আলুর কারনে ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণ গেছিল। জানুন বিস্তারিত
এক এক দেশের পরিবেশ অনুযায়ী সেখানকার প্রধান খাদ্য নির্বাচিত হয়। যেমন পশ্চিমবঙ্গের প্রধান খাবার ভাত ঠিক সেরকমই আয়ারল্যান্ডের আইরিশবাসীদের প্রধান খাদ্য হল আলু। কারণ সেখানকার মাটি আলু চাষের পক্ষে এতটাই উর্বর ছিল যে তাদের প্রধান খাদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল আলু। কিন্তু বেশ কয়েক বছর আলুর সংকটের জন্য দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল আয়ারল্যান্ডে। সেই দুর্ভিক্ষ পটাটো ফ্যামাইন নামে পরিচিত। আইরিশবাসীদের দিন দুঃসময়ে কেটেছিল আনুমানিক ১৮৪৫ সাল থেকে ১৮৫২ সাল পর্যন্ত। টানা ৮ বছর ধরে চলা এই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছিল ১০ লক্ষ আইরিশ, যা সংখ্যায় সেসময়কার আয়ারল্যান্ডের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ, এছাড়াও ঘরবাড়ি ভেঙে চুরে যাওয়ায় কারনে আরও ১০ লক্ষ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল ওই দেশ থেকে, কারণ এই সব মানুষ শূণ্য হাতে অভিবাসী হয়ে অন্য দেশে পারি জমিয়েছিল। তাহলে একটু বিস্তারিত ভাবেই বলা যাক আসলে কেন আলু চাষে ঘাটতি পরেছিল এবং কেন দেখা দিয়েছিল এই দূর্ভিক্ষ?
সেই সময়কার ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় যে ১৮৪৫ সালে Phytophthora Infestense নামে একপ্রকার ফাঙ্গাস দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল আয়ারল্যান্ডের সমস্ত চাষের জমিতে। এরপরেই এই ছত্রাকটি এমনভাবে আলুর চাষের উপর আক্রমণ করেছিল যে চোখের পলক পরতেই শ্মশান ভূমিতে পরিণত হয়েছিল চাষের জমি। এরপরেই গোটা শহর জুড়ে দেখা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ। যেহেতু আলু ছিল ওই শহরের প্রধান খাদ্য তাই চাষের জমির ৮০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনাহারে দিন কাটছিল সেখানকার বাসিন্দাদের। সেই সময় আয়ারল্যান্ডের অধিকাংশ প্রজা কৃষকেরা গ্রেট ব্রিটেনের উপনিবেশ হিসেবে নিয়ন্ত্রিত হতো। সে কারণেই তখন ওখানকার মানুষ এতটাই আলুর উপর নির্ভর হয়ে গিয়েছিল যে আলু চাষের সমস্যা দেখা দেওয়ায় তারা প্রায় অনাহারে দিন কাটাচ্ছিল। তবে এটা নয় যে তারা অনুর্বর জমিতে অন্য কোন চাষের চেষ্টা করেনি। শাকসবজি সহ অন্যান্য তরকারি চাষের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল কৃষকেরা। এমনকি সেই দুর্বৃত্তের সময় শিয়ালের উপদ্রব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে পোল্ট্রি ফার্ম কিংবা অন্য কোন পালিত পশুর ব্যবসাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের কাছে। টানা সাত বছর এই দুর্ভিক্ষের মধ্যে সময় কাটিয়েছিল আইরিশবাসীরা।
হঠাৎ করে এমন সবুজে ভরা শহরে কেন এমন দুর্ভিক্ষ দেখা দিল সেই নিয়ে গবেষণা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানের মাধ্যমে খোঁজাখুঁজির ফলে প্রকাশ্যে এসেছিল যে, ১৮০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধের আগে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত গ্রেট ব্রিটেনের উপনিবেশ হিসেবে পরিচিত ছিল আয়ারল্যান্ড। স্বাভাবিকভাবেই আইন অনুযায়ী তখনকার আয়ারল্যান্ডের পরিচালক হিসেবে ছিল গ্রেট ব্রিটেনের জেনারেল ও লেফটেন্যান্ট। তাদের নির্দেশ মতোই হাউজ অব কমন্সের জন্য আয়ারল্যান্ড পাঠিয়েছিলো প্রায় ১০৫ জন প্রতিনিধি এবং হাউজ অব লর্ডসের জন্য পাঠানো হয়েছিলো ২৮ জন সহকর্মীকে। কিন্ত এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এতো প্রতিনিধি আইরিশ থাকলেও তাদের জমির মালিক থাকতো ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত পুত্রেরা। সেই সময়ে পেনাল’ল অনুযায়ী যে সমস্ত আইরিশ জনসংখ্যা ক্যাথলিক চর্চা করতো পাশাপাশি তারা জমির মালিক হওয়া থেকে শুরু করে ভোট দিতে পর্যন্ত পারত না।
যার কারণে ভোট থেকে বঞ্চিত এই সকল ক্যাথলিক সদস্যদের জোর করে কৃষক প্রজাদের রূপান্তরিত করত জমি অধিগ্রহণকারীরা। ব্রিটেনের জেনারেল এবং লেফটেন্যান্ট যেহেতু জমি পরিচালনার কাজে থাকত তাই, তাদের নির্দেশ অনুযায়ী জমিতে ফলন আলুর সিংহভাগ রপ্তানি করা হতো বিদেশে। এমনকি যখন চাষের জমিগুলিতে Phytophthora Infestans জীবাণুর কারণে চাষের জমিগুলি অনুর্বর হয়ে উঠতে শুরু করেছিল তখনো দেশের গরীব কৃষকদের কথা না ভেবেই আলু রপ্তানি করা হতো বিদেশে। এর ফলে যখন বিরাট আকাল দেখা দিয়েছিল আলুর, তখন না খেতে পেয়ে দেশের প্রায় লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
পরবর্তীতে যখন আলুর সংকটের বিষয়টি প্রকট রূপ ধারণ করেছিল আয়ারল্যান্ডের ডাব্লিন শহরের নেতারা, তখন ব্রিটিশ কুইন ভিক্টোরিয়া ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সাহায্যে প্রার্থনা করলে তারা তৎক্ষণাত তা মঞ্জুর করে এবং শস্য আইন নাকচ করে দেয়। কিন্তু শেষ সময়ে এই করুণা দেখালেও কোন লাভ হয়নি গরিব কৃষকদের। ১৮৫২ সাল পর্যন্ত চলা এই মহামারীর কারণে আয়ারল্যান্ডে অনাহারে মৃত্যু হয়েছে এক মিলিয়ন নারী, পুরুষ ও শিশুদের এবং দেশ ছেড়ে অভিবাসী হওয়ার সময় ও মৃত্যু হয়েছে ৫০ হাজার জনগণের।
যেহেতু দাবানলের মত এই দুর্ভিক্ষ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তাই গরিবদের পাশাপাশি একসময় ধনী লোকেদের দরজায় কড়া নেড়েছিল খাদ্যের অভাব। তার ফলে ১৯৪৯ সালে আইরিশ পরিবার ইংল্যান্ডে অভিবাসন শুরু করেছিল। পরবর্তী সময়ে প্রায় ৬-৭ বছর পর যখন পরিস্থিতি পুনরায় ঠিক হয়েছিল ততদিনে ওই দেশের জনসংখ্যা দাড়িয়ে ছিল অর্ধেকেরও কম।
উল্লেখ্য, ইতিহাসবিদদরা বলেছেন, আয়ারল্যান্ড থেকে সেই দুর্ভিক্ষের সময়ই বিদেশে খাদ্য আমদানি হয়েছে সবচেয়ে বেশি৷ অথচ সেই দেশে লাখো লাখো মানুষ মারা যাচ্ছিলো খাদ্যাভাবে। ১৮৪৮ সালের রেকর্ড অনুযায়ী সেসময় আয়ারল্যান্ড থেকে আমদানি হতো নানা ধরণের পণ্যদ্রব্য যেমন, পর্যাপ্ত ডাল, মটরশুঁটি, খরগোশ সহ মাছ ও মধু।