অফবিট

কাশপ্য মুনির থেকেই কাশ্মীর! জানুন বিস্তারিত

রাজেশ রায় :– গ্রেট হিমালয় ও পীর পন্জাল রেঞ্জের মধ্যে অবস্থিত মনোমুগ্ধকর কাশ্মীর ভ্যালি ভারতের গর্ব। কাশ্মীরের ইতিহাস ও ঘটনা সবাই কম বেশী জানেন। তবে কাশ্মীরের এমন অনেক গল্প আছে যা হয়ত অনেকেই জানেননা। আজ সেই সম্পর্কেই আলোচনা করা হবে। সাথে সাথে কাশ্মীরে এমন এক প্রাচীন গাছ সম্পর্কে বলা হবে যা শুনে হয়ত আপনিও অবাক হয়ে যাবেন।

ভারতের ভূস্বর্গ খ্যাত কাশ্মীরের এই সুন্দর উপত্যকা আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পূর্বে এক বিশাল ঝিলের তলায় ছিল, যেই এই ঝিলের জল সরে যায় তখনই কাশ্মীরের এই ভূমি প্রকাশিত হয়। এই ঝিলের নাম ছিল সতীশর ঝিল। বলা হয় সপ্তম মনুর সময়ে অর্থাৎ রামায়ন কালেরও বহু পূর্বে কাশ্মীরের নাম ছিল সতীশর। কাশ্মীরের প্রথম নিবাসি কোন মানুষ ছিল না বলা হয় নাগ, পিশাচ, দক্ষরা এখানে বাস করত। পরে মহা মুনি কাশ্যপের নাম অনুসারে এই জায়গার নাম হয় কাশ্যপ সাগর বা কাশ মার, সেই থেকে আসে কাশ্মীর। কাশ্মীরের ভূমি ক্যাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এটাই এখানকার ক্যাস্পিয়ান সাগর যার একদিকে আজারবাইজান অন্যদিকে তুর্কীমিনিস্তানের মত দেশ রয়েছে। পূর্বে এত দূর ছিল কাশ্মীর যেখানে কাশ্যপ মুনি ও তার বংশজরা থাকত। কাশ্মীর শব্দের অর্থ একটি ভূমি যা জল থেকে উঠে এসেছে। আজ যে পাকিস্তান বারবার লাফালাফি করে কাশ্মীর তাদের বলে আসলে কাশ্মীর আদি অনন্ত কাল ধরেই সনাতনি দের তখন পাকিস্তান তো দূর অস্ত এই পবিত্র ভূমিতে সনাতন ছাড়া কোন ধর্মই ছিলনা বলে মত একাধিক বিশেষজ্ঞদের। তবে কাশ্মীরের অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিক, ধার্মিক ও পৌরানিক গল্প আছে। প্রথমে জানা যাক বিজ্ঞান কী বলছে? 

ভূবিজ্ঞানীদের কথা অনুযায়ী হাজার বছর পূর্বে কাশ্মীর ঝিলের তলায় ছিল। আশেপাশের পাহাড় ধ্বসে ঝিলের উপর পড়ে ফলে জল বেরিয়ে যায় এবং কাশ্মীরের এই অলৌকিক সুন্দর ভূমি তৈরি হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের বলার বহু আগে সনাতন ধর্মের বড় পীঠস্থান ছিল এই কাশ্মীর। কলহনের রাজতরঙ্গিনী ও নীলমত পুরানে কাশ্মীরের উল্লেখ পাওয়া যায়। নীলমত পূরানকে কাশ্মীর সম্পর্কিত সবচেয়ে প্রাচীন পুস্তক বলা হয়। এবার কাশ্মীর তৈরির পৌরানিক কাহিনী বলা যাক। নীলমত পুরানের রচয়িতা বলা হয় কাশ্যপ মুনির পুত্রদের। এই পুস্তকে কাশ্মীরের সতীশর ঝিলের কথা উল্লেখ আছে। সতীশর ঝিলের রক্ষা করত সেসময় বিশাল নাগেরা। বহুযুহ পূর্বে জলদ্ভোব নামে এক রাক্ষস ব্রহ্মার বর প্রাপ্ত হয়ে জল থেকে অমরত্ব লাভ করে এবং শক্তির অহংকারে চূর্ণ হয়ে সে অত্যাচার শুরু করে এবং সতীশর ঝিলে এসে বাস করতে শুরু করে। নাগেরা তার অত্যাচারে আতঙ্কিত হয়ে যায়। সপ্তম মনুর সময়ে নাগকুলের গুরু কাশ্যপ মুনি এখানে আসেন এবং জলোদ্ভবের অত্যাচারের কথা জানতে পারেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন এই এলাকাকে মুক্ত করার। তিনি ভগবান শিবের উপাসনা শুরু করেন। শিব প্রসন্ন হয়ে ওনাকে দেখা দিয়ে এই এলাকাকে জলদ্ভোবের অত্যাচার থেকে মুক্ত করবার আদেশ দেন। 

ভগবান শিব, বিষ্ণু ও ব্রাহ্মার আদেশে দেবতারা এই ঝিলকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেন। কিন্তু জলোদ্ভবের তো অমরত্ব বর ছিল জল থেকে ফলে তাকে হারানো সম্ভর ছিল না জলে। ভগবান বিষ্ণুর সাথে জলদ্ভোবের কয়েক শতাব্দী যুদ্ধ চলে তাও তাকে পরাস্ত করতে পারা যাচ্ছিল না। তখন ভগবান বিষ্ণুর শেষনাগ রুপি বলরাম তার হালের সাহায্যে আশেপাশের পাহাড় ধ্বসিয়ে দেয় এবং বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্রের সাহায্যে জলদ্ভোবের গলা কেটে দেয়। এরপর কাশ্যপ মুনি এখানেই বসবাস শুরু করেন। বলা হয় কাশ্মীর ঘাটির সৌন্দর্য দেখে মোহিত দেবতারা পর্যন্ত এই জায়গা ছেড়ে স্বর্গে যেতে চাননি। দেখুন এটা ছিল পৌরাণিক ঘটনা, বিশ্বাস করা না করা আপনাদের নিজস্ব ব্যাপার। তবে অসাধারন সুন্দর এই কাশ্মীর উপত্যকার ইতিহাস গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে আদি গুরু শঙ্করাচার্য, মহাভারত কাল, সম্রাট অশোকের সাথেও যুক্ত। 

এবার জানা যাক কেন্দ্র শাসিত প্রদেশ জম্মু কাশ্মীরের অত্যাধিক প্রাচীন একটি গাছ ব্রেমজি কুল সম্পর্কে। ব্রেমজি কুল কাশ্মীরের একটি প্রাচীন গাছ যা শুধুমাত্র কাশ্মীর উপত্যকাতেই পাওয়া যায়। প্রাচীন এই গাছ আজ পুরো উপত্যকা থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। একসময় কাশ্মীরের পরিচিতি ছিল এই ব্রেমজি কুলের মাধ্যমে যা আজ কমতে কমতে শুধু কয়েকটি বিশেষ জায়গাতেই পাওয়া যায়। বেশ কয়েকটি প্রজাতি পাওয়া যেত এই গাছটির। সাধারনত কোন কবরস্থানে সুফী সন্তদের কবরের কাছে এই গাছ পাওয়া যেত। অর্থাৎ প্রাচীন কাশ্মীরে সুফি দের কবরের পাশে এই গাছ লাগানো হত। শরত কালে গাছটির সব পাতা ঝড়ে যেত কিন্ত বছরের বাকী সময়ে সবুজ সতেজ গাছটি ক্যানোপি আকারের হত। যদি এর ইতিহাস আমরা দেখি দেখব কয়েকশো বছর পূর্বে কাশ্মীর বিখ্যাত ছিল ধর্মীয় কাজের জন্য। এখানকার মনোমুগ্ধকর পরিবেশ নর নারীকে আকর্ষন করত ইশ্বরের সান্নিধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে। 

কাশ্মীর সেসময় সুফূ কার্যকালাপের জন্যও প্রসিদ্ধ ছিল। সুফী সাধুদের চিরকালই ভারতে খুব উঁচু নজরে দেখা হয়েছে। বিশ্বাস করা হয় সুফীরা ভগবানের দূত সেজন্য কোন সুফী সাধু মারা গেলে তার সম্মানে এই ব্রেমজি কুল গাছ তার কবরের পাশে লাগানো হত। এটি দীর্ঘকাল ধরে কাশ্মীরে একটি প্রথা হয়ে গিয়েছিল। যখনই কোথাও ব্রেমজি কুল দেখা যেত লোকে বিশ্বাস করত এর পাশে কোনও মহাত্মার কবর আছে। বলা হয় ব্রেমজি কুলের নীচে বসলে গরম করে না। যেকোনো গাছের ছায়ায় বসলেই আমাদের আরাম লাগে কিন্তু বলা হয় ব্রেমজি কুল গাছটির একটি বিশেষ ক্ষমতা আছে, গাছটি তাপমাত্রা শুষে নিয়ে চারপাশ মোনোরম রাখে এজন্য সাধু ও পীররা এই গাছের নীচে বসে তপস্যা করত। এইজন্য তাদের সম্মানে এই গাছক তাদের কবরের পাশে লাগানো হত। এই গাছটি যখন বড় হয় তখন পুরো একটি ছাতার মগ আকৃতি নিয়ে নেয় দেখে মনে হয় গাছটি যেন ছাতার মত কবরটিকে রক্ষা করছে। যেকোনও জিনিসের সাথে যদি ধর্মীয় ভাবাবেগ জুড়ে যায় তাহলে তার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। সেজন্য মানুষের ধারনা ব্রেমজি কুল নেগেটিভ শক্তিকে শুষে নিয়ে মানুষকে শান্তি ও পজেটিভ শক্তি দেয় এবং মন শান্ত হয়। এজন্য মুক্তি লাভের জন্য সাধু, পীররা এই গাছের নীচে তপস্যা করত। 

ব্রেমজি কুলের বিজ্ঞান সম্মত নাম সেলটিস অস্ট্রেলিস যা পশ্চিম হিমালয়ে পাওয়া যায়। ধর্মীয় কাজ ছাড়া এই গাছের গুন অনেক। পশু খাদ্যের জন্য এই গাছের যা গাছের চারাগাছ ব্যবহৃত হয় যা পৌষ্টিক তত্ত্বতে ভর্তি, তাছাড়া কাঠের প্রয়োজনেও এই গাছ ব্যবহত হয়। সাধারনত কোন ভিজে জায়গা যেমন নদী, ঝর্নার আশেপাশে এই গাছ জন্মায়, সেখান থেকে তুলে মানুষ একে কবরের পাশে লাগাত। এই গাছ গুলোর শিকড় অনেক মজবুত যা আশেপাশের উষ্ণ তাপমাত্রা শুষে নেবার পাশাপাশি, বন্যা প্রবন এলাকায় মাটি শক্ত করে ধরে রাখত। এই গাছ গুলো প্রায় ২৫ মিটার করে লম্বা। ব্রেমজি কুলের ফুল গুলো গাছের মধ্যেই লুকোনো থাকে এবং এর ফল বেগুনি রঙের। এর কাঠ অত্যন্ত মজবুত যা ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি স্পোর্টস ও চাষের জিনিস তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। বলা হয় একটি ব্রেমজি কুল গাছের জীবনকাল মোটামুটি ১০০০ বছর কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ এই গাছ কাশ্মীর উপত্যকা থেকে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি কাশ্মীরে চিনার গাছ বাঁচানোর জন্য বুদগাম, পুলওয়ামা ও শ্রীনগর জেলায় বিশাল গাছ বাচাও কর্মসূচি অনুষ্ঠিত করা হয়েছিল। কাশ্মীর উপত্যকায় চিনার গাছের গুরুত্ব অনেক। ৫০০০ চিনার গাছ লাগানো হয়েছে এবং একটি অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে গাছ গুলোর অবস্থা সম্পর্কে নজরদারি রাখা হচ্ছে। ঠিক এমন কর্মসূচি ব্রেমজি কুল গাছ বাঁচানোর জন্যও করা দরকার। তবে ভারত সরকার ইতিমধ্যেই একটি কর্মসূচি পরিকল্পনা করেছে, আজাদি কী অমরিত মহতসব ব্যানারে “হার গাও হারিয়ালি” পোগ্রামে ব্রেমজি কুল গাছ সংরক্ষনের প্রজেক্ট নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আর্টিকেল ৩৭০ উঠে যাওয়ার পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীর উপত্যকা কে নতুন ভাবে তৈরি করছে যাতে কাশ্মীরের উন্নয়ন হবে যথেষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *