লাদেনের পর পৃথিবীর সবথেকে কুখ্যাত সন্ত্রাসী। কিভাবে হত্যা করেছিল আমেরিকা?
দিনটা ১আগস্ট, ২০২২ বাকি সব দিনের মতোই একটি স্বাভাবিক কর্মব্যস্ত দিন। বিশ্ব রাজনীতি ব্যস্ত রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, চীন তাইওয়ান বিবাদ এবং শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকট নিয়ে। হঠাৎই সেই দিন সন্ধ্যা বেলায় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন হোয়াইট হাউস থেকে জাতির উদ্দেশ্যে ঘোষনা করেন আমেরিকা আয়মান আল জাওহারিকে শেষ করে দিয়েছে। আয়মান আল জাওহারি বিশ্বের কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদার প্রধান যাকে বিগত কুড়ি বছর ধরে আমেরিকা ও সিআইএ খুঁজছিল। আল জাওহারিকে খুঁজে বের করে দেওয়ার জন্য আমেরিকা ২৫ মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার পর্যন্ত ঘোষনা করেছিল।
ওসামা বিন লাদেনের পর বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত সন্ত্রাসী ছিল এই আয়মান আল জাওহারি। ৯/১১ এর হামলার পর থেকে আমেরিকা ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজছিল। দশ বছর ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করার পর ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে অপারেশন নেপচুন স্ফিয়ারের মাধ্যমে ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করে হত্যা করে আমেরিকার নেভি সীলস। তারপর থেকেই আয়মান আল জাওহারি আলকায়েদার দায়িত্ব নেয়। তখন থেকেই তার খোঁজ শুরু করে আমেরিকা, কারন ৯/১১ এর ঘটনায় ওসামা বিন লাদেনের সাথে আয়মান আল জাওহারিরও স্পষ্ট মদত ছিল। বিশ্বের অন্যতম কুখ্যাত জঙ্গি আয়মান আল জাওহারি সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
আয়মান আল জাওহারির জন্ম হয়েছিল ১৯৫১ সালের ১৯ জুন মিশরের গিজা শহরের একটি সম্পন্ন পরিবারে। তার বাবা মহম্মদ জাওহারি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বড় সার্জেন ও প্রফেসর ছিল। তার মা উমায়া আজম মিশরের সবচেয়ে ধনী ও রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী পরিবারের মেয়ে ছিল। তার দাদু শেখ আাল জাওহারি মিশরের শাহী ইমাম ছিল। এরকম উচ্চ শিক্ষিত ও ধনী পরিবারে জন্মানোয় স্বাভাবিক ভাবেই আল জাওহারি নিজেও পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী ছিল।
১৯৭৪ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারিতে স্নাতক হয়ে মিশরের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় আল জাওহারি। তিনবছর সেনাবাহিনীতে কাজ করার পর ১৯৭৮ সালে আল জাওহারি সার্জেন হিসাবে মাস্টার ডিগ্রি করে এবং সেই বছরই প্রথম বিয়ে করে সে। আয়মান আল জাওহারি মোট চারটি বিয়ে করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে আল জাওহারি হজ যাত্রা করে এবং সৌদি আরবেই তার ডাক্তারি প্রাকটিস শুরু করে। ১৯৮৬ সালে এখানেই তার সাথে পরিচয় হয় ওসামা বিন লাদেনের। এখান থেকেই শুরু হয় তার সন্ত্রাসের হাতেখড়ি। এই সময় থেকেই আলকায়দায় সক্রিয় হতে শুরু করে সে। ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর মিশরের রাজধানী কায়রোতেই রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করে মিশরীয় ইসলামিক সংগঠন। এই ঘটনায় একশো জনের বেশী ব্যাক্তিকে গ্রেফতার করা হয় যাতে আয়মান আল জাওহারিও ছিল। জেলে তাকে প্রচুর অত্যাচার করা হয়। অবশেষে ১৯৮৪ সালে সে জেল থেকে ছাড়া পায়। ১৯৯৩ সালে মিশরের গৃহমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উপর আত্মঘাতী আক্রমন করে আয়মান আল জাওহারি ও তার মিশরীয় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন কিন্তু ওই দুই ব্যাক্তিই ভাগ্যক্রমে প্রানে বেঁচে যান। এরপর আল জাওহারি মিশর ছেড়ে পালিয়ে যায় কিন্তু তার সন্ত্রাসবাদী কাজ চালাতেই থাকে।
১৯৯৫ সালে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে মিশরের অ্যামবেসী এবং ১৯৯৮ সালে নাইরোবিতে আমেরিকার অ্যামবেসীর উপর আত্মঘাতী হামলা করে আয়মান আল জাওহারির সংগঠন। নাইরোবির ঘটনায় ২০০ এর বেশী মানুষের মৃত্যু হয়। যার কারনে গোটা বিশ্বে কুখ্যাত হিসাবে পরিচিত হয় ওসামা বিন লাদেন ও আয়মান আল জাওহারি। ১৯৯৮ সালে মিশরের আদালত আল জাওহারি ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে ফাঁসির সাজা ঘোষনা করে। ১২ অক্টোবর, ২০০০ সালে ইয়ামেনে আমেরিকার একটি ডেস্ট্রয়ারের উপর আত্মঘাতী হামলা করে আল কায়েদা যাতে ১৭ জন মারা যায়। এরপরেই আমেরিকার এফবিআই বিশ্বজুড়ে ২২ জন কুখ্যাত জঙ্গির তালিকায় আল জাওহারির নাম যোগ করে।২০০৭ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানের লাল মসজিদে হামলা করা হয় যাতে একশো মানুষের মৃত্যু হয়। এই মসজিদে আল জাওহারি একটি চিঠি লিখে রেখে দিয়ে যায় যাতে স্পষ্ট বলা হয় আলকায়দাই দায়ী এই আক্রমনের জন্য। ২৭ ডিসেম্বর, ২০০৭, পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় যার মাস্টার মাইন্ড আয়মান আল জাওহারি। এসব সন্ত্রাসবাদী হামলা প্রমান করে আল জাওহারি কত বড় নরপিশাচ। তবে এখনও একটা ঘটনা বাকী ছিল।
২০০১ সালে আমেরিকার নিউইয়র্কে হামলা করে আল কায়েদা, একেই ৯/১১ বলা হয় যাতে প্রায় ৩০০০ লোকের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর থেকেই ওসামা বিন লাদেন ও আয়মান আল জাওহারির খোঁজ শুরু করে আমেরিকা এবং আফগানিস্তান আক্রমন করে আমেরিকা। তবে ওসামা বিন লাদেন সৌদি আরবের নাগরিক তাহলে মনে হতে পারে আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমন কেন করল? এর জন্য সময়ের একটু পেছনে যাওয়া দরকার।
সময়টা ১৯৮০ এর দশক। সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমন করতে শুরু করে আফগানিস্তানে। শুরু হয় সোভিয়েত আফগান যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ওসামা বিন লাদেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আল কায়েদা এবং তালিবানকে নিয়ে যৌথভাবে আক্রমন শুরু করে। সেই থেকে আফগানিস্তানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে লাদেন। আমেরিকা খুব ভালো করেই জানত যে লাদেন আফগানিস্তানেই লুকিয়ে আছে। কারন আরবের কোন দেশে লুকিয়ে থাকার ঝুঁকি নেবেনা লাদেন। সেজন্য আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমন করে। ডিসেম্বর, ২০০১ এ আমেরিকা আফগানিস্তানের বেশ কিছু জায়গায় এয়ারস্ট্রাইক করে, যাতে আয়মান আল জাওহারির স্ত্রী ও দুই সন্তান মারা যায়। এরপর ২০০৬ ও ২০০৮ এ আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে এয়ারস্ট্রাইক করে আমেরিকা কিন্তু তবুও আল জাওহারির কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এরপর জর্জ বুশের পর আমেরিকার ৪৪ তম রাষ্ট্রপতি হয় বারাক ওবামা। তখনই আমেরিকার আফগানিস্তানে যুদ্ধ আরও বৃদ্ধি পায়।
ওবামার সময়েই ২০১১ সালের ২ মে বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত সন্ত্রাসী ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে আমেরিকা। তারপরেই আল কায়েদার নেতৃত্ব ভার গ্রহন করে আয়মান আল জাওহারি। কিন্তু আমেরিকার কাছে তাকে খুঁজে পাওয়ার থেকেও বড় হয়ে দাঁড়ায় আফগানিস্তানে তালিবানকে পরাস্ত করা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আফগানিস্তানে আমেরিকা দুর্বল হতে শুরু করে এবং তালিবান শক্তিশালী হতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত ২০২১ সালের ২০ আগস্ট আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায় আমেরিকা। আফগান প্রেসিডেন্ট আসরাফ ঘানি দেশ ছেড়ে পালায় এবং আফগানিস্তানে তালিবান সরকার গঠন হয়। আমেরিকান সেনা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গেলেও আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ আফগানিস্তানে লুকিয়ে আয়মান আল জাওহারিকে খুঁজতে থাকে।শেষপর্যন্ত সিআইএ ২০২১ সালে কাবুলের কাছে শেরপুরে আয়মান আল জাওহারিকে খুঁজে পায়। সেখানে তালিবানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের একটি নিরাপদ ঘাঁটিতে থাকছিল আয়মান আল জাওহারি। সম্পূর্ণ তথ্য পাঠানো হয় রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনকে। হোয়াইট হাউসে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর ২০২২ এর ২৫ জুলাই জো বাইডেন আয়মান আল জাওহারিকে হত্যার আদেশ দেয়। ৩১ জুলাই সকাল ৬:১৮ নগাদা ড্রোন আক্রমন শুরু করা হয়। আল জাওহারির বাড়িতে দুটি হেলফায়ার মিসাইল ছোঁড়া হয় যাতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় আয়মান আল জাওহারির। ১ আগস্ট রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন জনসমক্ষে জানান আমেরিকা বিশ্বের কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী আয়মান আল জাওহারিকে হত্যা করেছে।