ফিচার আর্টিকেল

আমেরিকার সমতুল্য এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি সম্পন্ন ভারতবর্ষের

সম্প্রতি ওড়িশার বালাসোরে একটি অঞ্চল থেকে প্রায় দশ হাজারের বেশী মানুষজনকে সরকার কিছু সময়ের জন্য অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যায়। কারন হিসাবে বলা হয় ডিআরডিও দেশের সুরক্ষার জন্য মিসাইল পরীক্ষা করবে। এই মিসাইল পরীক্ষা হলে মিসাইলের কিছু অংশ বা অবশেষের আঘাতে সাধারন মানুষজন আহত হতে পারতো তাই বালাসোরের উপকূল থেকে মানুষজনকে সাময়িক সময়ের জন্য নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এই মিসাইল পরীক্ষার জন্য সরকার আগে থেকেই এটা নিশ্চিত করেছিল যে কোনও সাধারন নাগরিকের যেন কোনও ক্ষতি না হয়। ডিআরডিও বালাসোরে ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের ফেজ ২ এর পরীক্ষা করেছে। ব্যালেস্টিক মিসাইল প্রথমে আকাশে কয়েক কিলোমিটার উঁচুতে যায় তারপর নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তকে আঘাতের জন্য ভূপৃষ্ঠের দিকে ছুটে আসে। বালাসোরে এই সিস্টেম পরীক্ষার সময় কোনও কারনে মিসাইল যদি তার লক্ষ্যবস্তকে আঘাত হানতে ব্যর্থ হত তাহলে নীচে থাকা স্থানীয় মানুষজনের আহত হওয়ার সম্ভবনা ছিল সেজন্য তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বালাসোরে ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের সফল পরীক্ষা করা হয়েছে অর্থাৎ ব্যালিস্টিক মিসাইল ভূমি পৌঁছানোর আগেই আকাশে কয়েক কিলোমিটার উঁচুতে অন্য মিসাইল দ্বারা তাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যদি ভবিষ্যতে কখনও চীন বেজিং বা অন্য কোনও শহর থেকে ৫০০০ কিলোমিটার রেঞ্জের ব্যালেস্টিক মিসাইল ভারতকে লক্ষ্য করে ছোঁড়ে তবে সেই মিসাইলকে আকাশেই ধ্বংস করে দেওয়ার লক্ষ্যে ভারত এই ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করছে। আমেরিকা, রাশিয়া, ইসরায়েলের কাছে অনেক আগে থেকেই এই ধরনের সিস্টেম রয়েছে। চীনের কাছে এধরনের সিস্টেম আছে কীনা তা এখনও জানা যায়নি। তবে ভারতের কাছে এখনও পর্যন্ত এধরনের কোনও মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম নেই, যার জন্য ডিআরডিও ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম দ্রুত তৈরি করছে। 

কার্গিল যুদ্ধের পর ২০০০ সালে ভারতের ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম প্রজেক্ট শুরু করে তৎকালীন অটল বিহারি বাজপেয়ী সরকার। ওএফবি, ভারত ইলেকট্রনিক্স, ভারত ডায়নামিক্সের মতেন ৪০টি পাবলিক ও প্রাইভেট সংস্থা এই প্রজেক্টে যুক্ত ছিল। ভারতের পুরো ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম দুটি স্তরে বিভক্ত ফেজ ১ এবং ফেজ ২। ফেজ ১কে পিএডি বা পৃথ্বী এয়ার ডিফেন্স এবং ফেজ ২কে এএডি বা অ্যাডভান্ড এয়ার ডিফেন্স বলা হয়। সম্প্রতি বালাসোরে যে ফেজ ২ অর্থাৎ এএডির পরীক্ষা করা হয়েছে। ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম দুই স্তরীয়ই হয়। পিএডি ফেজের কাজ অনেক বেশী উচ্চতায় ব্যালেস্টিক মিসাইলকে ধ্বংস করা। কোনওভাবে পিএডি ব্যর্থ হলে তখন এএডি তুলনামূলক কম উচ্চতায় ব্যালেস্টিক মিসাইলকে ধ্বংস করবে। এই দুই স্তরীয় ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম ৫০০০ কিলোমিটার দূর থেকে আসা ব্যালেস্টিক মিসাইলকে ধ্বংস করতে সক্ষম। পিএডি সিস্টেমের প্রথম পরীক্ষা করা হয় ২০০৬ সালে এবং এএডি সিস্টেমের পরীক্ষা করা হয় ২০০৭ সালে। পিএডি সিস্টেমের পরীক্ষার মাধ্যমে আমেরিকা, রাশিয়া ও ইসরায়েলের পর ভারত চতুর্থ দেশ হয় অ্যান্টি ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তৈরির ক্ষেত্রে। কিন্তু তখনও এই সিস্টেম সম্পূর্নরূপে তৈরি ছিলনা। যার জন্য বারবার পরীক্ষার প্রয়োজন ছিল এই সিস্টেম সম্পূর্ন রূপে ইনস্টল করবার আগে। জানুয়ারী, ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতের ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের প্রথম ফেজ বা পিএডি সিস্টেম সম্পূর্ন রূপে তৈরি হয়ে গেছে। ভারতীয় বায়ুসেনা ও ডিআরডিও দিল্লিকে সুরক্ষার জন্য এই মিসাইল সিস্টেম ইনস্টলের জন্য ভারত সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষা করছে। দিল্লিতে এই মিসাইল সিস্টেম সম্পূর্নরূপে ইনস্টল করতে তিন থেকে চার বছর সময় লাগবে। তবে এই মিসাইল দিল্লিতে ইনস্টল হয়েছে কীনা কিংবা অন্য কোনও রাজ্যে আবারও ইনস্টল করা হবে এসব সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্য প্রকাশিত করা হয়না, জাতীয় সুরক্ষার জন্য এসব তথ্য গোপন রাখা হয়। ডিআডিও এর ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট ল্যাবরেটরি এই এএডি মিসাইলের মিশন কন্ট্রোল সফটওয়্যার তৈরি করেছে। হায়দ্রাবাদে অবস্থিত ডিআরডিওর রিসার্চ সেন্টার ইমারত এই সিস্টেমের নেভিগেশন, ইলেক্ট্রোমেক্যানিক্যাল অ্যাকচুয়েশন, অ্যাক্টিভ রেডার সিকার তৈরি করেছে। ডিআরডিওর অ্যাডভান্সড সিস্টেম ল্যাবরেটরি পিএডি ও এএডি সিস্টেমের বাকী সমস্ত পরিকাঠামো তৈরি করেছে। এএডি সিস্টেমে দুটি মিসাইল ব্যবহার করা হবে এডি ১ এবং এডি ২। এএডি সিস্টেমকে আমেরিকার থাড বা টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্সের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। 

একটা সময় ভারত রাশিয়া থেকে এস ৪০০ কেনায় আমেরিকা ভারতকে তাদের থাড কেনার জন্যও প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু ভারত বর্তমানে থাডের সমতুল্য মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম নিজেই তৈরি করে ফেলেছে। ভারতের এই ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম বা বিএমডি ৫০০০ কিলোমিটার রেঞ্জের মিসাইলকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম যার অর্থ এই সিস্টেম একপ্রকার আইসিবিএম বা ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমকেও প্রতিরোধ করতে সক্ষম। তবে ভারতের কাছে বিএমডি ছাড়াও আকাশ, এস ৪০০ এর মতোন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। এই সমস্ত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম যৌথভাবে একটি ইউনিট হিসাবে কাজ করবে। বিএমডি থাকবে ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একদম প্রথমে। যদি চীন বা পাকিস্তান ভারতকে লক্ষ্য করে কোনও ব্যালেস্টিক মিসাইল ছোঁড়ে তাহলে প্রথমে বিএমডির দুই ফেজ প্রতিরোধ করবে। যদি কোনও কারনে বিএমডি ব্যার্থ হয় তবে এস ৪০০ এই মিসাইল প্রতিরোধ করবে, যদি এস ৪০০ও ব্যর্থ হয় তবে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যার রেঞ্জ ৩০ কিলোমিটার, এটি মিসাইল প্রতিরোধ করবে। এভাবে ভারতের আকাশ সীমা বহুস্তরীয় মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে। তবে কোনও মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমই একশো শতাংশ সঠিক হয়না, সম্প্রতি ইসরায়েলের মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমও হামাসের অনেক রকেটকে আটকাতে পারেনি। সেই জন্য ভারত পাল্টা আক্রমনের জন্য অগ্নি শ্রেনীর একাধিক মিসাইলও তৈরি করেছে। ডিআরডিও এস ৪০০ এর মতোন এক্সআর স্যাম নামেও একটি দীর্ঘপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করছে। এছাড়া ভারত বর্তমানে লেজার নির্ভর এয়ারডিফেন্স সিস্টেম তৈরির উপরেও পরিকল্পনা করছে। ডিআরডিও এর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রধান ভি কে সারস্বত জানিয়েছেন লেজার বেসড সিস্টেম পরমানু ও অপারমানবিক ওয়ারহেড যুক্ত ব্যালেস্টিক মিসাইল ধ্বংসের জন্য সবচেয়ে আদর্শ। তবে এখনও ১০-১৫ বছর সময় লাগবে এই ধরনের লেজার বেসড আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে। ১৯৯৯ সালে যখন কার্গিল যুদ্ধ শেষ হয় তখন চীন ও পাকিস্তানের ব্যালেস্টিক মিসাইল আক্রমন থেকে ভবিষ্যতে দেশকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ভারত ইসরায়েলকে তাদের অ্যারো ২ এয়ারডিফেন্স সিস্টেম দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল। ইসরায়েল ভারতকে অ্যারো ২ বিক্রি করবার জন্য রাজিও হয়ে গিয়েছিল কিন্তু শেষ মুহুর্ত আমেরিকা বাধা দেয় ইসরায়েলকে এই সিস্টেম বিক্রি করতে। এরপর ভারত সরকার দেশেই এই সিস্টেম তৈরি করার কাজ শুরু করে। আজ ২০২৪ সালে ভারত নিজেই এই সিস্টেম তৈরি করে ফেলেছে কারও সাহায্য ছাড়াই। আরও কয়েকটি পরীক্ষার পর ডিআরডিও একশো শতাংশ নিশ্চিত হলেই দেশ জুড়ে বিএমডি সিস্টেমের দুই ফেজের ইনস্টলেশনের কাজ শুরু হয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *