অফবিট

২০২৭ সালের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি ৫ ট্রিলিয়ন হওয়ার পথে। বিরাট ভূমিকা নিতে চলেছে মহারাষ্ট্র

ভারত সরকার ২০২৫ থেকে ২০২৭ এর মধ্যে ভারতের জিডিপি ৫ ট্রিলিয়ন ডলার করবার লক্ষ্য নিয়েছে। বর্তমানে ভারত ৩.৩৭২ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি বিশিষ্ট বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। যেখানে ২০২২-২৩ এর দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারতের নমিনাল জিডিপি ছিল ৬৫.৬৭ লাখ কোটি সেখানে ২০২৩-২৪ এর দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারতের নমিনাল জিডিপি ৭১.৬৬ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিগত একবছরে ভারতের নমিনাল জিডিপিতে ৯.১ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। ২০১৪ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিজেপি সরকার ভারতের আর্থিক বিকাশে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির মাত্রা দেখে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারনা ২০৩০ এর মধ্যে ভারত জার্মনি ও জাপানকে ছাড়িয়ে বিশ্বের তৃতীয় আর্থিক শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠবে এবং তখন ভারতের জিডিপি হবে ৭.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। তবে ২০২৭ এর মধ্যে ভারত সরকার ভারতের জিডিপি ৫ ট্রিলিয়ন ডলার করার যে লক্ষ্য নিয়েছে তাতে ভারতের বন্দরের গুলোর একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা থাকবে। আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত ভারতবর্ষে ঐতিহাসিক কাল থেকেই সমুদ্র বন্দর অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখে এসেছে। 

অতীতে ভারতীয় নাবিকরা সিরিয়া, ইরাক, ইরান সহ মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বানিজ্য করতো এবং সেখান থেকেও নাবিকরা ভারতে আসতো। ব্রিটিশ, পর্তুগীজ, ফ্রান্স সহ ইউরোপীয়ান ব্যবসায়ীরা প্রথমে বানিজ্য করবার উদ্দেশ্যেই ভারতের বিভিন্ন বন্দরে এসেছিল। বর্তমানেও বিশ্বের অধিকাংশ বানিজ্য সমুদ্রের মাধ্যমেই হয় কারন সমুদ্রের মাধ্যমে বানিজ্য অন্য সব মাধ্যম অপেক্ষা বেশী কার্যকরী ও সস্তা। বিশ্বের অধিকাংশ সমুদ্র বানিজ্যই হয় মালাক্কা প্রনালী দিয়ে। এই মালাক্কা প্রনালীর কাছেই ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ অবস্থিত। যার কারনে ভারত সরকার দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য নতুন নির্মানে ও পুরোনো বন্দরের পরিকাঠামো উন্নয়নে বিশাল আকারে বিনিয়োগ করছে।

প্রধানমন্ত্রী গতিশক্তি প্রকল্পের অধীনে ভারত সরকার ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এই প্রকল্প অনুযায়ী বন্দর ও বানিজ্যের জন্য ভারত সরকার ১০১ টি প্রজেক্ট শুরু করেছে। এই সমস্ত প্রজেক্টের জন্য প্রাথমিক ভাবে ৬০,৮৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। যার মধ্যে ৪,৪২৩ কোটি টাকার ১৩ টি প্রজেক্ট ইতিমধ্যেই সম্পূর্ন হয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কয়েকটি বন্দর তৈরিরও কাজ চলছে জোরকদমে। এরকমই একটি গুরুত্বপূর্ন বন্দর তৈরি হচ্ছে মহারাষ্ট্রের পালঘর জেলায়, যার নাম ভাধাবন বন্দর। 

২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী কেন্দ্রীয় সরকার সাগরমালা প্রজেক্টের আওতায় এই বন্দর তৈরির সবুজ সংকেত দিয়ে দেয়। কেন্দ্রীয় সরকারের জাহাজ মন্ত্রকের একটি অতি গুরুত্বপূর্ন প্রজেক্ট এই সাগরমালা প্রজেক্ট। ভারতের লজিস্টিক বিভাগের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য ২০১৫ সালের ৩ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রকল্পের সূচনা করেন। এই প্রকল্পে ১১ ট্রিলিয়ন রুপি বা ১৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হবে যাতে ভারতের বৃহত বন্দর নির্মান করা হবে, পুরোনো বন্দরের পরিকাঠামো উন্নয়ন করা হবে এবং ১৪ টি উপকূলীয় বিশেষ আর্থিক অঞ্চল তৈরি করা হবে। এই প্রজেক্টে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে দশ মিলিয়ন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। মহারাষ্ট্রের ভাধাবন বন্দর এই সাগরমালা প্রজেক্টেরই অংশ। ২০২০ সালে এই বন্দর তৈরির ঘোষনা হলেও বেশ কিছু বিরোধীতার কারনে এই প্রজেক্টের কাজ একটু ধীরে হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রজেক্টের সমস্ত বাধা দূর করার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাইয়ের পাশে পালঘর জেলার ভাধাবনে সমুদ্র উপকূলে নির্মিত এই বন্দর ভারতের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে। পাঁচ হাজার একর সামুদ্রিক এলাকায় এই ভাধাবন বন্দর জেএনপিটি বা জওহরলাল নেহেরু পোর্ট ট্রাস্ট তৈরি করছে। সমুদ্র উপকূল থেকে চার কিলোমিটার লম্বা ও কুড়ি মিটার গভীর একটি পরিকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। এই বন্দর তৈরি সম্পন্ন হলে প্রতিবছর এই বন্দর দিয়ে ১৩২ মিলিয়ন টন কয়লা, সিমেন্ট, রাসায়নিক ও তেল পরিবহন করা সম্ভব হবে। এই পরিবহন ব্যবস্থাকে আরও মসৃন করার জন্য এই প্রজেক্টে ৩৩.৪ কিলোমিটার লম্বা রাস্তা ও জাতীয় সড়ক থেকে ১২ কিলোমিটার লম্বা রেলপথ নির্মান করা হবে। ২০২৮ এর মধ্যে এখানে পন্য রাখার জন্য ৩৮ টি গুদামও তৈরি করা হবে। এর আগে ১৯৯৫ সালেও একটি বেসরকারি সংস্থা এই প্রজেক্ট শুরু করেছিল কিন্তু তখন স্থানীয়দের বিক্ষোভের কারনে মহারাষ্ট্র সরকার এই প্রজেক্ট বন্ধ করে দেয়। দাহানু তালুকা পরিবেশ সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ ১৯৯৮ সালে পরিবেশ সুরক্ষার কারন দেখিয়ে সেসময় এই প্রজেক্ট বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্ত ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার গঠনের পর পুনরায় এই প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু হয়। ভাধাবন বন্দর নির্মান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের প্রজেক্ট বলা হচ্ছে।

জেএনপিটির ৭৪ শতাংশ এবং মহারাষ্ট্র সাগর মন্ডলের ২৬ শতাংশ অংশীদারত্বে ৭৫,০০০ কোটি টাকার এই মেগা প্রজেক্টে কাজ শুরু হচ্ছে। এই বন্দরে ২৪ ঘন্টা কাজ হবে যাতে পুরো এলাকার অর্থনৈতিক বিকাশ হবে। তবে এই বন্দর তৈরিকে ঘিরে ১৯৯৫ সালের মতোন আবারও বিক্ষোভ শুরু করেছে স্থানীয়রা। স্থানীয়দের দাবী এই বন্দর নির্মানের ফলে এখানের সমুদ্রে থাকা মাছ সহ সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ভাধাবন এলাকার আশেপাশের অঞ্চলকে গোল্ডেন বেল্ট বলা হয়। এখানে তেরোটির বেশী গ্রামে প্রায় এক লাখের বেশী কৃষক ও জেলে পরিবার রয়েছে। সুতরাং স্থানীয়দের আশঙ্কা এই বন্দর তৈরির ফলে এই সমস্ত পরিবারের মানুষ কাজ হারাবে ও তাদের অন্যত্র বসতি স্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয়রা মনে করছে তাদের অবস্থাও রায়গড়ের নাভা সেভাতে স্থানীয়দের মতোন হবে, নাভা সেভাতে বন্দর তৈরির জন্য স্থানীয়দের অন্যত্র চলে যেতে হয়েছিল। জেএনপিটি নাভা সেভাতে ভারতের সবচেয়ে বড় কার্গো বন্দরের দায়িত্বে রয়েছে। তবে স্থানীয় মানুষদের এই আশঙ্কা দূর করার জন্য জওহরলাল নেহেরু বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান শ্রী সঞ্জয় শেঠী এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা স্থানীয় মানুষদের সাথে দেখা করে তাদের সাথে আলোচনা করেন এবিষয়ে। শ্রী সঞ্জয় শেঠী জানিয়েছেন ভাধাবন বন্দর প্রজেক্ট স্থানীয় ভারতের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন একটি পদক্ষেপ। এই বন্দর নির্মানে কোনও অতিরক্তি জমি অধিগ্রহন করা হবেনা, স্থানীয় মানুষদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরন দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন বন্দর, রেলপথ, রাস্তা নির্মানে ৫০,০০০ এর অধিক শ্রমিক লাগবে যাতে স্থানীয় মানুষদের জীবিকার উপায় হবে। এছাড়া এই বন্দর নির্মানের জন্য আরও একটি আশঙ্কা ছিল যে বন্দরের প্রস্তাবিত স্থান থেকে বারো কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত তারাপুর পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে কীনা। তবে পরমানু বিদ্যুৎ মন্ত্রক সমস্ত পরীক্ষার পর এই প্রজেক্টকে সবুজ সংকেত দিয়ে দিয়েছে। চার বছর জরিপের পর দাহানু তালুকা পরিবেশ সুরক্ষা কর্তৃপক্ষও গত ৩১ জুলাই এই বন্দর প্রজেক্টকে সবুজ সংকেত দিয়ে দিয়েছে। সুতরাং ভাধাবন বন্দর নির্মানে আর কোনও সমস্যাই নেই। 

বর্তমানে মহারাষ্ট্রে মুম্বাই ও জেএনপিটি নামে দুটি বড় বন্দর থাকলেও আরও একটি বন্দর নির্মান আবশ্যক হয়ে পড়েছে। জেএনপিটি ভারতের সবচেয়ে বড় কন্টেইনার বন্দর যার মাধ্যমে মহারাষ্ট্র, উত্তর কর্নাটক, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশ সংযুক্ত। জেনএনপিটি ও গুজরাটের মুন্দ্রা ভারতের সবচেয়ে বড় দুটি কন্টেইনার বন্দর। কিন্তু এই দুটি বন্দরে মাঝারি আকারের কন্টেইনার জাহাজ আসতে পারে। কিন্ত ভাধাবন বন্দর হবে আরও গভীর সমুদ্র বন্দর যেখানে বড় বড় কন্টেইনার জাহাজ আসতে পারবে। এর ফলে লজিস্টিকে খরচ কম হবে এবং অর্থনীতি মজবুত হবে। বিগত কয়েক বছরে মুম্বাই বন্দর এবং জেএনপিটির আশেপাশে শহর গড়ে ওঠায় পন্য পরিবহন সমস্যার হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই ভাধাবন বন্দর দিল্লি মুম্বাইকে সংযুক্ত করা জাতীয় সড়ক এনএইচ ৪৮ এর থেকে ৩৫- ৪০ কিলোমিটার এবং রেলপথ থেকে দশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হওয়ায় এখান দিয়ে পন্য পরিবহন অনেক সহজ হবে। যার কারনে ভারতের পশ্চিম উপকূল দিয়ে আন্তর্জাতিক বানিজ্য আরও সহজ হয়ে পড়বে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জনকল্যানকর এই ভাধাবন বন্দর প্রজেক্ট ভারতকে অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার করে তোলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ন পদক্ষেপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *