ফিচার আর্টিকেল

উগ্র কমিউনিজমের জন্য ভারতে হওয়া নকশাল আন্দোলন আজও ভারতের সবথেকে বড় আভ্যন্তরীন হুমকী

কমিউনিজম বা সাম্যবাদ শোষনহীন, ব্যক্তি মালিকানাধীন সমাজ গঠনের কথা বলে যেখানে বিত্তবান শ্রেনী ও দারিদ্র্য শ্রেনীর মধ্যে কোনও ভেদাভেদ থাকবেনা। সাম্যবাদে শাসক শ্রেনীর বদলে জনগনকেই রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রন করার কথা বলা হয়েছে। সমাজের নিপীড়িত মানুষদের পরিত্রানের পথ নিসাবে উদ্ভব হয়েছিল কমিউনিজী। কিন্ত পরিকল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। বিংশ শতকে বিশ্বের বেশ কিছু দেশে যখন কমিউনিজম ছড়িয়ে পড়ে তখন দেখা যায় কমিউনিজম সম্পূর্ন ব্যর্থ একটি ভাবাদর্শ যাকে বইয়ের পাতায় পড়তেই ভালো লাগে। সোভিয়েতরা ইউনিয়ন, চীন, কিউবা, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া সহ যেসব দেশেই কমিউনিজম গেছে সেসব দেশেই অসংখ্য সাধরন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, দেশগুলোর রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে গেছে। ভারতেও কমিউনিজমের কালোছায়া পড়েছিল ১৯২৫ সাল থেকেই। যার কারনে ১৯৬০ এর দশক থেকে ভারতে যে উগ্র বামপন্থা তৈরি হয় তার খেসারত আজও দিতে হচ্ছে।  

উনিশ শতকে ইউরোপে শ্রমিক শ্রেনীর উপর মালিকপক্ষের শোষনের কারনে কার্ল মার্ক্স কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো প্রচার করে যাতে বলা হয় সমাজের শোষিত, পীড়িত মানুষকে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে আন্দোলন করার কথা এবং ক্ষমতা দখল করার কথা। কার্ল মার্ক্সের এই মতবাদ পূর্নভাবে অনুসরন করে প্রায় সত্তর বছর পর রাশিয়ার কমিউনিস্ট নেতা ভ্লাদিমির লেলিন। লেলিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার সাধারন মানুষ জারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে এবং বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরি হয়। এরপর ১৯৪৯ সালে মাও জেডং এর নেতৃত্বে চীনে কমিউনিস্ট সরকার গঠন হয়। কিন্তু কার্ল মার্ক্স যে কমিউমিজমের কথা বলেছিল তা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনে মানা হয়নি। 

ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের কারনে নিপীড়িত শ্রমিকদের বিদ্রোহ করবার কথা বলেছিল কার্ল মার্ক্স। কিন্ত ভ্লাদিমির লেলিনের নেতৃত্বে বহু সাধারন মানুষও বিদ্রোহ করেছিল জারের বিরুদ্ধে এবং চীনে কৃষকদের সাথে নিয়ে ক্ষমতা দখল করে মাও জেডং। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে ভারতেও ১৯২৫ সালে কমিউনিস্ট দলের গঠন হয়। কিন্তু সোভিয়েত ও চীনের মতো কমিউনিস্ট দল কখনওই ভারতে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে পারেনি কারন ভারতের রাজনীতিতে বরাবরই জাতীয় কংগ্রেসের আধিপত্য ছিল। ভারতে কমিউনিস্ট দলের ভীত শক্ত হতে শুরু করে ১৯৪৬ সালের তেভগা আন্দোলনের মাধ্যমে। এরপর তেলেঙ্গানা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের ইন্দোচীন যুদ্ধের পর ভারতীয় রাজনীতিতে কমিউনিস্ট দলের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। তবে ভারতে কমিউনিজমের উগ্ররূপের প্রকাশ ঘটে নকশাল আন্দোলনের মাধ্যমে। ভারতের কমিউনিস্ট দল প্রথমদিকে কার্ল মার্ক্সের আদর্শ মেনে চলতো, তাদের নীতি ছিল কোনওরকম সশস্ত্র বিদ্রোহ না করা। এই দলের ভিতর একাংশ মনে করতো বিপ্লব ছাড়া সমাজে পরিবর্তন অসম্ভব। সেজন্য চারু মজুমদারের নেতৃত্বে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট দল থেকে মার্ক্সবাদী লেলিনবাদী একটি কমিউনিস্ট দল গঠন করা হয়। এই দলের হাত ধরেই ভারতে উগ্র বামপন্থার সূচনা হয়। ভারতে উগ্র বামপন্থার কারনে নকশাল আন্দোলনের সূচনা হয় যা ভারতের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। 

১৯৬৬ সালের দিকে উত্তরবঙ্গে কৃষকরা জমিদারদের বিরুদ্ধে অধিকারের দাবীতে সোচ্চার হয়। কৃষকদের দমন করতে জমিদাররা রীতিমতো দমন নীতি শুরু করে। 

১৯৬৭ সালের ২৫ আগস্ট উত্তরবঙ্গে শিলিগুড়ি শহরের কাছে নকশালবাড়ি গ্রামে কৃষকদের বৈঠকে পুলিশ গুলি চালায় যাতে এগারোজন মানুষের মৃত্যু হয়। তই ঘটনকে কেন্দ্র করে চারু মজুমদারের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট দল বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহের নাম দেওয়া হয় নকশাল বিদ্রোহ। 

চারু মজুমদার মাও জেডং এর অনুসারী ছিল। মাও জেডং কার্ল মার্ক্সের কমিউনিজম থেকে কিছুটা ভিন্ন উগ্র কমিউনিজমে বিশ্বাস করতো। চারু মজুমদার তার ঐতিহাসিক আট দলিল লেখনী এবং বামপন্থী নেতা সরোজ দত্ত দেশব্রতী পত্রিকার মাধ্যমে এই নকশাল বিদ্রোহকে গোটা দেশে ছড়িয়ে দেয়।

জমির মালিকদের বিরুদ্ধে নায্য অধিকারের দাবীতে এই বিদ্রোহ শুরু হলেও ক্রমশ এই বিদ্রোহ সশস্ত্র বিদ্রোহের রূপ নেয়। উত্তরবঙ্গের একটি ছোট গ্রাম থেকে এই নকশাল বিদ্রোহ কলকাতাতেও ছড়িয়ে পড়ে। চারু মজুমদার, সরোজ দত্ত, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যালের মতোন উগ্র বামপন্থী নেতারা জমিদাররা ছাড়াও সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষক, পুলিশ অফিসার, বামপন্থী বিরোধী রাজনীতিবিদদের শত্রু মনে করতো। যার জন্য তারা নকশাল আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৭০ এর দশকে পশ্চিমবঙ্গে রীতিমতো গৃহযুদ্ধের সূচনা করেছিল। 

১৯৭০ এর দশকে কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গ উগ্র বামপন্থী রাজনীতির সাক্ষী থাকে। সেসময় দলে দলে ছাত্ররা নকশালপন্থী হয়ে পড়ে, সমস্ত স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজের মতোন প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত নকশালপন্থীদের দখলে চলে গিয়েছিল, সেখানে রীতিমতো অস্ত্র তৈরি করা হত। বাধ্য হয়ে তৎকালীন সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় শক্ত পুলিশকে নির্দেশ দেয় শক্ত হাতে নকশাল আন্দোলন দমন করতে। 

১৯৭২ সালে চারু মজুমদার ধরা পড়ে এবং আলিপুর জেলেই তার মৃত্যু হয়। সরোজ দত্তও গ্রেফতার হয় কিন্তু তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি পরবর্তীকালে। সুশীতল রায়চৌধুরী আত্মগোপন করে এবং সেই অবস্থাতেই তার মৃত্যু হয়। মার্ক্সবাদী লেলিনবাদী কমিউনিস্ট দলের বহু নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। পুরো সংগঠন বেশ কয়েকটি ভাগে বিভাগ হয়ে যায়। নকশাল আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি কানু সান্যাল নিজের গ্রামের বাড়িতেই আত্মহত্যা করে ২০১০ সালে। 

পশ্চিবঙ্গে নকশাল আন্দোলন নিয়ন্ত্রন করা গেলেও এই আন্দোলনের প্রভাব বিহার, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, ছত্রিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্নাটকে ছড়িয়ে পড়ে। এসব রাজ্যের নকশাল অধুষ্যিত অঞ্চলকে রেড করিডর বলা হয়। ভারতে নকশাল আন্দোলনকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়, প্রথম পর্যায়ের নকশাল আন্দোলন হয় ১৯৬৭-১৯৭২ পর্যন্ত চারু মজুমদারের নেতৃত্বে, মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্রপ্রদেশেই এইসময় নকশালরা সক্রিয় ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নেতৃত্বে নকশাল বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রনের পর নকশাল আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপের সূচনা হয় যা চলে ২০০৪ সাল পর্যন্ত। এইসময় অনেক উগ্র কমিউনিস্ট সংগঠন তৈরি হয় যেমন বিহারে মাওইস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার বা এমসিসি তৈরি হয়, অন্ধ্রপ্রদেশে পিপলস ওয়ার গ্রুপ বা পিডব্লুউজি তৈরি হয়। ২০০৪ সালের পর নকশাল আন্দোলনের তৃতীয় ধাপ শুরু হয় যা ছিল সবচেয়ে হিংস্র। এইসময় পিডব্লুউজি এবং এমসিসি যৌথভাবে সিপিআই (মাওয়েস্ট) তৈরি করে। মাওয়েস্ট বা মাওবাদী তাদের বলা হয় যারা মাও জেডং এর মতবাদ অনুসরন করে। এই মাওবাদীকে ভারতের সবচেয়ে আভ্যন্তরীন শত্রু বলা হয়। সিপিআই (মাওয়েস্ট) ভারতের গনতান্ত্রিক পরিকাঠামো ও নির্বাচন পদ্ধতির বিরোধীতা করে ভারতকে আধা ঔপনিবেশিক, আধা সামন্ততান্ত্রিক বলে। এদের লক্ষ্য ভারতের সরকার পরিবর্তন করে চীনের মতো ভারতেও কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করা। চীনে মাও জেডং ক্ষমতা দখলের সময় প্রথমে চীনের গ্রাম্য এলাকা দখল করে সেখানকার কৃষকদের তার সাথে যুক্ত করে। কিন্তু ভারতে তা হয়নি, মাওবাদীরা ভারতীয় কৃষকদের সহায়তা তেমন পায়নি। মাওবাদীরা ভারতের উপজাতি সম্প্রদায়কে নিশান করেছে, মাওবাদীরা গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে গোরিলা আক্রমনের নীতি অবলম্বন করেছে। ভারতে নকশাল আন্দোলনের শুরু থেকে মাওবাদীদের উত্থান সবক্ষেত্রেই চীন এইসব নিষিদ্ধের সংগঠন গুলিকে সহায়তা করে এসেছে। একটা সময় ভারতের ২০০ এর বেশী জেলাতে নকশালবাদীদের প্রভাব ছিল কিন্ত ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতের দশটি রাজ্যের ৭০টি জেলা নকশাল প্রভাবিত অঞ্চল রয়েছে। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী নকশাল আন্দোলনে অন্তত ছয় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে ভারতে। এসব মাওবাদীরা গোরিলা আক্রমনের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপরেও আক্রমন করে। যেমন কিছু বছর আগে ছত্রিশগড়ের সুকমাতে নকশাল হামলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২২ সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হয় এবং ৩০ জন আহত হয়। ভারত সরকার বহু আগেই এসব উগ্রবাদী সংস্থাকে নিষিদ্ধ করেছে। মোদী সরকার মাওবাদীদের দমনে সমাধান ডকট্রিন শুরু করেছে। সিআরপিএফ মাওবাদীদের দমনে অভিযান করে। তবে অনেক মাওবাদী আত্মসমর্পন করে সমাজের মূলস্রোতে ফিরেও এসেছে।  তবে এখনও বেশ কিছু মাওবাদী জঙ্গী জঙ্গলে লুকিয়ে আছে যাদের দমনে নিয়মিত অভিযান হয়। 

ভারতের মতো পেরু এবং ফিলিপিন্সেও সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করেছিল কমিউনিস্ট দল গুলো। পেরুতে এই ঘটনাকে বলা হত সাইনিং পথ কিন্তু পেরু এবং ফিলিপিন্সে উভয়দেশেই এই আন্দোলন দমন করে দেশ দুটির সরকার। ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে নীতি বদলেছে সেখানকার কমিউনিস্ট দল। নেপালে সশস্ত্র বিদ্রোহের বদলে গনতান্ত্রিক দল হিসাবে রাজনীতিতো যুক্ত কমিউনিস্ট দলগুলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *