কমিউনিজম বিলুপ্ত হতে চলেছে পৃথিবী থেকে!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে মানব ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক ও নৃশংস যুদ্ধ বলা হয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগে গোটা বিশ্ব দুটি ভয়ানক পরমানু বিস্ফোরনের সাক্ষী হয়। সেজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরে পুরো বিশ্ব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার মাত্র দুই বছরের মধ্যে সমগ্র বিশ্ব পুনরায় দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে তৎকালীন সময়ের দুই সুপার পাওয়ার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। এই শীতল যুদ্ধ শুধু দেশদুটির মধ্যে একে অন্যের থেকে শ্রেষ্ঠ হওয়ার প্রতিযোগিতা ছিলনা বরং দুই দেশের মতাদর্শের যুদ্ধও ছিল। আমেরিকা ক্যাপিটালিজম বা পুঁজিবাদে বিশ্বাসী ছিল কিন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিজম বা সাম্যবাদ অনুসরন করতো। সময়ের অগ্রগতির সাথে কমিউনিজমকে ছাড়িয়ে পুঁজিবাদের গ্রহন যোগ্যতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ১৯৯১ সালে বিশ্বের প্রথম ও সবচেয়ে বড় কমিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায় এবং আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় দুইশো বছর আগে ইউরোপে শুরু হওয়া কমিউনিজম বর্তমানে কমিউনিজম বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশেই টিকে আছে। পুঁজিবাদের সামনে সাম্যবাদ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে চলেছে বিশ্ব থেকে।
আঠারো শতকের দিকে ইউরোপে শিল্পবিপ্লব ঘটে। যারজন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, ব্যাঙ্কিং বিভাগ তৈরি, বাজারের বৃদ্ধি সব মিলিয়ে ইউরোপের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসে, কর্মসংস্থান ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। ইউরোপে উৎপাদিত পন্য বিক্রির জন্য এইসময় সমুদ্রপথে নতুন নতুন জায়গা আবিষ্কার শুরু করে ইউরোপীয়ান শক্তিগুলি যা পরবর্তীকালে ঔপনিবেশবাদ তৈরির প্রধান কারন হয়। সেসময় অর্থনৈতিক ভাবে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা ইউরোপের মধ্যে সম্পূর্ন এক বিপরীত চিত্রও লক্ষ্য করা যায়। কলকারখানা স্থাপনের ফলে ইউরোপে এক শ্রেনীর মানুষ যেমন ক্রমশ বিত্তবান হয়ে ওঠে, অন্যদিকে বেশী লাভের আশায় কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের রীতিমতো শোষন শুরু হয় যাতে সমাজের ধনী ও গরীবের ভেদাভেদ বৃদ্ধি পায়। এইজন্য কার্ল মার্ক্সের নেতৃত্বে ইউরোপে কমিউনিজম বা সাম্যবাদের উত্থান হয়। কার্ল মার্ক্স এমন একটি সমাজ ব্যবস্থার কথা বলে যেখানে বিত্তবানদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবেনা বরং ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবে সাধারন মানুষ। কার্ল মার্ক্স সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সমান অধিকারের জন্য সাম্যবাদের প্রচার শুরু করে। উনিশ শতকের শেষের দিকে জার্মানি, হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ডসে কমিউনিজম ছড়িয়ে পড়ে। পুঁজিবাদে যেহেতু একটি বিশেষ শ্রেনীর মানুষই বেশী লাভবান হচ্ছিল সেজন্য সাধারন মানুষজন কমিউনিজমের প্রতি বেশী আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। কার্ল মার্ক্সের কমিউনিজমে প্রভাবিত হয়ে ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে ভ্লাদিমির লেলিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লব বা অক্টোবর বিপ্লব হয় যার উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার শাসক জারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সাধারন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। অক্টোবর বিদ্রোহের পর ১৯২২ সালে ভ্লাদিমির লেলিনের নেতৃত্বে বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট দেশ হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের গঠন হয়। পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্ক্সিস্ট লেলিনিস্ট চিন্তাধারার কারনে বিশ্বের সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠে। ১৯২৯ সালে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার কারনে মার্ক্সিস্ট লেলিনিস্ট মতবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটে সারা বিশ্বব্যাপী। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্বে কমিউনিজমের প্রভাব সবচেয়ে বেশী বৃদ্ধি পায়। ১৯৩০ এর পর আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের পুঁজিবাদে যখন অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় তখন নবগঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্যবাদ নীতির প্রতি মানুষজন বেশী আকর্ষিত হয়ে পড়ে। ১৯৪৫ সালে পরমানু বোম্ব বিস্ফোরনের পর জাপান আত্মসমর্পন করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। বিংশ শতকের শুরুতেও ব্রিটেন ও ফ্রান্স বিশ্বের দুটি গুরুত্বপূর্ন সুপার পাওয়ার ছিল কিন্তু দুটি বিশ্বযুদ্ধের কারনে ইউরোপের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে যায় এবং আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নতুন দুটি সুপার পাওয়ারের উদ্ভব হয়। ১৯৪৫ সালের পর থেকে এই দুই দেশের মধ্যে শুরু হওয়া শীতল যুদ্ধে উভয় দেশই অর্থনীতি, সামরিক অস্ত্র, গবেষনা, প্রযুক্তিগত উন্নয়নে একে অপরকে টেক্কা দেওয়া শুরু করে। এর পাশাপাশি দুই দেশই তাদের মতাদর্শও বাকী দেশগুলোর মধ্যে প্রচার শুরু করে। কোরিয়া দ্বীপের উত্তর অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে কমিউনিজম ছড়িয়ে পরে এবং দক্ষিনাংশে আমেরিকার কারনে পুঁজিবাদ বিস্তার লাভ করে। আজও উত্তর কোরিয়া একটি কমিউনিস্ট দেশ এবং দক্ষিন কোরিয়া পশ্চিমা ঘনিষ্ঠ পুঁজিবাদী দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, পূর্ব জর্মানি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে যেখানে কমিউনিজম দেখা যায় এবং আমেরিকার অধীনে থাকা পশ্চিম জার্মানিতে ক্যাপিটালিজম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ স্বধীন হয়, ভারত নিজেকে গনতান্ত্রিক দেশ হিসাবে ঘোষনা করলেও ভারতেও স্বাধীনতাট আগেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে একটি কমিউনিস্ট দল তৈরি হয়ে যায়। ১৯৪৯ সালে লেলিনের কমিউনিস্ট মতবাদে বিশ্বাসী মাও জেডং এর নেতৃত্বে চীনে কমিউনিস্ট দল ক্ষমতায় আসে। ১৯৫০ এর দশকে গৃহযুদ্ধের শেষে ১৯৬৯ সালে কিউবাতেও কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় আসে। ১৯৬০ এর দশকে ভিয়েতনামেও কমিউনিজম ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে ১৯৮৫ সাল আসতে আসতে বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যাই কমিউনিস্ট হয়ে যায়। তবে কমিউনিজমের পাশাপাশি আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদও বহু দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের ভেঙে পড়া অর্থনৈতিক পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য আমেরিকা বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আইএমএফ বা ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের মতোন সংস্থা তৈরি করে যারজন্য বহু দেশ উপকৃত হয়।
প্রথমদিকে কমিউনিজম বহু দেশে ছড়িয়ে পড়লেও বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে কমিউনিজমের আসল চেহারা সামনে আসতে শুরু করে৷ কার্ল মার্ক্স কমিউনিজমের প্রচার করেছিল শ্রমিক শ্রেনীর মানুষের আর্থিক বৈষম্য দূরীকরনে। কিন্তু কোনও দেশে কমিউনিস্ট সরকার গঠন হয়ে গেলে সরকারের দায়িত্ব ও দেশ পরিচালনা সম্পর্কে কোনও কথাই কার্ল মার্ক্স বলে যায়নি। পুঁজিবাদে সরকারের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি সংস্থা শিল্প কলকারখানা সহ ব্যবসায়িক কার্যক্রমে যুক্ত থাকে। যারজন্য দেশে উৎপাদন দ্রুত হয়, আন্তজার্তিক বানিজ্য ব্যবস্থাও স্বচ্ছ থাকে। কিন্তু যেসব দেশে কমিউনিস্ট সরকার গঠন হয় সেখানে সরকার বেশীরভাগ শিল্পাঞ্চল, কৃষিজমি তাদের অধীনে নিয়ে নেয়, কমিউনিস্ট দেশে বেসরকারি সংস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। যারজন্য কমিউনিস্ট দেশে দূর্নীতির পরিমান অত্যন্ত বেড়ে যায় কারন সরকারের বিরুদ্ধে কারও প্রতিবাদের ক্ষমতা থাকেনা। এইজন্য বলা হয় কমিউনিজম বা সাম্যবাদ শুনতে যতটা সুন্দর, বাস্তবে ততটাই কঠিন। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কিউবা, উত্তর কোরিয়ার মতোন কমিউনিস্ট দেশে একটি নির্দিষ্ট সময় পরেই ডিক্টেটরশিপ তৈরি হয়ে যায়। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নে জোসেফ স্তালিন, চীনে মাও জেডং, কিউবাতে ফদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে ডিক্টেটরশিপ তৈরি হয়। কমিউনিজম বলে জনগনই ক্ষমতার উৎস, দেশে কোনও রাজা বা শাসক থাকবেনা কিন্তু বাস্তবে কমিউনিস্ট সরকার গঠনের পরেই দেশগুলোতে একনায়কতন্ত্র শুরু হয়ে যায়। কমিউনিস্ট শাসকদের শাসনে দেশগুলোতে নির্বিচারে সাধারন মানুষকে হত্যা করা হয়। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে হাঙ্গেরি বিদ্রোহ এবং ১৯৮৯ সালে চীনে তিয়েনামেন স্কোয়ারে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করে দেশদুটির সরকার। সোভিয়েত কমিউনিস্ট নেতা জোসেফ স্তালিন ও চীনের মাও জেডং কয়েক লাখ লোককে হত্যা করেছে তাদের শাসনকালে। কিন্তু অন্যদিকে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোতে পুঁজিবাদি নীতির প্রভাবে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে এবং দেশগুলোতে বাক স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার রয়েছে, দেশগুলোর জনগন চাইলে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনও করতে পারে। এইজন্য ১৯৯০ এর দশকে কমিউনিজমকে হটিয়ে পুঁজিবাদ, গনতন্ত্র গোটা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এইসময় বিশ্বায়নের কারনে দেশগুলোতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং মুক্ত বানিজ্যনীতির কারনে বহুদেশ আর্থিক ভাবেও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পাশাপাশি আমেরিকান ডলার বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কারেন্সি হিসাবে পরিচিতি পায়। অন্যদিকে সরকারের নিয়ন্ত্রন ও দূর্নীতির কারনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কমিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। চীন ১৯৭০ এর দশক থেকেই তার কমিউনিজমকে কীছুটা সংস্কার করে পুঁজিবাদকে যুক্ত করেছিল বলে চীনও আর্থিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কমিউনিজমের কফিনে শেষ পেড়েক পড়ে যখন রাশিয়া ১৯৯২ সালে আইএমএফে যোগদান করে। কমিউনজম একটি দেশের জন্যই কত ক্ষতিকর তার সবচেয়ে বড় উদাহারন দুই কোরিয়া। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর উত্তর কোরিয়াতে কমিউনিজম এবং দক্ষিন কোরিয়াতে ক্যাপিটালিজম ছড়িয়ে পড়ে একই সময়ে। বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট শাসক কিম জং উনের শাসনে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্রপীড়িত দেশগুলোর মধ্যে একটি উত্তর কোরিয়া, যেখানে পুঁজিবাদের প্রভাবে দক্ষিন কোরিয়া বিশ্বের তেরোতম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।