ফিচার আর্টিকেল

ভারতীয় রাজা কম্বোডিয়া শাসন করেছিলেন!

বলা হয় পর্তুগীজ অভিযাত্রী ভাস্কো দা গামা এবং ইটালির অভিযাত্রী ও নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস এমন দুজন ব্যক্তি যাদের সমুদ্র যাত্রার প্রভাব পুরো বিশ্বে পড়েছিল। ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিল, যে আমেরিকা এখন বিশ্বে সুপার পাওয়ার এবং ভাস্কো দা গামা অতুলনীয় ঐশ্বর্যে ভরপুর সোনার পাখি ভারতবর্ষের রাস্তা ইউরোপীয়ান দেশ গুলোকে দেখিয়েছিল। তবে ভাস্কো দা গামা এবং ক্রিস্টোফার কলম্বাস ছাড়াও এরকম বহু অভিযাত্রী আছে যাদের খোঁজ বিশ্বের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। চাইনিজ অভিযাত্রী হিউয়েন সাং সপ্তম শতকে ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার চীনে করেছিলেন। হিউয়েন সাং সতেরো বছর ভারতে ছিলেন। পর্তুগীজ অভিযাত্রী ফার্ডিনান্ড ম্যাগেলানও তার যাত্রার মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্র তৈরি করে ছিল। ঠিক এমনই ঘটনা রয়েছে ভারতকে কেন্দ্র করেও। ভারতে জন্মানো এক ব্যবসায়ী কালক্রমে আজকের কম্বোডিয়ার প্রথম রাজা হয়ে উঠেছিল। এই ঘটনায় কম্বোডিয়ায় হিন্দু ধর্ম প্রসিদ্ধ হয়েছিল। ঘটনাটা রাজা কাউন্দিন্য প্রথমকে কেন্দ্র করে।

রাজা কাউন্দিন্য প্রথমকে কিছু কিছু সাহিত্যে হানতিয়ান এবং প্রিয়েচ থং বলা হয়েছে। বলা হয়েছে রাজা কাউন্দিন্য প্রথম, তার স্ত্রী সোমার সাথে প্রথম শতক সিইতে ফুনান সাম্রাজ্য শাসন করতো। পুরানত চাইনিজ গ্রন্থ অনুসারে ফুনান সাম্রাজ্য দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় মেকং নদীর তীরে অবস্থিত যা আজকের কম্বোডিয়া দেশ। ফুনানের রাজধানী ছিল ব্যাধপুরা। রাজা কাউন্দিন্য প্রথম ফুনানের দ্বিতীয় শাসক ছিল। ফুনানের প্রথম শাসক ছিল রাজা কাউন্দিন্য প্রথমের স্ত্রী ফুনানের রানি সোমা তাঁকে লিউয়ে বা নিয়াং নিয়াকি নামেও ডাকা হত। বলা হয় কাউন্দিন্য প্রথমের জন্ম হয়েছি ভারতবর্ষের পূর্ব উপকূলের কলিঙ্গ রাজ্যে এক সাধারন ব্রাহ্মন পরিবারে। অতীতের কলিঙ্গই বর্তমানে ওড়িশা। তবে রাজা কাউন্দিন্যর জন্ম এবং নাম নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। কিছু ঐতিহাসিকদের মতে কাউন্দিন্য কোনও নাম নয় বরং এটি ব্রাহ্মনদের একটি গোত্র। ঐতিহাসিকদের ধারনা কাউন্দিন্য গোত্রের ব্রাহ্মনরা অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা অথবা ওড়িশায় বসবাস করতো। সঞ্জীব সান্যালের লেখা দি ওশেন অফ চূর্ন: হাউ দি ইন্ডিয়ান ওশেন সেপড হিউম্যান হিস্টরি বইয়েও বলা হয়েছে কাউন্দিন্য কোনও নির্দিষ্ট নাম নয় বরং এটি একটি গোত্র। বেশ কিছু ঐতিহাসিকদের মতে কাউন্দিন্য গোত্রের ব্রাহ্মনরা ওড়িশা রাজ্যের গঞ্জামের মহেন্দ্রগিরি এলাকায় বাস করতো। পিতৃভক্ত রাজবংশের রাজা নন্দপ্রভঞ্জনবর্মনের রাগোলু শিলালিপির তাম্র ফলক থেকেই এর প্রমান পাওয়া যায়। যেহেতু রাজা কাউন্দিন্যর জন্ম হয়েছিল পূর্ব উপকূলের কলিঙ্গ রাজ্যে তাই ছোট বয়স থেকে কাউন্দিন্য ব্যবসায়ীদের দেখে বড় হয়েছে কারন সেসময় ভারতের পূর্ব উপকূল আন্তজার্তিক বানিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। 

মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত ঐতিহাসিক টলেমি তার বইয়ে প্রাচীন ভারতে কলিঙ্গের গঞ্জামের কাছে পালুর বন্দরের কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে বহু জাহাজ এসে থামতো। এই সময়ে বিশ্বের বহু দেশের সাথে বানিজ্য হত ভারতের, বিশেষ করে মিশর সেসময় রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল যার কারনে রোমান সাম্রাজ্যের সাথে ভারতের বানিজ্য সবচেয়ে বেশী হত। সমুদ্র পথে এসব বানিজ্য দেখে কাউন্দিন্য দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার অঞ্চল গুলোর সাথে বানিজ্য করবার কথা চিন্তা করে। সাধারন ব্রাহ্মন পরিবারের ছেলে হলেও কিছু বছরের মধ্যে তার পরিবারের আর্থিক উন্নতি হয় অনেক যার কারনে তার পরিবার পূ্র্ব উপকূলের এক সমৃদ্ধশালী ব্যাবসায়ী পরিবার হয়ে ওঠে এবং তাঁর পরিবারের কাছে ওই এলাকার সবচেয়ে বেশী বানিজ্যিক জাহাজ ছিল। কাউন্দিন্য শ্রীলঙ্কা হয়ে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু কাউন্দিন্য জানতোনা বঙ্গোপসাগর হয়ে দক্ষিন পূর্ব এশিয়া যেতে সমুদ্রপথ খুবই বিপদজনক। কাউন্দিন্য যেই শ্রীলঙ্কা হয়ে থাইল্যান্ডের খাঁড়িতে প্রবেশ করে তখনই হঠাৎই তার জাহাজে আক্রমন করে কম্বোডিয়ার নাগা গোষ্ঠীর সামুদ্রিক জলদস্যু জাহাজ যাদের নেত্রী ছিল সোমা। কাউন্দিন্যর জাহাজ জলদস্যুদের প্রথম আক্রমন কোনও রকমে প্রতিরোধ করে জলদস্যুদের দূরে সরিয়ে দেয়। তবে দ্বিতীয় দফায় আবারও জলদস্যুদের আক্রমনের সম্ভবনা ছিল। কিন্ত সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় ছিল কাউন্দিন্যর জাহাজ জলদস্যুদের আক্রমনে প্রায় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে কম্বোডিয়ার নাগা গোষ্ঠীর এলাকাতেই জাহাজ থামাতে হয় কাউন্দিন্যকে জাহাজ ঠিক করবার জন্য। সেখানে আবারও লড়াই হয় কাউন্দিন্য এবং রানী সোমার লোকেদের মধ্যে। আবারও রানী সোমার সেনা হেরে যায়, এরপর রানী সোমা বিবাহের প্রস্তাব দেয় কাউন্দিন্যকে এবং কাউন্দিন্য তা স্বীকার করে। এভাবেই কম্বোডিয়ার প্রথম ভারতীয় রাজা হয়ে ওঠে কাউন্দিন্য প্রথম। 

রাজা কাউন্দিন্য প্রথম ও রানী সোমার ফুনান সাম্রাজ্য প্রথম শতক থেকে ষষ্ট শতক অবধি প্রায় ছয়শো বছর স্থায়ী ছিল। এই সময়ে কম্বোডিয়ায় হিন্দু ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং কম্বোডিয়ায় প্রচুর বিষ্ণু মন্দির ও শিব মন্দির তৈরি করা হয়। যার ফলে কম্বোডিয়ার স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে হিন্দু ধর্ম মিশে যায়৷ যার ফলস্বরূপ আজও কম্বোডিয়ায় আঙ্কোর ওয়াট নামক অসাধারন মন্দির এবং রামায়নের উপর তৈরি রিমকার শ্যাডো পাপেট দেখা যায়। আঙ্কোর ওয়াট শব্দের অর্থ মন্দিরের শহর, দ্বাদশ শতকে রাজা সূর্যবর্মনের ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে আঙ্কোর ওয়াটকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় স্থাপনার কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে।

ভারতের একজন সাধারন ব্যবসায়ী হওয়া সত্বেও কাউন্দিন্যকে কেন নাগা গোষ্ঠীর প্রধান তার মেয়ের সাথে বিয়ে দিল? এবং ফুনান সাম্রাজ্যের রাজা করলো সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন ধারনা পাওয়া যায়না। বলা হয় প্রথম শতকের আগে একটি ছোট দেশ হওয়া সত্বেও কম্বোডিয়া বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং প্রত্যেক রাজ্যের আলাদা আলাদা শাসক ও সেনা থাকায় রাজনৈতিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিলনা কম্বোডিয়া। অপরদিকে ভারতেও বিভিন্ন রাজ্য ও ভিন্ন ভিন্ন শাসক থাকলেও ভারতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল এবং ভারত বানিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল। যার কারনে কম্বোডিয়ার নাগা গোষ্ঠীর রাজা তার মেয়ের সাথে কাউন্দিন্যর বিবাহ দেয়। এছাড়া নাগা গোষ্ঠী ও হিন্দু ধর্মের অনেক মিল আছে। হিন্দুদের মতোই নাগারা বিশ্বাস করতো নদী, পাহাড়, প্রকৃতি সবের মধ্যেই দৈবিক শক্তির অস্তিত্ব রয়েছে। তাছাড়া হিন্দু ধর্মের মতোই নাগারা সাপের পূজো করে। 

হিন্দু ধর্মেও ভগবান শিবের গলায় বাসুকী নাগ এবং ভগবান বিষ্ণুকে শেষ নাগের উপর অনন্ত শয্যায় শায়িত দেখা যায়। আজও কম্বোডিয়াতে রাজা কাউন্দিন্য প্রথম ও রানী সোমার প্রেম কাহিনীকে আদর্শ মানা হয়। এখনও কম্বোডিয়াতে অনেক বিয়েতে বরকে রাজা কাউন্দিন্য প্রথম এবং বৌকে রানী সোমার মতোন পোষাকে সাজানো হয়। কম্বোডিয়াতে রানী সোমা ও রাজা কাউন্দিন্য প্রথমের ২১ মিটার লম্বা একটি মূর্তি রয়েছে যা দেখতে হাজার হাজার মানুষ আসে প্রতিদিন। তবে কম্বোডিয়াতে রানী সোমা এবং রাজা কাউন্দিন্য প্রথম নিয়াং নিয়াকি এবং প্রিয়েচ থং নামেই বেশী পরিচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *