ফিচার আর্টিকেল

ভাস্কো ডা গামার কারনেই কী বহু ভারতবাসী তামাকে আসক্ত হয়ে পড়েছে?

ভারতের সবচেয়ে সুন্দর ও সুখী রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে গোয়ার নাম। অসাধারন এই সুন্দর শহর একটা সময় পর্তুগীজদের উপনিবেশ ছিল। পর্তুগীজরাই প্রথম কোনও ইউরোপীয়ান শক্তি যারা ভারতে এসেছিল এবং ভারত থেকে সবচেয়ে শেষে পর্তুগীজরাই গেছিল। ভারতে পর্তুগীজ সাম্রাজ্য স্থাপনের নেপথ্যে ছিল পর্তুগীজ অভিযাত্রী ভাস্কো ডা গামা যিনি ১৪৯৮ সালের ২০ মে প্রথম ইউরোপীয়ান অভিযাত্রী হিসাবে কালিকটে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন৷ ইউরোপ থেকে ভারতে আসার সামুদ্রিক পথ ভাস্কো ডা গামাই আবিষ্কার করেছিল। তাকেই অনুসরন করে একে একে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ডাচ বা নেদারল্যান্ডসের মতোন ইউরোপীয়ান শক্তিগুলো ভারতে এসেছিল। ইউরোপীয়ান অভিযাত্রী ছাড়াও ভাস্কো ডা গামকে অন্য আর এক কারনের জন্য গোটা বিশ্ব মনে রাখে তা হল তামাক। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় আশি লাখ মানুষের মৃত্যু হয় তামাক সেবনের কারনে। তামাকের নেশায় কত পরিবার শেষ হয়ে গেছে তার সঠিক কোনও হিসাব নেই। বিশ্বের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমান জনসংখ্যা এই তামাকের নেশায় আসক্ত, সিগারেটের মধ্যেও ক্ষতিকর নিকোটিন রয়েছে। আজ বিশ্বে তামাকের ব্যাপক প্রচলন, এত মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী একমাত্র ইউরোপীয়ান শক্তিগুলোই তারা বিশ্বে তামাকের প্রচলন করেছিলো। ভারতে তামাক আমদানির জন্য ভাস্কো ডা গামাকে দায়ী করা হয়। 

১৪৮০ এর সময়ে পর্তুগালের রাজার ক্ষমতা ক্রমশ কমতে শুরু করে কারন পর্তুগালের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বহুকাল ধরেই প্রাচীন রেশম পথের মাধ্যমে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে বানিজ্য চলতো। কিন্ত অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের কারনে রেশমপথ দিয়ে বানিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। যার কারনে পর্তুগালের মতো ইউরোপীয়ান দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরকম পরিস্থিতিতে পর্তুগীজ নাবিকরা ঠিক করে যেভাবেই হোক বিকল্প পথে অর্থাৎ সমুদ্রপথে ভারতে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু সমুদ্রপথে ভারত পৌঁছানো এতটা সহজ ছিলনা। পর্তুগীজ নাবিকরা ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে বারবার দক্ষিন আফ্রিকার কাছে কেপ অফ গুড হোপ পর্যন্ত এসে ফিরে যেত কারন এর আগের রাস্তা তারা জানতোনা। এরকম সময়ে ভাস্কো ডা গামা নামে এক পর্তুগীজ যুবক রাজাকে জানায় সে ভারতে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে বের করবে। ভাস্কো ডা গামা ১৪৯৭ সালে জাহাজ নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এইসময় থেকেই স্টক এক্সচেঞ্জ শুরু হয়েছিল, সেসময় জাহাজের উপর পয়সা লাগাতো মানুষ। কোনও জাহাজ অন্য কোনও নতুন দেশ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে রওনা হলে যাবতীয় খরচ ব্যবসায়ী, সাধারন মানুষজন দিত, এর বদলে জাহাজের নাবিক তাদের একটি কাগজ দিত যাতে বলা থাকতো নতুন দেশ আবিষ্কার করে ফিরে এলে এর কয়েকগুন টাকা তারা ফেরত পাবে। তবে এই স্টক এক্সচেঞ্জ পুরো ঝুকিপূর্ন ছিল কারন জাহাজ ফিরে না এলে সমস্ত অর্থ ডুবে যেত কিন্তু তবুও মানুষজন বিনিয়োগ করতো। 

ইতিহাসে ভাস্কো ডা গামা, ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মতোন নাবিক, অভিযাত্রীদের ব্যাপক সম্মান দেখানো হয়েছে কিন্তু বাস্তাবে এরা হত্যাকারী ছিল, যেখানে যেত সেখানেই হত্যাকাণ্ড করতো। যেমন ছয়মাস যাত্রার পর আফ্রিকার মোজাম্বিক দেশে পৌঁছায় ভাস্কো ডা গামা কিন্তু সেখানকার রাজা তাদের অভ্যর্থনা না জানানোয়, মোজাম্বিক থেকে বেরিয়ে আসার সময় সেখানে হামলা করে ভাস্কো ডা গামা। ১৪৯৮ সালে কেরল উপকূলে পৌঁছায় ভাস্কো ডা গামা, সেসময় কেরলের রাজা ছিল জামোরিন। ভাস্কো ডা গামা জামোরিমের থেকে কেরলে ব্যবসার অনুমতি পায় কিন্তু পর্তুগীজদের লাভ তেমন হয়নি কারন সেসময় কেরলে আরব ব্যবসায়ীদের প্রভাব বেশী ছিল। বাধ্য হয়ে ফিরে যায় ভাস্কো ডা গামা কিন্তু ছয়মাস পর তিনি আবারও ফিরে আসেন পরিপূর্ন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে। ১৫০২ সালে কালিকটের যুদ্ধে পর্তুগাল জিতে যায়, একে একে গোয়া ও দিউয়ের যুদ্ধেও পর্তুগীজরা জিতে যায়। এভাবে ১৯৩০ সাল আসতে আসতে ভারতের পশ্চিমে পর্তুগীজ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল এবং গোয়া পর্তুগীজদের রাজধানী হয়। পর্তুগীজরা কোনও ইউরোপীয়ান দেশকে প্রথমে ভারতে পৌঁছানো রাস্তা জানায়নি। এজন্য ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন আমেরিকা পৌঁছায় তখন আমেরিকাকেই ভুল করে ইন্ডিয়া মনে করেছিল। এই কারনে আমেরিকার আদি অধিবাসীদের নাম হয় রেড ইন্ডিয়ান। এরাই আমেরিকাতে তামাক চাষ করতো। এখান থেকে তামাক ইউরোপে নিয়ে আসা হত এরপর সিগারেট সহ বিভিন্ন তামাকজাত দ্রব্য ইউরোপীয়ানরা এশিয়াতে বিক্রি করতো। 

ইউরোপীয়ানদের কারনে ষোলো শতকে পুরো দক্ষিন পূর্ব এশিয়া তামাকে আসক্ত হয়ে পড়ে। তামাক থেকে ডোপেমাইন নির্গত হয় যা মাথায় রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিতে ক্ষনস্থায়ী সুখের অনুভূতি করায় যাতে মানুষজন আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। একটা সময় মাদক ব্যবসা এতটাই লাভজনক ছিল যে আফিমের কারনে চীন ও ব্রিটিশদের মধ্যে আফিমের যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছিল। ব্রিটিশ, পর্তুগীজ, ডাচরা তামাক ভারতেও রপ্তানি করে সেসময়। তামাক একটি এমন জিনিস যেটা খরার সময়েও চাষ করা সম্ভব হয়। 

ভারতের বর্তমানে রপ্তানিযোগ্য কৃষিজ পন্যের ২ শতাংশই তামাক, প্রায় ৪৫ মিলিয়ন লোক এই বিভাগে কর্মরত রয়েছে। তামাক থেকে প্রতিবছর ভারত সরকার প্রায় ২২,০০০ কোটি টাকা লাভ করে কারন তামাকে ২৮ শতাংশ জিএসটি লাগে। তামাক এতটা লাভজনক ব্যবসা হলেও স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বেশী ক্ষতিকর। তামাক মানুষের ফুসফুস নষ্ট করে দেয়। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ক্যানসার সহ একাধিক রোগের কারন এই তামাক সেবন। হার্ট অ্যাটাকের সম্ভবনা বহুগুন বাড়িয়ে দেয় এই তামাক। তামাক মানুষের জিনকে পরিবর্তন করে দিয়ে ক্ষতিকর রোগ তৈরি করে শরীরে। কিন্তু অতি কম খরচে এটা বাজারে পাওয়া যায় বলে মানুষজন খায়। প্রতিবছর ভারতে তামাকের কারনে ১.২ মিলিয়ন বা ১২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ভারতে ২৭ শতাংশ ক্যানসার রোগ হয় তামাকের কারনেই। প্রতিবছর ভারতে তামাক জনিত কারনে স্বাস্থ্যে খরচ হয় ১.৮২ ট্রিলিয়ন রুপী। ভারতবাসী তামাকের নেশায় পড়েছে ইউরোপীয়ানদের কারনেই। ব্রিটিশরা ভারতে একচ্ছত্র ব্যবসা করেছে তামাকের কারন তাদের কাছে ভারতবাসীর কোনও গুরুত্ব ছিলনা। এজন্য বলা হয় আজ ভারতে তামাকের নেশার জন্য ভাস্কো ডা গামাই দায়ী কারন ভাস্কো ডা গামা ভারতে না এলে ইউরোপীয়ান দেশগুলো কখনও ভারতে আসতে পারতোনা এবং তামাকও ভারতে আসতো না। ভাস্কো ডা গামা নিজেও ভারতে তামাক ব্যবসা করতো। তামাক আজ পুরো বিশ্বে একটা মহামারীর মতোন ছড়িয়ে পড়েছে। তামাক ব্যবসায় প্রচুর লাভ হয় এবং স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোরও লাভ হয় তামাক জনিত রোগের কারনে। যার কারনে কোনও দেশের সরকারই তামাককে নিয়ন্ত্রন করছেনা। তবে বিভিন্ন মেডিক্যাল সংগঠন তামাককে নিয়ন্ত্রনের জন্য এক বিশেষ ধরনের তামাক উৎপাদনের চেষ্টা করছে যার স্বাদ আসল তামাকের মতোই হবে কিন্তু এতে তামাকের ক্ষতিকর নিকোটিন ৯৪ শতাংশ থাকবেনা। গবেষনাগারে প্রস্তত এই তামাক মানুষের ক্ষতি করবেনা বললেই চলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *