বালুচিস্তানকে স্বাধীনতা দিতে সাহায্য করবে ভারতবর্ষ?
আঠারোতম লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশে পর দুটি অদ্ভুত ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত ইঞ্জিনিয়ার রাশিদ বারামুলা থেকে বিজয়ী হয়। বলা হয় ইঞ্জিনিয়ার রাশিদ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা। দ্বিতীয়ত পাঞ্জাবে অমৃতপাল সিং জয়লাভ করে, এই অমৃতপাল সিং খালিস্তানি নেতা যে বর্তমানে অসমের জেলে রয়েছে। অথচ প্রাক্তন আইপিএস নেতা আন্নামালাই তামিলনাড়ুতে হেরে যায়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছে বিচ্ছিন্নবাদী নেতারা নির্বাচনে জয়লাভ করে কীভাবে তবে কী কোনও বিদেশী শক্তির মদত রয়েছে পিছন থেকে? আবার নির্বাচনের ফল প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে ভারতীয় জাতীয় পতাকা পোড়ায় খালিস্তানিরা, তাছাড়া ভারতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও অপমান করে তারা। খালিস্তানিরা কানাডায় ভারতীয় সংবিধানও আগুনে পোড়ায়। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে অপারেশন কে ২ এর মাধ্যমে কাশ্মীর ও পাঞ্জাবে খালিস্তানি কর্মকান্ডের মাধ্যমে এই দুই রাজ্যকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের ইনটেলিজেন্স সংস্থা আইএসআই। বালুচিস্তান মডেলই ভারতের কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের মধ্যে প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে।
বালুচিস্তানকে দখল করতে পাকিস্তান ধূর্ত শিয়ালের মতো পরিকল্পনা করেছিল। পাকিস্তান নেতৃত্ব প্রথমে বালুচিস্তানের নেতাদের নিজেদের পক্ষে আনে। এরপর বালুচিস্তানের রাজনীতিতে নিজেদের লোককে নিয়ে আসে পাকিস্তান এবং বালুচি নেতাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে বালুচিস্তান জোর করে দখল করে নেয়। বালুচি লোকেদের উপর নারকীয় অত্যাচার করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পূর্ব পাকিস্তানে জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে যে নৃশংসতা গনহত্যা, গনধর্ষন হয়েছিল ঠিক একই ঘটনা বালুচিস্তানেও করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গরীব প্রদেশ বালুচিস্তান। এখানে বহু উপজাতি সম্প্রদায় বসবাস করে এদের বালুচি লোক বলা হয়। ২০ বিলিয়ন ডলার জিডিপি বিশিষ্ট বালুচিস্তানের সমস্ত খনিজ সম্পদ পাকিস্তান নিজে ব্যবহার করে কিন্তু এর বদলে বালুচি লোকেরা নূন্যতম সুবিধাও পায়না। দশকের পর দশক ধরে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বালুচি মানুষদের গুম হত্যা, ধর্ষন, অত্যাচার করে আসছে পাকিস্তান।
২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী ৪৭,০০০ বালুচি মানুষ উধাও হয়ে গেছে বিগত কয়েক বছরে। এখানে কেউ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই তাকে গুম হত্যা করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বালুচিস্তানে প্রতিবাদ দমনের জন্য স্থানীয়দের ঘরবাড়ি ভেঙে আগুন লাগিয়ে দেয়, পুরুষদের হত্যা করে, বাচ্চাদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে। মহিলাদের উপর নৃশংস অত্যাচার করে। এসব ঘটনা যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্য এখানে ইন্টারনেট ব্যবস্থাও প্রায় নেই বললেই চলে, সমস্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভিপিএন ব্যবহার করে কোনওরকমে বালুচিস্তান থেকে কিছু ঘটনা বাইরে আসে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে অত্যাচার করেছিল ঠিক সেই অতীতেরই যেন পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বালুচিস্তানে।
বালুচিস্তানবাসী বহুদিন ধরেই স্বাধীনতার দাবী করে আসছে। কিন্ত অদ্ভুতভাবে একমাত্র ভারত ছাড়া বিশ্বের কোনওদেশই বালুচিস্তান নিয়ে সহানুভূতি দেখায়নি এখনও পর্যন্ত।
এই বালুচিস্তানকে পাকিস্তান চীনকে বিক্রি করে দিয়েছে প্রায় সিপেক বা চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরের জন্য। চীন পাকিস্তানের সহায়তায় বালুচিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে মূল্যবান ধাতুর জন্য খননকার্য করছে। তাছাড়া মালাক্কা প্রনালীকে এড়ানোর জন্য চীন বালুচিস্তানের গোয়াদর বন্দরকে গভীর সমুদ্র বন্দর হিসাবে তৈরি করছে। ইরানের চাবাহার বন্দরের কাছেই গোয়াদর বন্দর অবস্থিত। সেজন্য চীন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল, গ্যাস সরাসরি গেয়াদর বন্দরের মাধ্যমে নিজের দেশে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে সিপেকের মাধ্যমে। চীন বালুচিস্তানে শ্রমিক থেকে শুরু করে পরিকাঠামো নির্মানের কাঁচামাল পর্যন্ত নিজের দেশ থেকে নিয়ে আসছে যার জন্য স্থানীয় মানুষজন কোনও কাজ পাচ্ছেনা। বালুচিস্তানে খননকার্যের দরুন প্রাপ্ত লভ্যাংশের ৫০ শতাংশ চীন নেয়, ৪৮ শতাংশ পাকিস্তান নেয় এবং ২ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে বালুচিস্তানের জন্য। অর্থাৎ বালুচিদের নিজেদের ভূমি থেকেই খনিজ উত্তোলন করে তাদের মাত্র দুই শতাংশ ভাগ দেয় পাকিস্তান! পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরেও পাকিস্তান সরকার নদীবাঁধ নির্মান করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে স্থানীয় লোকেদেরই চড়া দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে। এসব কারনে দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার সহ্য করা বালুচিরা এবার সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বালুচিস্তানে বালুচিস্তান লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএর মতোন সংগঠন তৈরি হয়েছে যারা নিয়মিত ব্যবধানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর আক্রমন করে। চীনের ইঞ্জিনিয়ার, কর্মকর্তাদের উপরেও আত্মঘাতী আক্রমন হয় নিয়মিত। বালুচিস্তানে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে স্বয়ং পাকিস্তান সরকার পর্যন্ত চীনকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি যার জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলারের সিপেক প্রজেক্ট এখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে। চীনও এখানে আর বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয় তেমন। বালুচিস্তানের সাথে সীমান্ত রয়েছে ইরানের কিন্তু ইরানেও একটি বালুচ প্রদেশ রয়েছে তাই ইরান বালুচিস্তানের স্বাধীনতার ব্যাপারে চুপ থাকে। তবে বালুচিস্তানকে পূর্ন সমর্থন করে একমাত্র আফগানিস্তান। আফগানিস্তানে তালিবান শাসন রয়েছে, তালিবানকে পাকিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল নিজেদের স্বার্থে সেজন্য তালিবান ক্ষমতায় আসতেই পাকিস্তানের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
বর্তমানে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান একে অপরের শত্রু। তবে পাকিস্তান প্রায়ই অভিযোগ করে ভারত ইরান ও আফগানিস্তানের মাধ্যমে বালুচিস্তানকে সহয়তা করে যদিও পাকিস্তানের এই অভিযোগের বিরোধীতা করেছে ভারত। বালুচিস্তানকে স্বাধীনতা দিতে পারে একমাত্র ভারতই। পাকিস্তান কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে সবসময় একটা কথা বলে যে তারা কাশ্মীরের ব্যাপারে কুটনৈতিক সমাধান চায় যদিও পাকিস্তানের আসল রূপ সম্পর্কে সবাই জানে। ভারতেরও উচিত কুটনৈতিক ভাবে বালুচিস্তানের সমস্যা সমাধান করা। ভূরাজনীতিতে ভারতের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। ভারত বিশ্বের একমাত্র দেশ যারা একই সাথে রাশিয়া ও আমেরিকার মতো দুই সুপার পাওয়ারের সাথে সংযোগ রেখেছে। তাছাড়া পুরো দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোরও লিডার ভারত। মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর সাথে ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে ভারত বালুচ লোকেদের সাথে হওয়া সমস্ত অত্যাচারের কথা বিশ্বজুড়ে প্রচার করার মাধ্যমে বালুচিস্তানের স্বাধীনতা আওয়াজ ওঠাতে পারে।
আফগানিস্তানের তালিবান সরকার ভারত বিরোধী নয়। আফগানিস্তানের উন্নতির জন্য ভারত অনেক প্রজেক্ট করেছে দেশটিতে। তাছাড়া আফগানিস্তান ক্রিকেট দলকেও ভারত সহায়তা করে, তাছাড়া ইরানও ভারতের বন্ধু দেশ। বালুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য আফগানিস্তান, ইরানের সাথে ভারত একসাথে আলোচনা করলে এই সমস্যা চিরতরে সমাধান হবে। বালুচিস্তান স্বাধীন হওয়ার অর্থ চীন পাকিস্তানের প্রতি আগ্রহ হারাবে যা ভারতের জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যপাার হবে।