যে দশটি প্রজেক্ট ভারতের অর্থনীতিতে গতি এনেছে
বিশ্বের প্রমুখ অর্থনীতিবিদদের মতে কোনও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হলে প্রথমে দেশটির পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। ভারতে অনেকসময় সরকারি প্রকল্প শুরু হওয়ার পরেও বিভিন্ন জটিলতার কারনে প্রকল্প শেষ হতে নির্ধারিত সময়ের থেকে অনেক বেশী সময় লেগে যায়। কোন সরকারি প্রকল্প সম্পূর্ন হতে যদি দেরী হয় তাহলে প্রজেক্টে প্রস্তাবিত খরচও পূর্বের তুলনায় বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে দেশের জিডিপির উপর। তাছাড়া কোনও প্রজেক্টে দীর্ঘদিন দেরী হলে সাধারন মানুষেরও সমস্যা তৈরি হয়। কিন্তু ২০১৪ সালে সরকার গঠনের পর থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার গত দশ বছরে এমন অনেক মেগা প্রজেক্ট সম্পন্ন করেছে যা দীর্ঘদিন আটকে ছিল নানা কারনে। এসব প্রজেক্টের মধ্যে এমন দশটি প্রজেক্ট রয়েছে যেগুলো সম্পূর্ন হওয়ায় ভারতের অর্থনীতিতে গতি এসেছে।
১) ভুপেন হাজারিকা সেতু:— ২০০৩ সালে আসামের বিজেপি এমএলএ জগদীশ ভুঁইয়া তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর কাছে ভুপেন হাজারিকা সেতু নির্মানের প্রস্তাব দেন। আসামের বিখ্যাত গায়ক ভুপেন হাজারিকার নামেই এই সেতুর নাম রাখা হয়েছিল। আসামের তিনসুকিয়া জেলায় ঢোলা ও সাদিয়ার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদীরই একটি অংশ লোহিত নদীর উপর ৯.১৫ কিলোমিটার লম্বা তিন লেন বিশিষ্ট এই সেতু নির্মানের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে এনডিএ নির্বাচন হেরে যাওয়ায় এই প্রজেক্ট থমকে যায়, অবশেষে ২০১১ সালে এই সেতু নির্মান শেষ হয়। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে এই প্রজেক্টে গতি আসে এবং ২০১৭ সালের মে মাসে এই সেতুর উদ্ভোদন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়কড়ি।
এই সেতু আসাম ও অরুনাচল প্রদেশের মধ্যে দূরত্ব ছয় ঘন্টা থেকে কমিয়ে এক ঘন্টা করে দিয়েছে এবং অরুনাচল প্রদেশে ইন্দো চীন সীমান্ত থাকায় স্ট্রাটেজিক ভাবেও এই সেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভারতের জন্য।
২) পূর্ব পশ্চিম পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়ে:— বহুদিন ধরেই দিল্লিতে পূর্ব পশ্চিম পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির দাবী উঠেছিল যাতে দিল্লি শহরকে যানজট মুক্ত করা যায় ও দূষন কম হয়। ২০০৩ সাল থেকেই এই এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির প্রস্তাব ওঠে কিন্তু নানান কারনে এই প্রজেক্টে অনেক দেরী হয়। শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নিতীন গড়করি এই প্রজেক্ট পুনরায় শুরু করে এবং মাত্র দুই বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে ১৩৫ কিলোমিটার লম্বা ছয় লেন বিশিষ্ট পশ্চিম পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হয়ে যায় এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই ২০১৮ সালের মে মাসের মধ্যে পূর্ব পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হয়ে যায়।
৩) স্ট্যাচু অফ ইউনিটি:— মোদি সরকার ২০১৮ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মূর্তি স্ট্যাচু অফ ইউনিটি তৈরি করে। গুজরাটের নর্মদা নদীর তীরে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের ১৮২ মিটার লম্বা এই মূর্তি তৈরিতে খরচ হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বর, ২০১৩ সালে যখন নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখনই এই প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়েছিল। এই মূর্তিকে কেন্দ্র করে স্থানীয় এলকার পর্যটনশিল্প বৃদ্ধি পেয়েছে এবং স্থানীয়দের আর্থিক বিকাশ হয়েছে। ২০২৩ সালেই এই মূর্তি দেখতে পঞ্চাশ লাখের বেশী লোক গিয়েছিল।
৪) বোগিবিল সেতু:— আসামে ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর বোগিবিল সেতু নির্মানের কাজ ২০০২ সালে শুরু হয়, ২০০৮ সালের মধ্যে এই সেতু নির্মান সম্পূর্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে সেতু নির্মানের কাজও ধীরগতির হয়ে যায়। ২০১৫ সালে ভারত সরকারের কারনে এই প্রজেক্ট গতি আসে এবং ২০১৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর অটল বিহারি বাজপেয়ীর জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই সেতুর উদ্বোধন করেন। উত্তর পূর্ব ভারতের জন্য এই সেতু খুব গুরুত্বপূর্ন, এই সেতু নির্মানের কারনে আসাম ও অরুনাচল প্রদেশের মধ্যে দূরত্ব ১৭০ কিলোমিটার কমে গেছে। এই সেতুর সাহায্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী অরুনাচল প্রদেশে ইন্দো চীন সীমান্তে দ্রুত পৌঁছাতে পারবে।
৫) নতুন সংসদ ভবন:— ভারতের পুরোনো সংসদ ভবন ১৯২৭ সালে তৈরি হয়েছিল যার জন্য এটি সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ২০২০ সালে মোদি সরকার কেন্দ্রীয় ভিস্তা প্রজেক্ট শুরু করে এবং ২০২৩ সালের ২৮ মে ভারতের নতুন সংসদ ভবন তৈরি হয়ে যায়। পুরোনো সংসদ ভবন ২৪,২৮১ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছিল, নতুন সংসদ ভবন ৬৪,৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় তৈরি হয়। নতুন সংসদে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা সহ আরও নতুন ডিজিট্যাল প্রযুক্তি রয়েছে।
৬) অটল টানেল:— ২০০২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী এই প্রজেক্ট শুরু করেন। তখন এই প্রজেক্টের নাম ছিল রোহতাং টানেল। ২০০৩ সালে পরিবেশগত কারনে বন্ধ করা হয় এই প্রজেক্ট। ২০০৭ সালে পুনরায় এই প্রজেক্ট শুরু হয়, ২০১৪ এর মধ্যে প্রজেক্ট শেষ করবার কথা ছিল। কিন্তু প্রজেক্ট নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। ২০১৪ সালের পর এই প্রজেক্টে বিশেষ গুরুত্ব দেয় ভারত সরকার এবং ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু অটল টানেলের নির্মান শেষ হয়। ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ীর সম্মানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই টানেলের নাম রাখে অটল টানেল এবং ৩ অক্টোবর, ২০২০ সালে ৯.০২ কিলোমিটার লম্বা এই অটল টানেলের উদ্বোধন করা হয়। দশ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা হাইওয়ে টানেল অটল টানেল হিমাচল প্রদেশের সাথে লের দূরত্ব কমিয়েছে।
৭) চেনাব সেতু:— জম্মুকে কাশ্মীরের সাথে যুক্ত করবার জন্য এই চেনাব সেতু তৈরি করা হয়েছে। ১.৩ কিলোমিটার লম্বা চেনাব সেতু নদীপৃষ্ঠ থেকে ৩৫৯ মিটার উচ্চতায় তৈরি করা হয়েছে। ৮ মাত্রার ভূমিকম্প, ২৬০ কিলোমিটার বেগে হওয়া ঝড় এবং মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে সক্ষম এই সেতু। ২০০৩ সালে এই প্রজেক্ট শুরু হলেও দীর্ঘদিন নানান সমস্যায় পড়ে এই প্রকল্পটি। অবশেষে ২০১৭ সালে এই সেতু নির্মানের প্রকৃত কাজ শুরু হয়। ২০২২ সালের ১৩ আগস্ট চেনাব সেতু উদ্বোধন করা হয়। এবছরই বন্দে ভারত ট্রেন যাবে এই সেতু দিয়ে যাতে কাশ্মীরে পর্যটন শিল্প আরও বৃদ্ধি পাবে।
৮) মুম্বাই ট্রান্স হার্বার লিঙ্ক:— অটল বিহারি বাজপেয়ীর সম্মানে এই প্রজেক্টকে অটল সেতুও বলা হয়। ২১.৮ কিলোমিটার লম্বা এই অটল সেতু মুম্বাইয়ে ও নভি মুম্বাইকে যুক্ত করেছে। আরব সাগরের উপর নির্মিত অটল সেতু ভারতের দীর্ঘতম সমুদ্র সেতু। ১৭,৮৪৩ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন সত্তর হাজার গাড়ি যাতায়াত করতে সক্ষম। ১৯৯০ সালের দিকে মুম্বাইকে নভি মুম্বাইয়ের সাথে যুক্ত করবার প্রস্তাব উঠলেও দীর্ঘদিন এরকম কোনও প্রজেক্ট শুরু করা হয়নি। অবশেষে ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল এই প্রজেক্ট শুরু হয় এবং ২০২৪ সালের ১২ জানুয়ারি এই অটল সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই সেতু মহারাষ্ট্রের অর্থনীতি উন্নয়নে সহয়তা করবে।
৯) কিষানগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রজেক্ট :— জম্মু ও কাশ্মীরে ২০০৭ সালে এই প্রজেক্ট শুরু হয়। কিন্তু ২০১১ সালে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ করে ভারত সিন্ধু জলচুক্তি লঙ্ঘন করে এই প্রজেক্ট তৈরি করছে যার জন্য সাময়িক ভাবে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে ভারত এই কেস জিতে যায় এবং ২০১৮ সালের ১৯ মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন।
১০) ডিএফসি প্রজেক্ট :— ডেডিকেটেড ফ্রেড করিডরের সূচনা ২০০৬ সালে হলেও এই প্রকল্পে কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। পূর্ব ও পশ্চিম দুই ভাগে এই প্রজেক্ট করা হচ্ছে। পশ্চিম ডিএফসি গ্রেটার নয়ডার দাদরি থেকে মুম্বাইয়ের জওহরলাল নেহেরু পোর্ট ট্রাস্ট পর্যন্ত করা হচ্ছে যার দৈর্ঘ্য ১৫০৪ কিলোমিটার। পূর্ব ডিএফসি পাঞ্জাবের লুধিয়ানা থেকে পশ্চিমবঙ্গের ডানকুনি পর্যন্ত তৈরি করা হচ্ছে যার দৈর্ঘ্য ১৩৩৭ কিলোমিটার। এই প্রজেক্টের আশি শতাংশ সম্পূর্ন হয়ে গেছে যার মধ্যে পূর্ব ডিএফসি পুরো সম্পূর্ন হয়ে গেছে। এখনও পর্যন্ত এই প্রজেক্টে ১.২৪ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। পশ্চিম ডিএফসির ১,০৪৬ কিলোমিটার কাজ সম্পূর্ন হয়ে গেছে। মার্চ, ২০২৪ এর মধ্যে এই প্রজেক্টের ৯৫ শতাংশ কাজ পূর্ন হয়ে যাবে। ২০২৫ এর মধ্যে ভারতের ৭০ শতাংশ মালগাড়ি এই পথেই যাতায়াত করবে যাতে পন্য পরিবহনে গতি আসবে এবং খরচ কম হবে।