ফিচার আর্টিকেল

জাপানের কিংবদন্তি সামুরাই মিয়ামোতো মুসাসি। কেন তার রণনীতি তাকে কিংবদন্তী বানিয়েছিল?

রাজেশ রায়: মানুষের একটা স্বভাব আছে একই পদ্ধতি বারবার ব্যবহার করা অর্থাৎ যদি কোন একটি পদ্ধতিতে কেউ সাফল্য পায় তাহলে বারবার সে একই পদ্ধতিই ব্যবহার করে পুনরায় সাফল্য পাবার জন্য। যেমন কোনও ফুটবল বা ক্রিকেট ম্যাচে যে দল জেতে পরবর্তী কয়েকটা ম্যাচ সেই একই দল নিয়ে খেলার চেষ্টা করে আবারও জেতার জন্য। ঠিক তেমনি কোন সিনেমা জনপ্রিয় হলে, ভবিষ্যতে সেই একই সিনেমার ভার্সন তৈরি করা হয়। অর্থাৎ আমাদের মনুষ্যজাতির মধ্যে পুরোনো একই নীতি অবলম্বন করার একটি স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। শুধু খেলার কিংবা সিনেমার জগৎ এই নয় বরং যুদ্ধক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য। এব্যাপারে একটি প্রচলিত কথা আছে যতক্ষন পর্যন্ত নির্দিষ্ট রননীতি শত্রু ভাঙতে পাচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত সেই নীতিই প্রয়োগ করা উচিত। এই অভ্যাস সবসময় যে সাফল্য এনে দেয় এমনটা নয়, কারন বারবার একই নীতি ব্যবহার করলে প্রতিপক্ষ বুঝে যায়। ইতিহাসে যত বড় বড় সামরিক নায়ক হয়েছে তারা বারবার প্রতিপক্ষকে তাদের রননীতি দ্বারা পরাজিত করেছে। 

প্রাচীন পারস্যের শাসক হোক কিংবা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বারবার শত্রুকে তাদের নতুন নতুন রননীতি দ্বারা শত্রুকে পরাজিত করেছে। আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে জাপানেও এক ব্যক্তি তার সামরিক নীতির কারনে কিংবদন্তি হয়ে যায়।

সময়টা ১৬০৫, জাপানে তখন একজন প্রসিদ্ধ সামুরাই ছিল মিয়ামোতো মুসাসি। সামুরাই হওয়ায় মিয়ামোতো তরোয়াল চালানোয় দক্ষ ছিল। মাত্র তেরো বছর বয়স থেকেই ডুয়েল জিততে শুরু করে মিয়ামোতো। বারংবার একাধিক ডুয়েলে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে থাকে সে যার কারনে জাপানে ধীরে ধীরে তার খ্যাতি বাড়তে থাকে। 

১৬০৫ সাল আসতে আসতে ২১ বছর বয়সী মিয়ামোতো মুসাসি জাপানে রীতিমতো প্রসিদ্ধ সামুরাই হিসাবে খ্যাতি লাভ করে। একদিন মাতাসিসিরো নামে আরেক সামুরাই তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য  আহ্বান করে। মাতাসিসিরো জাপানের ইয়োশিয়োকা নামে এক পরিবারের সদস্য ছিল। জাপানে সেসময় কিছু বিখ্যাত সামুরাই পরিবার ছিল যাদের প্রভাব ছিল সমাজে। ইয়োশিয়োকা এমনই একটি প্রভাবশালী সামুরাই পরিবার ছিল। মাতাসিসিরো মিয়ামোতো মুসাসিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য আহ্বান করেছিল কারন মিয়ামোতো মাতাসিসিরোর বাবা ও কাকাকে ১৬০৫ সালে ডুয়েলে পরাজিত করে হত্যা করেছিল, সে কারনে মাতাসিসিরো প্রতিশোধ নিতে চাইছিলো। মিয়ামোতোকে তার বন্ধুরা বোঝায় এটা কোন সাধারন দ্বন্দ্ব হবেনা কারন মাতাসিসিরো প্রতিশোধ নিতে চাইছে। বাস্তবেও তাই হয়, মাতাসিসিরো জানতো সে হারাতে পারবেনা মিয়ামোতোকে, যার কারনে সে রাতের বেলায় ডুয়েলের আয়োজন করে। তার পরিকল্পনা ছিল আগে থেকেই বেশ কিছু লোক লুকিয়ে থাকবে এবং সুযোগ বুঝে লড়াইয়ের মাঝে মিয়ামোতোকে হত্যা করা হবে। মিয়ামোতোকর একটা স্বভাব ছিল যে যখনই সে ডুয়েলে যেত তখন যেসময় দ্বন্দ্ব হবার কথা তার অনেক পরে যেত যাতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী অপেক্ষা করতে করতে রেগে যায় এবং দ্বন্দ্বের সময় তার পুরো মনোযোগ না থাকে। মাতাসিসিরো এটা জানতো তাই সে আগে থেকেই লড়াই এর স্থানে বেশ কিছু লোক নিয়ে উপস্থিত হয় কিন্তু এবার মিয়ামোতো আগেই উপস্থিত ছিল সেখানে। মিয়ামোতো একটি গাছের পেছনে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিলো। মাতাসিসিরো আসতেই মিয়ামোতো গাছের পেছন থেকে বেরিয়ে সরাসরি লড়াই শুরু করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা যায় মাতাসিসিরো এবং তার সাথে আসা লোকরা বুঝতে পারেনা কী করবে। মাতাসিসিরোর লোকেরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদেরও মেরে ফেলে সেখান থেকে চলে যায় মিয়ামোতো। এভাবে আরও একটি ডুয়েল জিতে যায় মিয়ামোতো মুসাসি। ইয়োশিয়োকা পরিবারের তিনজনকে মেরে ফেলার ফলে মিয়ামোতোর নাম আরও ছড়িয়ে পড়ে। এরপর মিয়ামোতো জাপানের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে এবং বিভিন্ন সামুরাইদের সাথে দ্বন্দ্ব করতে শুরু করে। এরকমই একদিন মিয়ামোতো জানতে পারে একজন শক্তিশালী সামুরাই বাইকেনের কথা। সেসময় জাপানে বাইকেনের সাথে লড়াই করতে লোকে ভয় পেত কারন বাইকেন দুই হাতে দুটি অস্ত্রের সাহায্যে লড়াই করতো। তার একহাতে থাকত একটি সিকেলের মতোন লম্বা ধারালো অস্ত্র এবং অন্যহাতে থাকতো একটি কাঠের লম্বা অংশ যাতে লোহার শিকলের সাহায্যে একটি ধারালো গম্বুজ যুক্ত বল ছিল। মূলত এই অস্ত্রটার কারনে লোকে বাইকেনের সাথে যুদ্ধ করতে চাইতনা। 

যথারীতি লড়াইয়ের নির্দিষ্ট দিনে বাইকেন উপস্থিত হয়। এদিকে স্বভাবমতো মিয়ামোতো দেরী করেই আসে। মিয়ামোতো সবসময় একটি তরোয়াল নিয়েই লড়াই করতো। কিন্তু এবার সে দুটো তরোয়াল নিয়ে আসে একটি আকারে ছোট এবং আরেকটি লম্বা। লড়াই শুরু হবার সাথে সাথে মিয়ামোতো এত দ্রুত তরোয়াল ঘোরায় যে বাইকেন লোহার বল দিয়ে আক্রমনের সুযোগই পায়না, ততক্ষনে লম্বা তরোয়াল দিয়ে বাইকেনকে হত্যা করে দেয় মিয়ামোতো। বাইকেনকে হত্যা করার পর মিয়ামোতোর খ্যাতি আরও বেড়ে যায়। এরপর আবারও মুসাসি জাপানের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। এবার মুসাসিকে দ্বন্দ্বের জন্য আহ্বান করে সাসাকি নামে এক সামুরাই। বাইকেনের থেকেও বড় যোদ্ধা ছিল সাসাকি। সাসাকির সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার বিশাল লম্বা একটি তরোয়াল। সেসময় জাপানে সাসাকির তরোয়াল সম্পর্কে বলা হত এই তরোয়াল যার হাতে থাকবে তাকে যুদ্ধে কেউ পরাজিত করতে পারবেনা। যখন সাসাকি মুসাসিকে যুদ্ধের জন্য আহ্বান করে তখন সবাই ধরে নেয় এটাই হয়ত মুসাসির জীবনের শেষ যুদ্ধ। সাসাকি যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে সমুদ্রের তীরবর্তী একটি জায়গাকে বেছে নেয়। যথারীতি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পৌঁছে যায় সাসাকি, সমুদ্রের তীরে অনেক লোক জড়ো হয়েছিল এই লড়াই দেখবার জন্য। নির্ধারিত সময়ের অনেক পড়ে সবাই লক্ষ্য করে সমুদ্র থেকে একটি ছোট নৌকা করে মুসাসি আসছে। মুসাসির কাছে অস্ত্র হিসাবে ছিল একটি ছোট তরোয়াল এবং নৌকার হাল। এটা দেখেই সবাই ধরেই নেয় মুসাসির পরাজয় নিশ্চিত। লড়াই শুরু হবার কিছুক্ষন ছোট তরোয়াল দিয়ে প্রতিরোধ করছিল মুসাসি হঠাৎই মুসাসি তার হাল বুকে গেঁথে দেয় সাসাকির এবং সাথে সাথে তার মৃত্যু হয়। আসলে মুসাসির হালের নীচের দিকে একটি ধারালো ছুরির মতো অংশ লাগানো ছিল এবং তার এই হাল সাসাকির তরোয়ালের থেকেও লম্বা ছিল। সাসাকিকে পরাজিত করবার পর জাপানে সামুরাই সম্প্রদায়ে কিংবদন্তীতে পরিনত হয় মুসাসি। মিয়ামোতো মুসাসি এই তিনটি লড়াইয়ে প্রতিবার প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিভিন্ন স্ট্রাটেজিতে অবাক করে দিয়েছিল। প্রতিবার লড়াইয়ে ভিন্ন ভিন্ন নীতি অবলম্বন করায় তাকে কেউ পরাজিত করতে পারেনি। বিশ্বে যত শক্তিশালী, প্রসিদ্ধ শাসক এসেছে তারা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন যুদ্ধনীতির দ্বারা প্রতিপক্ষকে হয়রান করে দিয়েছিল। এমনকী ছোট সেনাবাহিনীও অসাধারন রননীতির কারনে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাস্ত করেছিল। যেমন গ্রীকরা তাদের তুলনায় চারগুন শক্তিশালী পারস্য সেনাকে পরাস্ত করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এরউইন রোমেল উত্তর আফ্রিকাতে অ্যালায়েড ফোর্সকে বারবার পরাজিত করেছিল তার ধূর্ত পরিকল্পনা দিয়ে। অ্যালায়েড ফোর্সের সেনা সেসময় উত্তর আফ্রিকাতে প্রচুর ছিল এরউইন রোমেলের সেনার তুলনায়। কিন্তু এরউইন রোমেল এত কৌশলে ছোট ছোট আক্রমন করতে শুরু করে যে অ্যালায়েড ফোর্স বুঝতেই পারেনা পরবর্তী আক্রমন কোথায় হবে। এর কারনে এরউইন রোমেলকে ডেসার্ট ফক্স বলা হত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *