নেহেরু কতোটা দূরদর্শী মানুষ ছিলেন?
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ১৩২তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে ১৪ই নভেম্বর। তবে, ন্যায্য যথেষ্ট কি তাকে দিতে পারলাম আমরা তার জন্মবার্ষিকীতে? জাতি গঠনে, ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের বীজ রোপণ করা থেকে শুরু করে বিশ্বে পরিষদে সকলের সামনে সম্মানের সাথে নব্য প্রতিষ্ঠিত ভারতবর্ষের কণ্ঠস্বরকে জোর গলায় তুলে ধরা – অবদান নেহাত কম ছিলো না তার। তার এই পদেক্ষেপগুলি ভারত সন্তানদের উত্তরাধিকারকেই স্বীকৃতি দিয়েছে। আবার তার নেতৃত্বে ত্রুটিও অবশ্য ছিলো বেশ কিছু। নেতৃত্বের এই ত্রুটিগুলি ভারতে বেশকিছু স্থায়ী এবং নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কাশ্মীর ইস্যুই যেমন এর মধ্যে একটি। এছাড়া, ১৯৬২ সালেও তিনি চীনের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে খুব বড়সড় ভুল করেছিলেন। কিন্তু,ভুলত্রুটি গুলি নিয়ে আলোচনার সাথে সাথে তার নেতৃত্ব, দেশপ্রেম নিয়েও যথাযথ আলোচনা করা প্রয়োজন আমাদের। তিনি যে সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন বেশ খানিকটা তা অনস্বীকার্য। আমাদের সতর্ক থাকা উচিত যে ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস নিয়ে আলোচনার সময় আমরা যেনো শুধু নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে একটা গোটা ঘটনার এক চতুর্থাংশ না বর্ণনা করে ফেলি। বরং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কোন পরিস্থিতিতে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো সেই কথাগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা খুবই প্রয়োজনীয়।
বর্তমানে জহরলাল নেহেরুর সিদ্ধান্তের ভুল ত্রুটি বিশ্লেষণ করতে করতে কখনো কখনো আমরা একেবারে মাথা থেকে বের করে দিই যে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারতবর্ষ ঠিক কি রকম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলো! ভারতের ভাগ্য ছিলো অনিশ্চিত। একটি দেশ ২০০ বছর পর পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে মুক্ত হতে চলেছিল অবশেষে; অথচ, তার মধ্যেই দেশ ভাগ হয়ে যায় ধর্মের ভিত্তিতে দুটি ভাগে। নতুন করে সারা দেশের সীমান্ত জুড়ে বসানো হয় বেড়াজাল। দাঙ্গা, হিংসা, বর্বরতায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিলো জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ। সেগুলো সামলানো, সদ্য প্রতিষ্ঠিত সরকারের কাছে এক বড়ো পরীক্ষা তো ছিলোই সেই সঙ্গে ছিলো ৫০০টির ও বেশি দেশীয় রাজ্যর মহারাজার বুঝিয়ে একত্রিত করার এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। কারণ, চাইলেই তারা সেই সময় কিন্তু নিজস্ব এক দেশের দাবি জানতেই পারতেন।
তারপরেই শুরু হয় পাকিস্তানের সাথে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ওই প্রতিকূল পরিস্থিতে জম্মু ও কাশ্মীর এক প্রকার ভাবে হাত ছাড়াই হয়ে যাচ্ছিলো ভারতের। যুদ্ধোত্তর বিশ্বেও দেখা দিয়েছিলো এক অস্থিরতা। রাশিয়া ও আমেরিকা এই দুই মহাশক্তিকে কেন্দ্র করে সমগ্র বিশ্ব বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো দুটি শিবিরে। নিত্যদিন পারমাণবিক আক্রমণের ধমকির সাথে সাথে দীর্ঘস্থায়ী এক সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো বিশ্ব। দুই শিবির থেকে সমান দূরত্ব বজায় রেখে যুদ্ধ থেকে দেশকে রক্ষা করা হয় উঠেছিলো সেই সময় এক বড়ো চ্যালেঞ্জ।
নেহেরু একজন দূরদর্শী মানুষ ছিলেন
জটিল এবং বিপজ্জনক এই ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে ভারতকে বের করে এনে ভারতের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জহরলাল নেহেরু। বিশ্বের অন্যান্য সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলি সেই সময় যেখানে নেতৃত্বহীনতায় কোনঠাসা হয়ে রাশিয়া বা আমেরিকা কোনো এক শিবিরে যোগ দেওয়ার তোরজোর শুরু করে তখন ভারত সহ বাকি দেশগুলিকে আশার আলো দেখিয়েছিলেন নেহেরুই। নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। আর নিজের এই অন্তর্নিহিত নীতি তিনি তৎকালীন আন্তর্জাতিক ল্যান্ডস্কেপের সাথে খুব সুন্দরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করেই নির্ধারণ করেছিলেন এদেশের বিদেশনীতি। পারমাণবিক যুগের সূচনা যে জাতীয় সীমানাকে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে তা বাকি রাজনৈতিক নেতাদের তুলনায় অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। তিনি জানতেন মানবতার মুখোমুখি হওয়া বেশিরভাগ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে কেবলমাত্র আন্তর্জাতিকতার চেতনা এবং বহুপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমেই। ঠিক এই কারণেই সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত এক দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারত সেই সময় জাতিসংঘে মানবাধিকার নিয়ে আলোচনায় সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিল।
ভারত উপনিবেশিকরণের সংগ্রাম, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। নেহেরু প্রবর্তিত ‘এক বিশ্ব’ ধারণা বিশ্বব্যাপী বহু দেশকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জাতীয় এবং আঞ্চলিক সীমানা অতিক্রম করে সম্মুখীন হতে হয় যে সব চ্যালেঞ্জের সেগুলো সমাধানের জন্য বিশ্ব সরকারের নেই কোনো বিকল্প – সেই জন্য সকল দেশেরই উচিত তাদের সার্বভৌমত্ব এমন এক প্রতিষ্ঠানের কাছে সমর্পণ করা। আজ এত বছর পর বিশ্বায়নের যুগে তাঁর এই ধারণাগুলিই সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
নেহরুর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ভারতকে আধুনিকতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তার দৃষ্টিভঙ্গিই পরবর্তীকালে ভারতকে পারমাণবিক ও মহাকাশ কর্মসূচি চালু করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির মতো উৎকর্ষ কেন্দ্র স্থাপন, বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের (সিএসআইআর) অধীনে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারগুলির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং বিল্ডিং আপ সহ একটি আধুনিক অর্থনীতির অবকাঠামো তৈরি – তার অবদান ভারতের ইতিহাসে নেহাত কম নয়। ভারতের জনগণের মন থেকে যাবতীয় কুসস্কার মুছে বিজ্ঞান মনস্কতা গড়ে তোলার গুরুত্বের ওপর প্রবল ভাবে জোর দেন। কিন্তু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সেই সময় প্রবল ভাবে অবহেলিত হয় যার ফলে জাতি হিসাবে এখনো বেশ কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে আমাদের মধ্যে।
একজন সত্যিকারের ভারতীয়
বর্তমানে অনেককেই বলতে শোনা যায় যে নেহেরু যতটা না ভারতীয় ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন ইংরেজ। কিন্তু, নেহেরু নিয়ে একটু খোঁজ খবর করলেই দেখা যায় তার ভারত নিয়ে যা দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো তাতে ভারতীয় ইতিহাস, প্রাচীন দার্শনিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক স্রোত সম্পর্কে তার উপলব্ধি সাধারণের চেয়ে ছিলো বেশ গভীর। প্রাচীন ভারতের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতি বরাবরই আকর্ষণ করেছে তাকে। তিনি ভারতের শিল্প ও কারুশিল্পের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এবং জনগণের নান্দনিক সংবেদনশীলতায় মুগ্ধ হয়ে তাদের পুনরুজ্জীবনের প্রচার করেছিলেন।
ভারতের মহান বৈচিত্র্য, বহু-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বরাবরই উদযাপন করেছেন তিনি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ভারতের জাতীয় ঐক্যবোধের সাথে তার বহুসাংস্কৃতিক বোধের সমন্বয় করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি। এই জন্যই ভারতীয় সংবিধান ব্যক্তিবিশেষের পরিচয় দমন না করে বরং সকলকে ব্যক্তিগত অধিকার এবং স্বাধীনতার ভিত্তিতে এক সমান নাগরিকত্ব প্রদান করতে চায়। দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার কেন্দ্রবিন্দুতেও রয়েছে ঠিক এই ধারণাটিই। রাষ্ট্র সরাসরি কোনো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বা অনুশীলনের সাথে সম্পর্ক এড়িয়ে চলে।
নেহেরুর মতে ভারতের মতো একটি বহু-সাংস্কৃতিক ও বহু-ধর্মীয় দেশে সকল নাগরিককে সমান মর্যাদা দিতে হলে রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ হতেই হবে। রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ না হলে ভারতের মতো বহু ধর্মীয় ও বহু জাতীয় দেশে সাম্প্রদায়িকতা যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি। এইজন্যেই বারংবার ধর্মনিরপেক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছিলেন তিনি। রাষ্ট্র ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে সরে গেলে তার পরিণতি কতটা কুৎসিত হতে পারে তা আজ দেখতে পাচ্ছি আমরা। হিন্দু- মুসলিম বা অন্য কোন ধর্মের ওপর নির্ভরশীল হয়ে কখনোই যে জাতীয় ঐক্য যে গড়ে তোলা যায় না এই শিক্ষা নেহেরুর কাছ থেকেই নিতে হবে আমাদের।
নেহেরু মনে প্রাণে একজন আধুনিক নেতা হলেও ভারতের সভ্যতাগত ঐতিহ্যে পুরোপুরি নিমজ্জিত ছিলেন তিনি। ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া নামক বইতে, তিনি তার প্রিয় দেশের প্রতি অপকট শ্রদ্ধা নিবেদন করার সাথে সাথে দেশের সভ্যতাগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তার নিজস্ব কিছু গভীর উপলব্ধির কথাও তুলে ধরেছেন। তার মতে যাবতীয় দারিদ্র্য ও অবক্ষয়ের মধ্যেও ভারতবর্ষ এখনো তার পুরোনো আভিজাত্য ও মহত্ত্ব অটুট রেখেছে। প্রাচীন সেই ঐতিহ্য বর্তমান দুর্দশার ভরে কিছুটা ভারাক্রান্ত। দেশ মাতার চোখের পাতা কিছুটা ক্লান্ত! কিন্তু দেশের সৌন্দর্য, চিন্তা,সূক্ষ্ম আবেগ ও আত্মার মহিমার আভাস মেলে এখনো।
নেহেরুর মতো এতটা সঠিকভাবে ভারতের হৃদয় বুঝতে পেরেছেন এবং সারা জীবন দেশের সেবায় নিয়োজিত করেছেন এমন ভারতীয় নেতা দেশের ইতিহাসে রয়েছে সত্যিই খুব কম। ভারত ও ভারতবাসীর চেতনা এবং জাতীয়তাবাদকে রূপ দিতে এই সমস্ত ব্যাপারগুলিই সামনে আসা প্রয়োজন। শুধু একপেশে কিছু ধর্মান্ধ মানুষের মিথ্যে দিয়ে সাজানো সংস্করণটি কোনোভাবেই আমাদের সামনে নেহেরু নিয়ে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারে না।