কাশ্মীর নিয়ে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে এতো অশান্তির পেছনে দায়ী কে জানেন?
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে দু’বার যুদ্ধ হয়েছে। এখন উভয়েই পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত হয়েছে, এবং পুলওয়ামার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারও তারা যুদ্ধংদেহি অবস্থানে বিরাজ করছিল।
কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে ভারত আর পাকিস্তানের এই সংঘাতের কারণ কি?
ইতিহাস বলছে, ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান আর ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার আগে থেকেই কাশ্মীর নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয়েছিল।
‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স এ্যাক্ট’ নামে ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল, কাশ্মীর তার ইচ্ছে অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তান – যে কোনো রাষ্ট্রেই যোগ দিতে পারবে।
কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে অথবা ভারতের সাথে যোগ দিতে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের পাশতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলোর আক্রমণের মুখে হরি সিং ভারতে যোগ দেওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, এবং ভারতের সামরিক সহায়তা পান। পরিণামে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ – যা চলেছিল প্রায় দু’বছর ধরে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ১৯৪৮ সালে ভারত কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। জাতিসংঘের ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে কাশ্মীরে গণভোট, পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার, এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনতে আহ্বান জানানো হয়।
কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় ১৯৪৮ সালে, তবে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মীর কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়। অন্যদিকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে চীন কাশ্মীরের আকসাই-চিন অংশটি দখল করে, আর তার পরের বছর পাকিস্তান – কাশ্মীরের ট্রান্স-কারাকোরাম অঞ্চলটি চীনের হাতে ছেড়ে দেয়।
সেই থেকে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান, ভারত ও চীন – এই তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে। দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয় ১৯৬৫ সালে, এর পর আরেকটি যুদ্ধবিরতি চু্ক্তি হয়। এরপর ১৯৭১-এর তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭২-এর সিমলা চুক্তির মধ্যে দিয়ে বর্তমানের ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বা নিয়ন্ত্রণ রেখা চূড়ান্ত রূপ পায়।
১৯৮৪ সালে ভারত সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ দখল করে – যা নিয়ন্ত্রণরেখা দিয়ে চিহ্নিত নয়।
তা ছাড়া ১৯৯৯ সালে ভারতীয় বাহিনী আরেকটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তিক্ত লড়াইয়ে জড়ায়, পাকিস্তান-সমর্থিত বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে। ১৯৯৯-এর সেই ‘কারগিল সংকটের’ আগেই দু দেশ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়।
ভারত-শাসিত কাশ্মীরে এত সংঘাত-সহিংসতা কেন?
কাশ্মীরের এ অংশের অনেকেই চাইত না যে এলাকাটি ভারতের শাসনে থাকুক। তারা চায় – হয় পূর্ণ স্বাধীনতা, অথবা পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তি। ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি মুসলিম। এটিই হচ্ছে ভারতের একমাত্র রাজ্য যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এখানে বেকারত্বের হার অত্যন্ত উঁচু, তা ছাড়া রাস্তায় বিক্ষোভ এবং বিদ্রোহীদের দমনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর নীতি পরিস্থিতি। কাশ্মীরে বিদ্রোহী তৎপরতা বড় আকারে শুরু হয় ১৯৮৭ সালে বিতর্কিত স্থানীয় নির্বাচনের পর জেকেএলএফ নামে সংগঠনের উত্থানের মধ্যে দিয়ে।
ভারত অভিযোগ করে, পাকিস্তান সীমান্তের ওপার থেকে যোদ্ধাদের পাঠাচ্ছে – তবে পাকিস্তান তা অস্বীকার করে। এই রাজ্যে ১৯৮৯ সালের পর থেকে সহিংস বিদ্রোহ নানা উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে গেছে। তবে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ২২ বছর বয়স্ক জঙ্গী নেতা বুরহান ওয়ানি নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে এক লড়াইয়ে নিহত হওয়ার পর থেকে পুরো উপত্যকায় ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
বুরহান ওয়ানি সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন এবং এতে তার প্রকাশ করা বিভিন্ন ভিডিও তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। মনে করা হয়, এ অঞ্চলে জঙ্গী তৎপরতা পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
রাজধানী শ্রীনগরের ২৫ মাইল দূরের ট্রাল শহরে বুরহান ওয়ানির শেষকৃত্যে সমাগম হয়েছিল হাজার হাজার লোকের। জানাজার পর শুরু হয় সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষ, কয়েকদিনব্যাপী সহিংসতায় নিহত হয় ৩০ জনেরও বেশি বেসামরিক লোক। এর পর থেকেই রাজ্যটিতে বিক্ষিপ্ত সহিংসতা চলছে। ২০১৮ সালে বেসামরিক লোক, নিরাপত্তা বাহিনী এবং জঙ্গী মিলে মোট নিহত হয় ৫০০ জনেরও বেশি – যা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
কাশ্মীরে শান্তির আশা দেখা দিয়েও মিলিয়ে গেছে বার বার:
কাশ্মীর এখন বিভক্ত লাইন অব কন্ট্রোল (ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখা) বরাবর। এ ছাড়াও আকসাই-চিন এবং সিয়াচেন হিমবাহের উত্তরের আরেকটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে চীন। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বহু রক্তপাতের পর ২০০৩ সালে দু দেশ একটি যু্দ্ধবিরতি চুক্তি করেছিল।
পাকিস্তান পরে কাশ্মীরের বিদ্রোহীদের অর্থায়ন বন্ধ করার অঙ্গীকার করে, আর ভারত প্রস্তাব করে – বিদ্রোহীরা জঙ্গী তৎপরতা বন্ধ করলে তাদের ক্ষমাও করে দেয়া হবে। এর পর ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তারা পাকিস্তানের ব্যাপারে কঠোর নীতি নেওয়ার অঙ্গীকার করে, তবে শান্তি আলোচনার ব্যাপারেও আগ্রহ দেখায়।
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলেন অতিথি হিসেবে। কিন্ত এর এক বছর পরই পাঞ্জাবের পাঠানকোটে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ হয় – যার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করে ভারত। মি. মোদি ইসলামাবাদে তার নির্ধারিত সফর বাতিল করে দেন। এর পর থেকে দু’দেশের মধ্যে আলোচনায় আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তাহলে কাশ্মীর কি আগের অবস্থাতেই ফিরে গেল?
২০১৮ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীর রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার – যাতে বিজেপিও অংশীদার ছিল। কিন্তু জুন মাসে বিজেপি জোট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়, এবং তার পর থেকেই রাজ্যটি দিল্লির প্রত্যক্ষ শাসনের অধীনে। এতে সেখানে ক্ষোভ আরও বেড়েছে।
ভারতশাসিত কাশ্মীরে ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত একাধিক সামরিক ঘাঁটির ওপর হামলা হয়েছে। সবশেষে পুলওয়ামায় এক জঙ্গী আক্রমণে ৪০ জনেরও বেশি আধাসামরিক পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে আবারও তৈরি হয়েছে তীব্র উত্তেজনা।
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছিলেন, ভারত যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয় – তাহলে পাকিস্তানও পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। ভারত বলছিল, পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে সব চেষ্টাই তারা করবে।
মনে হচ্ছে, দু দেশের সম্পর্ক উন্নত হবার যেটুকু আশা অবশিষ্ট ছিল – পুলওয়ামার আক্রমণের মধ্যে দিয়ে সেটাও হয়তো শেষ হয়ে গেছে। তবে কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার তুলে নেওয়ার পর সেখানকার উন্নতি চোখে পরার মতো। পাশাপাশি সেখানকার মানুষদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাব ধারা গড়ে উঠছে আসতে আসতে।