ। এমনকি পালিয়ে অন্য কারোর বাড়িতে দাসেদের আশ্রয় নেওয়া ছিল প্রাচীন রোমানে বেআইনি। 

যদি কখনো প্রাচীন রোমে একজন দাস পালানর চেষ্টা করত এবং পরবর্তীতে তাদের ধরে নেওয়া হতো, তখন সেই সকল দাসদের কপালে লেখা থাকতো অশেষ শাস্তি। বেত্রাঘাত করার পাশাপাশি তাদের উপর চলতো অমানবিক নির্যাতন। এমনকি অনেককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা ক্রুষবিদ্ধ করে শাস্তি দেওয়া হত। এর কারণ ছিল একটাই যাতে এমন কঠোর শাস্তি দেখে অন্যান্য দাস পালানোর সাহস না পায়। 

ক্রীতদাসদের উপর শুধুমাত্র শারীরিক নির্যাতন নয় তাদের খাদ্য গ্রহণেও ছিল বেশ বাধ্যবাধকতা। যেহেতু কৃতদাসেদের অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হতো তাই তাদের অধিক পরিমাণে প্রয়োজন ছিল রুটি এবং পানীয় জলের। কিন্তু তাদের খেতে দেওয়া হতো সামান্য খাবার। রোমের ক্রীতদাসীদের খাবার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখেছিলেন একজন লেখক ক্যাটো। লেখকের মতে গরমের দিনে খামারে কাজ করা ছিল খুবই পরিশ্রমের। খ্রীস্টপূর্ব ২ য় ও ৩য় শতাব্দী নাগাদ রোমে বন্দী ক্রীতদাসদের খেতে দেওয়া হত ওয়াইন এবং রুটি ছাড়াও জলপাই দিয়ে তৈরি একধরনের খাবার।

আবার অন্য একজন লেখকের মতে ক্রীতদাসদের খাবার ছিল ফল শাকসবজি কিংবা, মালিকেরা খাদ্য গ্রহণের পর অবশিষ্ট যতটুকু খাবার বেঁচে যেত তাই দিত ক্রীতদাসদের। অর্থাৎ একটা কথাই বলা যায় যে দৈনিক পরিশ্রম অনুযায়ী কৃতদাসের খাবার পর্যাপ্ত ছিল না।

প্রাচীন রোমানের দাসত্ব আইন অনুযায়ী ক্রীতদাসের সংখ্যা বাড়ানো হতো বংশপরম্পরা হিসাবে। অর্থাৎ আইন অনুযায়ী বলা ছিল যে, কোন পরিবারে বাবা এবং মা ক্রীতদাস  থাকাকালীন যদি তাদের সন্তান হয় তাহলে সেও তার গোটা জীবন ক্রীতদাস হিসাবে কাটাবে। কিন্তু বাবা এবং মা ক্রীতদাস হওয়ার আগে যদি তাদের কোন সন্তান হয়ে থাকে তাহলে সেই সন্তানেরা আগামী দিনে ক্রীতদাস হবে না। তবে ৩১ থেকে ১৪ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ অর্থাৎ সম্রাট অগাস্টাসের শাসনামলে ক্রীতদাসীদের প্রজননের মাধ্যমে ক্রীতদাসের সংখ্যা বাড়াতে দেখা গিয়েছিল।  

দাসদের নির্দিষ্ট কোনো ভালো বাড়ি ছিল না। যে সকল দাসেরা ঘরের কাজকর্ম করতে তারা মালিকের কক্ষের আশেপাশে কোন একটি ছোট জায়গায় বসবাস করত। কারণ রাতে মালিকের কোন প্রয়োজন পড়ে কিনা তাই তাদের হাতের কাছেই থাকতো দাসেরা। যারা মালিকের বাড়িতে জায়গা পেত না তারা এক ধরনের চেম্বারে বসবাস করত গোটা পরিবার নিয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *