অফবিট

ভুটানের আধুনিক শহর তৈরি করছে ভারতবর্ষ!

হিমালয় পর্বতের কোলে অবস্থিত ছোট একটি দেশ ভুটান বরাবরই ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। কিন্তু বিগত দুদশকে চীনের কারনে বিশেষ করে শি জিনপিং চীনের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকে চীনের সাথে তার প্রতিবেশীদের বিবাদ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বহুদিন ধরেই ভুটানকে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে চীন। কিন্তু ভারতের কারনে চীন বারবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে কারন স্ট্রাটেজিক ভাবে ভুটান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভারতের কাছে। 

সম্প্রতি ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে ভারত সফরে এসেছিলেন। শেরিং তোবগে প্রথমেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং উভয়ের মধ্যে বৈঠকে একাধিক প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে শেরিং তোবগে একটি বিশেষ প্রকল্পের কথা জানিয়েছে তা হল ভুটান একটি বড় আধুনিক শহর তৈরি করতে চায় যার জন্য ভারতের সহায়তা চেয়েছে ভুটান। ভুটান গেলেফু আধুনিক শহর নির্মানের পরিকল্পনা করেছে, ভারতও ভুটানকে সহায়তা করতে রাজী হয়েছে। এই প্রজেক্ট ভুটান ছাড়াও ভারতের চিকেন নেক অর্থাৎ শিলিগুড়ি করিডরের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। গত ডিসেম্বর, ২০২৩ সালে ভুটানের রাজা ভারত সফরকালে সর্বপ্রথম একহাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত গেলেফু স্মার্ট শহর প্রজেক্টের কথা ভারতকে জানিয়েছিলো, তারপর থেকেই ভারত এই প্রজেক্টের ব্যাপারে পরিকল্পনা শুরু করে। শেরিং তোবগের ভারত সফরে ভারত এই প্রজেক্ট তৈরির ব্যাপারে ভুটানকে সম্মতি দিয়েছে। 

ডিসেম্বর, ২০২৩ সালে ভুটানের রাজা জিগমে কেশর নামগিয়াল ওয়াংচুক ভারত সফরে আসেন, তখনই তিনি জিএমসি বা গেলেফু আধুনিক শহর পরিকল্পনার কথা জানান। ভুটানের মানচিত্রে গেলেফু নামক শহর আগে থেকেই রয়েছে কিন্তু এটা ততটা উন্নত শহর নয়। জিগমে নামগিয়াল ভারত সরকারকে বলেন তিনি এই শহরে এক হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে একটি বিশেষ অঞ্চল নির্মান করতে চান যেখানে একটি ভিন্ন প্রশাসনিক এলাকা থাকবে। গেলেফু শহরকে ভুটানের বড় শহরগুলো হচ্ছে থিম্পু, পারো ও ফুন্টশোলিং এর আকারে গড়ে তুলতে চাইছে ভারত সরকার, এই ফুন্টশোলিং শহরের মাধ্যমেই ভুটানে প্রবেশ করা হয় ভারত থেকে। জিগমে নামগিয়াল দুটি ধাপে গেলেফু প্রকল্প শুরু করার কথা জানিয়েছেন, প্রথম ধাপে গেলেফুকে একটি আধুনিক শহরের আকারে গড়ে তোলা হবে এবং দ্বিতীয় ধাপে গেলেফুকে উত্তর পূর্ব ভারতের সাথে যুক্ত করার কথা জানিয়েছেন। জিগমে নামগিয়াল গেলেফুকে আসামের মাধ্যমে গোটা উত্তর পূর্ব ভারতের সাথে রেল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে এই রেল নেটওয়ার্ক মায়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত করা হবে যাতে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরও ভুটানের সাথে রেল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে যাবে। এভাবে দক্ষিন এশিয়া ও দক্ষিন পূর্ব এশিয়া সংযুক্ত হয়ে যাবে। 

ভারত ও চীনের মাঝে অবস্থিত ছোট্ট পাহাড়ি দেশ ভুটান দীর্ঘদিন ধরে জনবিচ্ছিন্ন ছিল, ভুটান তার নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদেই খুশি ছিল। একটা সময় ভুটান চাইতোনা অন্য কোনও দেশের সাথে সংযোগ রাখতে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে ভুটান নিজের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য এই গেলেফু আধুনিক শহর প্রজেক্ট শুরু করেছে যার লক্ষ্য ভুটানে বিদেশি বিনিয়োগ আনা। ভারত ও চীনের মধ্যে অবস্থিত ল্যান্ডলকড দেশ ভুটানকে কোনও একটি দেশের সাহায্য নিতেই হত এই প্রজেক্টে, এক্ষেত্রে ভুটান ভারতকে বেছে নিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আধুনিক শহর তৈরির কাজ চলছে যেমন সৌদি আরবে নিওম শহর, ইন্দোনেশিয়াতে নুসানতারা শহর তৈরি হচ্ছে, দুবাই, হংকং এবং সিঙ্গাপুরেও আাধুনিক শহর তৈরি হচ্ছে, এরকম ভুটানও গেলেফু শহর তৈরি করতে চাইছে যাতে দেশটির অর্থনৈতিক পরিকাঠামো মজবুত হয়। 

ভুটান সরকার জানিয়েছে এই শহরে খুব কম কার্বন নির্গমন প্রতিষ্ঠান যেমন তথ্যপ্রযুক্তি সেন্টার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হোটেল, হসপিটাল তৈরি করা হবে, এখানে কোনও উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করা হবেনা। ভুটান একটি ল্যান্ডলকড দেশ অর্থাৎ ভুটানের নিজস্ব কোনও সমুদ্রসীমা নেই, ভুটানের একদিকে রয়েছে চীন অধিকৃত তিব্বত এবং অন্যদিকে রয়েছে ভারত। তাই ভুটান বানিজ্যের জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীল। ভারত ভুটানকে সামরিক নিরাপত্তাও দেয় চীনের বিরুদ্ধে। চীন এমন একটি দেশ যার প্রত্যেক প্রতিবেশীর সাথে সমস্যা রয়েছে। চীন প্রতিবেশীদের ভূমি, সমুদ্রসীমা জোর করে দখল করে নিজেদের সীমানা বৃদ্ধি করে। চীন ভুটান ও নেপালকে তাদের অংশই মনে করে। 

২০১৭ সালে ভুটানের ডোকলামে চীন অবৈধ ভাবে রাস্তা নির্মান করার চেষ্টা করেছিলো যা বাধা দিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভুটানের সাথেও চীনের সীমানা নিয়ে বিরোধীতা রয়েছে। এজন্য ভুটান চীন অপেক্ষা ভারতকে বেশী বিশ্বাস করে। ভারত  ভুটানের সাথে এই প্রজেক্টে আগ্রহী কারন এই প্রজেক্ট ভূ রাজনীতিতে ভারতকে সহায়তা করবে। ১৯৯২ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও অ্যাক্ট ইস্ট নীতি শুরু করেন। এই নীতির লক্ষ্য আসিয়ান দেশগুলো সহ দক্ষিন পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা যাতে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং বানিজ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভাবে ভারত লাভবান হয়। ইতিমধ্যেই ভারত সরকার ভারত থেকে ভুটানে রেললাইন নির্মানের জন্য সমীক্ষা করে ফেলেছে। 

আসামের কোকরাঝর থেকে ভুটানের গেলেফু পর্যন্ত ৫৭.৫ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন নির্মানের জন্য প্রয়োজনীয় সমীক্ষা করা হয়ে গেছে। খুব শীঘ্রই এই প্রজেক্টে কাজ শুরু হবে, এই রেললাইন সম্পূর্ন ভারত নিজের খরচে তৈরি করবে। ভারত সরকার পুরো উত্তর পূর্ব ভারতে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য ১২০ বিলিয়ন রুপী খরচ করছে। আসাম থেকে ভুটান পর্যন্ত এই রেললাইন নির্মানে ১০ বিলিয়ন রুপী খরচ হবে। ২০২৬ সালের মধ্যেই এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হয়ে যাবে। 

সম্প্রতি ভারতের বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শংকর বলেছেন ভারত ও ভুটানের মধ্যে রেল নেটওয়ার্ক তৈরি নিয়ে আলোচনা চলছে, আসাম সীমান্তে কোকরাঝর থেকে ভুটানের গেলেফু পর্যন্ত রেললাইন নির্মান উভয়দেশের বানিজ্য ও পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটাবে। এই রেলওয়ে প্রজেক্টটি উভয় দেশের মধ্যে পন্য রপ্তানি আরও সহজ করার পাশপাশি,  পারস্পরিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ২০১৮ সালে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে সর্বপ্রথম এই প্রজেক্টের ব্যাপারে আলোচনা হয়। ২০০৫ সালে ভারতের সাথে ভুটানের একটি মৌ চুক্তি হয়েছিল ভারত থেকে ভুটান পর্যন্ত অন্তত পাঁচটি রেললাইন তৈরির জন্য। পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীও বেশ কীছু পথে রেললাইন তৈরির কথা জানায় সরকারকে যাতে শিলিগুড়ি করিডরের নিরাপত্তা আরও মজবুত করা যায়। 

গ্যাংটক থেকে থিম্পু, বানারহাট থেকে সাম্টসি, হাসিমারা থেকে ফুন্টসোলিং, কোকরাঝর থেকে গেলেফু পাঠসালা থেকে নাগলাম, রাংলা থেকে জোংখার এবং তাওয়াং থেকে ইয়ংফুল্লা পর্যন্ত রেললাইন নির্মানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ২০০৫ সালে কিন্তু এখনও এসব প্রজেক্টে কাজ হয়নি। তবে কোকরাঝর থেকে জেলেফু পর্যন্ত রেললাইন দুই বছরের মধ্যে সম্পূর্ন হয়ে যাবে। স্ট্রাটেজিক ভাবে এই রেল প্রজেক্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন কারন গেলেফু থেকে শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন নেকের দূরত্ব মাত্র ২৮১ কিলোমিটার। সেজন্য চিকেন নেকের আশেপাশে যত বেশী পরিকাঠামো উন্নয়ন হবে তত বেশী সুবিধা হবে ভারতের। এই রেলওয়ে লাইন নির্মানের ফলে ভবিষ্যতে ডোকলামের মতো ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনী চীনের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আরও সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। তবে গেলেফু পর্যন্ত রেলপথ নির্মানে কিছু সমস্যা রয়েছে যেমন ভুটান একটি পার্বত্যঞ্চল কিন্ত গেলেফু এলাকা প্রায় সমতল যার জন্য এখানে তাপমাত্রা অনেক বেশী ভুটানের বাকী সব অঞ্চলের থেকে। গেলেফুতে কয়েকমাস ধরে বর্ষাকালে ভুটানের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বৃষ্টিপাত হয় যার জন্য এখানে প্রতিবছর বন্যা হয়। গেলেফুর আশেপাশে বনাঞ্চল রয়েছে এবং এখানে হাতির যাতায়াতের জন্য একটু নির্দিষ্ট পথও রয়েছে। ভুটান থেকে ভারত পর্যন্ত হাতি যাতায়াতের একটি আলাদা পথও রয়েছে। এসব কারনে গেলেফু পর্যন্ত রেলপথ নির্মানে একটু সমস্যা তৈরি হতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে চীন, দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে উত্তর ভুটানের বেশ কীছু এলাকা যেমন জাকার্লাং, পাসামলাং এবং ডোকলাম উপত্যকার কাছে কীছু অংশ চীন জোর করে দখল করে রেখেছে। যার জন্য গেলেফু পর্যন্ত রেলপথ নির্মানের বিরুদ্ধে চীন ভুটানের উপর কুটনৈতিক ভাবে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার গেলেফু স্মার্ট শহর ও রেলপথ প্রজেক্ট সম্পূর্ন করতে বদ্ধ পরিকর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *