কীভাবে মালাক্কা প্রনালী ও মালয় পেনিনসুলায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল ভারতবর্ষ?
রাজেশ রায়:- প্রাচীনকাল থেকেই ভারত এশিয়াতে বানিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল যার সবচেয়ে বড় উদাহারন রেশম পথ বা সিল্ক রুট। এর সবচেয়ে বড় কারন ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থান। ভৌগলিক ভাবে ভারতের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ভারত পশ্চিম এশিয়ার সাথে পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিন পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্ত করে। এর থেকেও বড় গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভারতে কম দামে প্রচুর রকমের জিনিস পাওয়া যেত যেমন কৃষিজাত দ্রব্য চাল, চিনি, তেল এবং কাঁচামাল হিসাবে তুলো এছাড়াও অন্যান্য জিনিস। মধ্যযুগে বানিজ্য মূলত স্থলপথে নিজের দেশের সীমার মধ্যেই হত কিন্তু ধীরে ধীরে বানিজ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সমুদ্র পথের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ভারতের তিনদিকে বিশাল সমুদ্র সীমা রয়েছে যা বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর ও আরব সাগর হয়ে বিস্তৃত এবং এখান দিয়ে গোটা বিশ্বে বানিজ্য হত। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ ছিল ভারত ও দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বানিজ্য। সাধারনত ভারতীয় বনিকরাই এসব দেশে যেত বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়ে। অনেক সময় রাজপরিবারের বিভিন্ন সদস্যও সাধারন বনিকদের সাথে বানিজ্যে যেত। দশম শতকের পর ভারত ও দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বানিজ্য বৃদ্ধি পায়। ভারত থেকে অনেক বনিক গিয়ে এইসব দেশ গুলোতে বসবাস শুরু করে এবং এসব বনিকরা মিলে নিজেদের মধ্যে সংগঠন তৈরি করে যাকে গিল্ডস বলা হত। এইসব গিল্ডের মাধ্যমেই ভারতীয় সংস্কৃতি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বেশীরভাগ বনিক গোষ্ঠী বা গিল্ডস দক্ষিন ভারতে ছিল কারন এখানকার সমুদ্র পথ দিয়েই বেশীরভাগ বানিজ্য হত। দক্ষিন ভারতের এইসব ট্রেড গিল্ডস সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সাথে এটাও বলা হবে এইসব গিল্ড কীভাবে মালাক্কা প্রনালী ও মালয় পেনিনসুলায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল।
প্রথমেই জানা দরকার ট্রেড গিল্ডস কী? আগেই বলেছি গিল্ডস হচ্ছে বনিকদের সংগঠন। মধ্য যুগে দক্ষিন ভারতের তামিল সংস্কৃতিতে এই গিল্ডসে নির্বাচন মূলত জাতি ও পেশার ভিত্তিতে হত অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট গিল্ডসে একই রকমের কাজ করা বনিকরাই থাকত। এর ফলে একই পেশার মানুষের মধ্যে ঐক্য বাড়ত। যেকোনও সাম্রাজ্যের মূল স্তম্ভ হচ্ছে তার রাজা এবং প্রজা। এসব গিল্ডস রাজা ও প্রজার মধ্যে সেতু হিসাবে কাজ করত। বানিজ্যের পাশাপাশি গিল্ডসরা জনসাধারনের জন্য ঘর, মন্দির, জলের ট্যাংক নির্মানের মতন জনসেবা মূলক কাজও করত। অর্থাৎ বানিজ্য ছাড়াও এসব বনিক গোষ্ঠী সানাজিক, ধার্মিক, প্রশাসনিক এমনকী বিচার ব্যবস্থাতেও যুক্ত থাকত। এবার দেখা যাক এসব তামিল গিল্ডসের উদ্ভব কীভাবে হল? তামিল গিল্ডস বলার অর্থ সেসময় ভারতবর্ষে গিল্ডস মূলত দক্ষিন ভারতেই পাওয়া যেত। এগারো শতকে দক্ষিন ভারতে চোল সাম্রাজ্যের রাজত্ব ছিল। ইন্দোনেশিয়ার জাভা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায় ভারতে চোলদের আগে কলিঙ্গরা ছিল। এই কলিঙ্গরা মূলত ওড়িশা এবং উত্তর পূর্ব অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দা ছিল।
ভারতের পূর্ব উপকূল থেকে বিদেশী রূপে এসে এখানে বসবাস শুরু করে কলিঙ্গরা। জাভা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ১০২১ সালে ভারতে প্রথম দ্রাবিড় বা তামিল গিল্ডসদের কথা জানা যায়। সেসময় ভারতে তামিলদের শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল। ১০২৫ সালে চোল রাজা রাজেন্দ্র ১ ইন্দোনেশিয়ার শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের উপর নৌ আক্রমন শুরু করে। ভারতের ইতিহাসে এই আক্রমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারন এর আগে ভারত ও দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এর প্রভাব পড়ে বানিজ্যে কারন তামিল গিল্ডস দের প্রভাব বাড়তে শুরু করে এবং ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে তামিল গিল্ডসরা স্থানীয় বনিকদের থেকে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এর একটা সুবিধা চোলদেরও হয়। তামিল গিল্ডসদের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় চোল ও শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এই সময় বেশ কীছু গুরুত্বপূর্ণ গিল্ডস ছিল যেমন আঞ্জুভান্নাম, আয়াভোল-৫০০, মানিগ্রামাম, বিরুদাস, সেতিস, নানাদেসিস, নাকারা, গাত্রিগাস, মুমুরিদানদাস ইত্যাদি। এর মধ্যে কীছু গিল্ড সম্পর্কে একটু বলা যাক।
প্রথমেই আসে আয়াহোল -৫০০, এটি আইহোল নির্ভর একটি সংগঠন ছিল যা আজকে কর্নাটকে অবস্থিত। এই গিল্ড কর্নাটক, তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশের গিল্ডসদের মধ্যে সংযোগকারী হিসাবে ছিল। এই গিল্ডসে ৫০০ জন বনিক ছিল। এরপর আা আঞ্জুভান্নাম গিল্ড। এই গিল্ডসে মুসলিম, খ্রীষ্টান এবং ইহুদী ব্যবসায়ীরা ছিল। এরা মালাবার, করোমন্ডল উপকূল এবং জাভার মধ্যে বানিজ্য করত। মানিগ্রামাম গিল্ড শুরু হয় তামিলনাড়ুতে পল্লব এবং চোলদের সময়ে, এরাও দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার সাথে বানিজ্য করত। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ গিল্ডস হচ্ছে নাকারা গিল্ড যাতে নাকেরেশ্বর ভগবানের ভক্তদের সংগঠন ছিল। সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ গিল্ড হচ্ছে মুমুরিদানদাস গিল্ড এরা সশস্ত্র যোদ্ধা ছিল। সমস্ত বনিক সম্প্রদায় এদের নিরাপত্তার জন্য রাখত। এরা প্রথমে যোদ্ধা তারপর বনিক ছিল। আয়াভোল-৫০০ থেকে আলাদা হয়ে একটি সংগঠন এই গিল্ড তৈরি করে। এবার জানা যাক এসব তামিল গিল্ডস কীভাবে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় বিশেষ করে মালাক্কা প্রনালীতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছিল?
আগেই বলেছি দশম শতক থেকে ভারত ও দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বানিজ্য বৃদ্ধি পায় বিশেষ একে এগারো শতকে চোলদের ইন্দোনেশিয়া আক্রমনের পর থেকে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় তামিল গিল্ডসরা এতটাই প্রভাবশালী হয়ে গেছিল যে সেখানে শহর তৈরি শুরু করে তারা। এমনকী নগর পরিকল্পনা, কৃষিকাজ সহ স্থানীয় শাসকদের বিদেশ নীতিতেও তামিল গিল্ডসদের প্রভাব উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পায়। এর সবচেয়ে বড় উদাহারন শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের রাজা সঙ্গরামা বিজয়াতুঙ্গবর্মন। তুঙ্গবর্মন ভারতের থেকে চীনের সাথে বানিজ্য করা বেশী লাভজনক বলে মনে করত কিন্তু এতে তামিল গিল্ডসদের ব্যাবসায় ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা তৈরি হয়। তুঙ্গবর্মন কোনওদিন কল্পনাও করেনি তামিল গিল্ডসদের জন্য তার এত বড় সমস্যা হবে। তামিল গিল্ডসদের কথায় প্রভাবিত হয়ে চোলরা বারংবার শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যে আক্রমন করে যাতে এই সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং চীনের সাথে তাদের বানিজ্যের সম্ভবনা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এই অঞ্চল জুড়ে তামিল গিল্ডসদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ধীরে ধীরে বিভিন্ন গিল্ড একত্রিত হয়ে একটি শক্তিশালী বানিজ্যিক সংস্থা তৈরি হয় যারা বিভিন্ন দেশে বানিজ্য করতে শুরু করে। যেমন আঞ্জুভান্নাম ও মানিগ্রামাম নামে যে দুটো গিল্ডের কথা আগে বলেছিলান এরা সংযুক্ত হয়ে আয়ভোল -৫০০ গিল্ড তৈরি হয় যাকে তামিল ভাষায় আয়নুরুভার বলা হত। এই গিল্ডের লোকেরা মা দুর্গার ভক্ত ছিল। তবে এই গিল্ডে ইসলাম ও খ্রীষ্টান ধর্মের লোকেরাও ছিল।
ঐতিহাসিকদের মতে এই আয়ভোল-৫০০ এর কথায় প্রভাবিত হয়ে ইন্দোনেশিয়ার শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যে আক্রমন করে। বলা হয় এই গিল্ড কোনওদিন স্থানীয় প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করেনি বা সরকার গঠন করে নি। এখানেই ইউরোপীয়ানদের সাথে ভারতের বনিকদের তফাৎ। ইউরোপীয়ানরা যেমন বনিক সেজে ঢুকে একের পর এক দেশ দখল করত ভারতীয়রা তা করে নি, তারা স্থানীয় প্রশাসনের কথা মতই কাজ করত। এই গিল্ড গুলো মন্দিরের রক্ষকও ছিল। এই গিল্ড গুলো স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্যে রাস্তা, হোটেল তৈরি করে যাতে বানিজ্যে আরও সুবিধা হয়। এছাড়া স্থলপথে ও সমুদ্রপথে বানিজ্যের জন্য এসব গিল্ডগুলো নিজেদের ব্যাক্তিগত সেনাবাহিনী তৈরি করে, যু্দ্ধের জন্য বিশেষ ঘর তৈরি করে। এইভাবে দীর্ঘদিন ধরে মালাক্কা প্রনালীতে রাজত্ব করে তামিল গিল্ডসরা৷ এরা হয়ত রাজা ছিল না কিন্তু এদের প্রভাব কোনও রাজার থেকে কম ছিলনা।
আজকের যুগে ব্যাবসায়ীরা যেমন জিও পলিটিক্সের মাধ্যমে নিজের ব্যাবসা বাড়ায় তখনও দক্ষিন ভারতের ছোট ছোট বনিক সংগঠন গুলো নিজেদের চেষ্টায় বিভিন্ন দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বানিজ্য করে, এতে স্থানীয় প্রশাসনেরও লাভ হয়। এভাবে তেরো শতক অবধি তামিল গিল্ডসরা কোন বিপক্ষ ছাড়াই দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় রাজত্ব করেছিল। এরপর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে ইউরোপীয়ান বনিকদের আগ্রাসনের কারনে তামিল গিল্ডসদের প্রভাব কমতে থাকে এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসায় সমস্ত গিল্ডসদের অস্তিত্ব পুরো নষ্ট হয়ে যায়। তবে ভারতীয় এই বনিক সংগঠন ইউরোপীয়ানদের থেকে ভাল ছিল কারন তারা কোনও দেশ দখল করে উপনিবেশ করত না। ইউরোপীয়ান বারবার ভারতীয়দের সভ্যতাকে গুরুত্ব দেয়নি ততটা তবে সেসময় ভারতীয় বনিকরা বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ বানিজ্য নিয়ন্ত্রন করত।