উত্তরপ্রদেশের এই প্রকল্প কাজে লাগিয়ে ১ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি তৈরি করতে চলেছে
সুপ্রাচীন কাল থেকেই মানব সভ্যতার সাথে নদীর গভীর সংযোগ রয়েছে। অতীতকাল থেকে নদীকে কেন্দ্র করেই সমস্ত সভ্যতা বিকশিত হয়েছে যেমন নীল নদের তীরে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা, ইয়েলো নদীর তীরে চীন সভ্যতা এবং সিন্ধু নদীর তীরে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। হরপ্পা সভ্যতার সময়ে মানুষজন জলপথে বানিজ্যও করতো এর জন্য হরপ্পা সভ্যতায় ভোগোভা নদীর তীরে লোথাল বন্দরও তৈরি হয়েছিল। এই বন্দর থেকে অন্যদেশে বানিজ্য করতো হরপ্পা সভ্যতার মানুষজন। মগধ সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে মুঘল সাম্রাজ্য পর্যন্ত সড়কপথের পাশাপাশি জলপথ বিশেষ করে দেশের আভ্যন্তরীন নদীপথ বানিজ্যের গুরুত্বপূর্ন মাধ্যম ছিল। কিন্ত বিগত কয়েক দশকে ভারতে আধুনিক সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা ও রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি হওয়ায় নদীপথে বানিজ্য ক্রমশ কমে এসেছে। ভারতে নদীপথে বানিজ্যের পরিমান ০.১ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে আমেরিকাতে এখনও নদীপথে বানিজ্যের পরিমান ২১ শতাংশ। তবে ভারতের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিগত কয়েকবছর ধরে ভারত সরকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জলপথের উন্নয়নের কাজ শুরু করে দিয়েছে। নদীপথে পন্য পরিবহনে সড়ক ও রেলপথে পন্য পরিবহনের তুলনায় কম খরচ হয়। ভারতে নদীপথে পন্য পরিবহনে ০.৫ টাকা খরচ হয় প্রতি কিলোমিটারে যেখানে রেলপথে ও সড়ক পথে পন্য পরিবহনে প্রতি কিলোমিটারে যথাক্রমে ১ টাকা ও ১.৫ টাকা খরচ হয়। যার জন্য ভারত সরকার অন্তর্দেশীয় জলপথ উন্নয়নের জন্য একাধিক প্রকল্প শুরু করেছে। ২০১৬ সালে ভারত সরকার জাতীয় জলপথ আইন অনুযায়ী ভারতের ১১১টি অন্তর্দেশীয় জলপথকে জাতীয় জলপথ ঘোষনা করেছে।
২০২১ সালে ২১ অক্টোবর মাল্টিমোডাল সংযোগের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার গতিশক্তি প্রকল্প শুরু করেছে যার লক্ষ্য ভারতকে ৫ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দেশে পরিনত করা। এই গতিশক্তি প্রকল্পকে অন্তর্দেশীয় জলপথ তৈরির প্রজেক্টের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। ভারত সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ রাজ্যের নদীপথকে ব্যবহারের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করেছে যাকে উত্তরপ্রদেশের ব্লু হাইওয়ে নেটওয়ার্কও বলা হচ্ছে। এর পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ সরকার রপ্তানির জন্য নদীপথে পন্য পরিবহনের রূপরেখা তৈরি করছে। একদিকে যখন জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ গোটা দেশজুড়ে ছয় ও আট লেনের জাতীয় সড়ক তৈরি করছে, ভারতীয় রেলওয়ে বিশেষ পন্য পরিবহন পথ তৈরি করছে, বুলেট ট্রেন, বন্দেভারতের মতো আধুনিক ট্রেন শুরু করছে অন্যদিকে তখন উত্তরপ্রদেশ সরকার সড়ক ও রেল নেটওয়ার্কের পাশাপাশি অন্তর্দেশীয় জলপথেরও উন্নয়ন করছে যা ভবিষ্যতে উত্তরপ্রদেশ সহ ভারতের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আরও মজবুত করবে।
যেকোনও দেশের উন্নয়নে সেই দেশটির পরিবহন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা আছে। ভারতের মতো বড় দেশে বানিজ্যিক পরিকাঠামোকে আরও উন্নয়নের জন্য আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার প্রয়োজন। এই জন্য ভারতের অন্যতম বড় শহর উত্তরপ্রদেশে সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে তেরোটি এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হচ্ছে যার মধ্যে ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মান সম্পূর্ন হয়ে গেছে। এছাড়া ভারতীয় রেলওয়েের পূর্ব পশ্চিম পন্যপরিবাহী পথেরও গুরুত্বপূর্ন ভাগ উত্তরপ্রদেশ যার জন্য উত্তরপ্রদেশে মাল্টিমোডাল লজিস্টিক কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। ২০২৭ সালে উত্তরপ্রদেশের অর্থনীতি ১ ট্রিলিয়ন ডলার করার লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে উত্তরপ্রদেশ সরকার এক্সপ্রেসওয়ে, সড়ক, মেট্রোরেল সহ পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ৫৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। কিন্ত এরপরেও উত্তরপ্রদেশের মতো বড় রাজ্যে পরিবহন ব্যবস্থার কিছুটা সমস্যা দেখা যাচ্ছিল, এই সমস্যা সমাধানের জন্য উত্তরপ্রদেশ সরকার নদীপথকেও পরিবহন মাধ্যম হিসাবে ব্যবহারের জন্য ব্লু হাইওয়ে তৈরির পরিকল্পনা করেছে।
ভারত সরকারের অন্তর্দেশীয় জলপথ সংস্থা এই বিষয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। কম খরচে যাত্রী পরিবহন ও পন্য রপ্তানির জন্য উত্তরপ্রদেশ সরকার এই নদীপথ ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছে। এই নদীপথ উন্নয়নের মাধ্যমে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে রাজ্যের রপ্তানি ৩ ট্রিলিয়ন রুপী করার লক্ষ্য নিয়েছে উত্তরপ্রদেশ সরকার। অন্তর্দেশীয় জলপথ সরাসরি সমুদ্র বন্দরের সাথে লজিস্টিক কেন্দ্রকে সংযুক্ত করে যা পন্য পরিবহনে খরচ কম করে। ভারতের ১১১টি অন্তর্দেশীয় জলপথের মধ্যে উত্তরপ্রদেশে গঙ্গা, যমুমা, সরুয়ু, বেতওয়া এবং চম্বল সহ গুরুত্বপূর্ন এক ডজন অন্তর্দেশীয় জলপথ রয়েছে। ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া বা আইডব্লুউএআই ইতিমধ্যেই উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজ থেকে পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া পর্যন্ত জাতীয় জলপথ ১ তৈরি করে ফেলেছে। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ জানিয়েছেন একটি অন্তর্দেশীয় জলপথ সংস্থা তৈরি করা হবে, এই সংস্থাটি অন্তর্দেশীয় জলপথের মাধ্যমে পরিবহন সহ ভারতের অন্যরাজ্য ও অন্যদেশের সাথের বানিজ্যের ব্যাপার দেখবে। সড়ক পরিবহন ও রেলপথে অতিরিক্ত যাত্রীর কারনে সবসময় ভিড় লেগেই থাকে, সড়কে অতিরিক্ত যান জটের কারনে সমস্যায় পড়ে সাধারন মানুষ। তাছাড়া ভারতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর বহু মানুষের মৃত্যু হয়। গতবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ভারতে ১.৬৮ লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার কারনে ২.৯১ লাখ কোটি টাকার সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে দেশের। ব্যাপক যাত্রী সংখ্যার কারনে রেলওয়ে টিকিটের জন্য লম্বা লাইন পড়ে। এরকরম পরিস্থিতিতে অন্তর্দেশীয় জলপথ সড়কপথে ও রেলপথে অতিরিক্ত যাত্রী ভিড় কমাতে সহায়তা করবে। এই জন্য উত্তরপ্রদেশ সরকার জাতীয় সড়কের মতো ব্লু হাইওয়ে নির্মানের পরিকল্পনা করছে যাতে পরিবহন ব্যবস্থা আরও সহজ হয় এবং খরচ কম হয়। রেলপথের তুলনায় ৩০ শতাংশ এবং সড়ক পথের তুলনায় ৬০ শতাংশ কম খরচ হয় নদীপথে পরিবহনে। বিশ্বব্যাঙ্ক তাদের একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে যেখানে এক লিটার জ্বালানিতে জলপথে ১০৫ টন কিলোমিটার পন্য পরিবহন করা সম্ভব সেখানে এক লিটার জ্বালানিতে রেলপথে ৮৫ টন কিলোমিটার এবং সড়কপথে ২৪ টন কিলোমিটার পন্য পরিবহন করা সম্ভব। নদীপথে পন্য পরিবহন প্রকৃতিতে দূষনও কম করে। বিশ্বব্যাঙ্কের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে নদীপথে প্রতিটন কিলোমিটার পন্য পরিবহনে ৩২-৩৬ গ্রাম কার্বন নির্গমন করে কিন্তু সড়কপথে প্রতিটন কিলোমিটার পন্য পরিবহনে ৫১-৯১ গ্রাম কার্বন নির্গমন করে। এই জন্য ভারতের অন্যতম বড়রাজ্য উত্তরপ্রদেশ যদি অন্তর্দেশীয় জলপথকে পন্য ও যাত্রী পরিবহন হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করে তাহলে এটি উত্তরপ্রদেশ সহ সমগ্র ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করবে। এছাড়া ভবিষ্যতে ভারতের শূন্য কার্বন নির্গমন লক্ষ্য মাত্রাতে পৌঁছাতেও সাহায্য করবে এই অন্তর্দেশীয় জলপথ পরিবহন। উত্তরপ্রদেশ সরকার এই ব্লু হাইওয়ে তৈরির মাধ্যমে উত্তরপ্রদেশে পর্যটনশিল্পের আরও বিকাশ ঘটানোরও পরিকল্পনা করেছে। এর জন্য উত্তরপ্রদেশ সরকার ২০২৩ সালে জল পর্যটন নীতি তৈরি করেছে। উত্তরপ্রদেশ হিন্দু ধর্মের অনুসারিদের জন্য অতি পবিত্র স্থান। কাশী বেনারস, অযোধ্যা, বৃন্দাবন, মথুরা, বরষনা, গোকুুল, গোরখপুরের হিন্দু ধর্মের পবিত্র তীর্থস্থান উত্তরপ্রদেশেই অবস্থিত। যার জন্য প্রতিবছর কয়েক কোটি হিন্দু তীর্থযাত্রী উত্তরপ্রদেশে আসে। তাই উত্তরপ্রদেশ সরকার জল পর্যটন শুরু করেছে যাতে আরও বেশী পর্যটক এখানে আসতে পারে।
আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোও অন্তর্দেশীয় জলপথ পরিবহন ও পর্যটনের জন্য ব্যবহার করে। তবে উত্তরপ্রদেশে ব্লু হাইওয়ে তৈরিতে কিছু সমস্যাও রয়েছে। ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশে প্রায় ত্রিশটি নদী রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের প্রধান নদী গুলো হিমালয় পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়েছে যার জন্য এসব নদীতে সারাবছরই জল থাকে। এই কারনে উত্তরপ্রদেশ ব্লু হাইওয়ে তৈরি জন্য অনুকুল। তবে পরিবহন দপ্তরের কথায় উত্তরপ্রদেশের কিছু নদীতে বছরের বেশ কিছু মাসে জলস্তর কম থাকে, এসব নদীর গভীরতাও কম। পন্যবাহী জাহজের চলাচলের জন্য অন্তত দুই মিটার নদীর গভীরতা প্রয়োজন। যার জন্য এসব নদীতে জলস্তর বৃদ্ধি বা নদীর গভীরতা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। তবে মেরিটাইম ইন্ডিয়া ভিশন ২০৩০ অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশে গঙ্গানদীর উপর অবস্থিত জাতীয় জলপথ ১এ ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার নেতৃত্বে বার ও গাজীপুরের মধ্যে ২.৫ মিটার এবং গাজীপুর ও বেনারসের মধ্যে ২.২ মিটার নদী গভীরতা বৃদ্ধির কাজ চলছে। এরকরম ভাবে উত্তরপ্রদেশের বাকী নদীপথেও এরকম নদী গভীরতা বৃদ্ধি করা হবে ধাপে ধাপে। ২০৩০ সালের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে উত্তরপ্রদেশ জিডিপির দিক দিয়ে ভারতের বাকী সব রাজ্যগুলোর থেকে উপরে থাকবে।