ফিচার আর্টিকেল

অ্যাডলফ হিটলারকে হত্যার চেষ্টা করেছিল তারই নাজি সেনার অফিসাররা

বলা হয় বিশ্বের কিছু দেশের বিশেষ কিছু নেতা না থাকলে হয়ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কোনওদিন হতই না। এই সারিতে সবার উপরে রয়েছে জার্মানির নিষ্ঠুর শাসক অ্যাডলফ হিটলার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এক ব্রিটিশ সেনা যদি হিটলারকে না বাঁচাত তাহলে হয়ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুই হতনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বেশ কয়েকবার অ্যাডলফ হিটলারকে হত্যা করবার চেষ্টা করা হয়েছিল যদিও এসব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ২০ জুলাই, ১৯৪৪ সালে হিটলারকে হত্যা করবার সবচেয়ে বড় চেষ্টা করা হয়েছিল যা ইতিহাসে অপারেশন ভ্যালকেরি নামে বিখ্যাত। 

১৯৩৮ সাল থেকেই জার্মান মিলিটারি ও ইনটেলিজেন্সে বেশ কিছু লোক হিটলারের বিরোধী হয়ে পড়ে তারা হিটলারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চাইছিল। কারন হিটলারের বৈদেশিক নীতির কারনে মহাযুদ্ধ আসন্ন ছিল যাতে জার্মানির ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা ছিল বেশী এবং হয়ও তাই। ১৯৩৯ সালে ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি যখন পোল্যান্ড আক্রমন করে তখন ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষনা করে জার্মানির বিরুদ্ধে। এর আগে হিটলার যখন অস্ট্রিয়া, চেকশ্লোভিয়া আক্রমন করে তখন ব্রিটেন ও ফ্রান্স চুপ ছিল কিন্তু জার্মানি যেই পোল্যান্ড আক্রমন করে তখনই ব্রিটেন ও ফ্রান্স বুঝতে পারে জার্মানিকে থামাতে হবে। কিন্তু ততদিনে জার্মানিতে হিটলারের জনপ্রিয়তা এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো অসম্ভব ছিল সেই মূহুর্তে। ১৯৪১ সালে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আক্রমন শুরু করে। জার্মানির সেনাবাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আক্রমন করেছিল উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিন। এই মধ্য ভাগের জার্মান সেনার একজন কর্নেল ট্রেস্কো ১৯৪২ সালে হিটলারকে হত্যা করবার পরিকল্পনা শুরু করে। কর্নেল ট্রেস্কো ফ্রেডরিক অলব্রিচট নামে এক ব্যাক্তিকে খুঁজে বার করে যে হিটলার বিরোধী ছিল। অলব্রিচট বার্লিনে জার্মান সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে রিজার্ভ জার্মান সেনাবাহিনীর সাথে সংযোগ রক্ষা করত। ট্রেস্কো ও অলব্রিচট পরিকল্পনা করে হিটলারকে হত্যা করে রিজার্ভ সেনার সাহায্যে জার্মানিতে বিদ্রোহ করে নাজি সরকারের পতন ঘটানো হবে। এজন্য হিটলারের বিমানে বোম্ব রাখা হয় কিন্তু সঠিক সময়ে বোম্ব ফাটেনি। এর এক সপ্তাহ পর আবারও হিটলারকে হত্যা করবার চেষ্টা করা হয় কিন্তু এবারও হিটলার বেঁচে যায়। কর্নেল ট্রেস্কো জার্মানির তিন বাহিনী ও ইনটেলিজেন্স থেকে হিটলার বিরোধী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে একটি বড় হিটলার বিরোধী জোট তৈরি করে। এই জোটের লক্ষ্য ছিল হিটলারকে হত্যা করা অথবা ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে সন্ধি করা। কারন হিটলারের অত্যাচার বিশেষ করে ইহুদিদের গনহত্যা বহু জার্মান মানুষই সমর্থন করেনি। এই বিরোধী জোটের আরও একটি লক্ষ্য ছিল হিটলারের পতন ঘটিয়ে মিত্র শক্তির কাছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যতটা জার্মান সাম্রাজ্য ছিল পুনরায় জার্মানির সীমানা ততটা রাখার প্রস্তাব দেওয়া। 

১৯৪৩ সাল আসতে আসতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশেষত ইউরোপে জার্মানির প্রভাব কমতে শুরু করে এবং মিত্র শক্তি প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যার কারনে হিটলার বিরোধী জোট বুঝে যায় জার্মানির পতন আসন্ন সেজন্য তারা হিটলারকে হত্যা করতে আরও সচেষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৪৩ সালের আগস্ট মাসে কর্নেল ট্রেস্কোর সাথে পরিচয় হয় এক তরুন জার্মান অফিসারের সাথে। এই তরুন অফিসারের নাম লেফটেন্যান্ট কর্নেল ক্লাউস ভন স্টাফেনবার্গ। জার্মানির উত্তর আফ্রিকা অভিযানে ছিল স্টাফেনবার্গ, যুদ্ধে তার একটি চোখ, একটি হাত এবং অন্য একটি হাতের কয়েকটি আঙুল নষ্টই হয়ে গিয়েছিল। স্টাফেনবার্গ হিটলারের কট্টর বিরোধী ছিল। এরপর জেনারেল ট্রেস্কো অপারেশন ভ্যালকেরির পরিকল্পনা করে। জার্মানির রিজার্ভ সেনাকে অপারেশন ভ্যালকেরিতে যুক্ত করা হয়। এই অপারেশনের মূল বিষয়বস্তু ছিল যদি হিটলারের মৃত্যু হয় তাহলে কোন নাজি অফিসার জার্মানির ক্ষমতা দখল করতে এলে তাকে গ্রেফতার করতে পারবে রিজার্ভ সেনা অর্থাৎ হিটালারের অবর্তমানে পুরো জার্মানির দায়িত্ব জার্মান রিজার্ভ সেনার উপর থাকবে। হিটলার কোন কিছু না বুঝেই এই অপারেশন ভ্যালকেরির প্রস্তাবে সই করে দেয়। কর্নেল ট্রেস্কো অপারেশন ভ্যালকেরির দায়িত্ব দেয় স্টাফেনবার্গের উপর। হিটলারের পাশাপাশি তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হেনরিক হিমলারকেও হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। 

১৯৪৪ সাল আসতে আসতে জার্মানির পরাজয় অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায় যার কারনে হিটলার ঘাবড়ে যায়। হিটলার সেসময় পূর্ব ফ্রন্টের প্রধান সামরিক হেডকোয়ার্টার উল্ফস লেয়ারেই বেশীরভাগ সময় কাটাত, বার্লিনে আসতই না এমনকী জনসমক্ষে বক্তৃতাও দিতনা। যার কারনে হিটলার বিরোধী জোট বার্লিনে হিটলারকে হত্যা করবার পরিকল্পনা সফল করতে পারছিলনা। ১৯৪৪ সালের ৬ জুন পশ্চিম ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে মিত্র শক্তি এসে পৌঁছায়। এই খবর পেয়েই হিটলার বিরোধী জোট ঠিক করে ফেলে যা করবার তাড়াতাড়ি করতে হবে কারন মিত্র শক্তি জার্মানি পৌঁছে গেলে তারা আর সন্ধি করতে পারবেনা। যার কারনে জুলাই মাসেই স্টাফেনবার্গ উল্ফস লেয়ারে পৌঁছায় হিটালরের সাথে দেখা করতে। উল্ফস লেয়ারে একটি বাঙ্কারে হিটলার সবসময় যুদ্ধের রননীতি ঠিক করতো এবং গুরুত্বপূর্ন বৈঠক করতো। স্টাফেনবার্গ তার সাথে একটি ব্যাগে বোম্ব নিয়ে গিয়েছিল। স্টাফেনবার্গের পরিকল্পনা ছিল সে লুকিয়ে বোম্ব হিটালারের পাশে রেখে আসবে যাতে হিটালারের মৃত্যু হয় বিস্ফোরনে। কিন্তু স্টাফেনবার্গ সেখানে গিয়ে দেখে সেখানে হিটলার আছে হিমলার নেই, পরিকল্পনা ছিল হিটলার ও হিমলার দুজনকেই এক সাথে হত্যা করা হবে যার কারনে স্টাফেনবার্গ বোম্ব নিয়ে ফিরে আসে। 

১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই আবারও স্টাফেনবার্গ ব্যাগে বোম্ব নিয়ে উল্ফস লেয়ারে পৌঁছায়। তবে শেষ মুহুর্তে বৈঠকের স্থান পরিবর্তন করে বাঙ্কারের বদলে অন্য একটি ঘরে রাখা হয়, যেখানে অনেক জানলা রয়েছে। এতে খানিকটা ঘাবড়ে যায় স্টাফেনবার্গ কারন বোম্ব বাঙ্কারে বিস্ফোরন হলে চারদিক বন্ধ থাকায় ঘরে থাকা সকলের মৃত্যু হবার সম্ভাবনা বেশী ছিল কিন্তু জানালা দেওয়া ঘরে বোম্ব বিস্ফোরন হলে শকওয়েভ ছড়িয়ে পড়ে যার কারনে বোম্বের প্রভাব কিছুটা কমে যায়। তবুও স্টাফেনবার্গ হিটলারের পাশে ব্যাগ রেখে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ফোরন ঘটে। স্টাফেনবার্গ চুপচাপ বেড়িয়ে বিমান ধরে বার্লিন পৌঁছে যায় বিকেল চারটে নাগাদ। বার্লিনে পৌঁছে স্টাফেনবার্গ জানতে পারে হিটলার মারা গেছে কীনা তার সঠিক কোন তথ্য তখনও জানা যায়নি। তবে স্টাফেনবার্গের বিশ্বাস ছিল হিটলার মারা গেছে যার কারনে সে রিজার্ভ সেনাকে আদেশ দেয় অপারেশন ভ্যালকেরি শুরু করতে সমস্ত নাজি রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করতে কিন্ত বোম্ব বিস্ফোরনে মৃত্যু হয়নি হিটলারের। এদিকে জার্মান রিজার্ভ সেনা একে একে নাজি সরকারের গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তিদের গ্রেফতার করতে থাকে। রিজার্ভ সেনার মেজর রেমার যখন নাজি সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন সদস্য গবলসকে গ্রেফতার করতে তার বাড়ি যায়, সেখানে হিটলার স্বয়ং মেজর রেমারকে ফোনে বলে সে জীবিত আছে এবং স্টাফেনবার্গকে গ্রেফতার করতে আদেশ দেয়। সাথে সাথে মেজর রেমার ও রিজার্ভ সেনা রাত ১১ টার সময় স্টাফেনবার্গ সহ তার গোটা দলকে গ্রেফতার করে। সেই রাতেই স্টাফেনবার্গ সহ তার দলের অধিকাংশ সদস্যকে কোর্ট মার্শাল করে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর নাজি সেনা প্রায় সাত হাজার লোককে গ্রেফতার করে হিটলারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে। এদের মধ্যে পাঁচ হাজার লোককে সরাসরি হত্যা করা হয়। 

হিটলারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অভিযুক্তদের পরিবারকেও গ্রেফতার করা হয়। তবে স্টাফেনবার্গের পরিবার কোনওরকমে পালিয়ে যায় জার্মানি থেকে। হিটলার অপারেশন ভ্যালকেরিতে এবং বোম্ব বিস্ফোরনে আহত ৪৭ জন ব্যক্তিকে বিশেষ উন্ড ব্যাজ দেয় যাতে হিটলারের সই ছিল। জার্মানিতে এই ব্যাজের বিশেষ মর্যাদা ছিল সেসময়। হিটলারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জার্মান সেনাবাহিনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জেনারেল এরউইন রোমেলকেও গ্রেফতার করা হয়। এরউইন রোমেল ফ্রান্স অভিযানে, উত্তর আফ্রিকা অভিযানে জার্মান সেনাবাহিনীর হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং তাঁর অসাধারন রননীতির কারনে তাঁকে ডেসার্ট ফক্স বলা হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জেনারেল ছিল এই এরউইন রোমেল। সেই এরউইন রোমেলকেও গ্রেফতার করা হয়। রোমেলকে দুটো বিকল্প দেওয়া হয় প্রথমত আদালতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে এবং হত্যা করা হবে। এতে তার বদনাম হবে এবং জার্মান সরকারের তরফে কোন সুযোগ সুবিধা তার পরিবার পাবেনা। দ্বিতীয়ত সে নিজে আত্মহত্যা করতে পারে, এতে তার পরিবারকে পেনশন ও মোটা অর্থ দেওয়া হবে। এরউইন রোমেল দ্বিতীয় বিকল্পই বেছে নেয়। 

১৯৪৪ সালের ১৪ অক্টোবর সায়ানাইড পিলস খেয়ে আত্মহত্যা করে এরউইন রোমেল। জার্মান সরকার প্রচার করে মিত্র শক্তির বোম্বিংএ রোমেল আহত হয়ে মারা গেছে। অপারেশন ভ্যালকেরি সফল না হওয়ায় এবং বোম্ব বিস্ফোরনে বেঁচে যাওয়ায় হিটলারের মনে হয় তার উপর পরাশক্তির আর্শীবাদ আছে তাই হিটলার নতুন করে যুদ্ধে মোনোনিবেশ করে। তবে শেষপর্যন্ত জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয় ১৯৪৫ সালে এবং হিটলার আত্মহত্যা করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *